ফজলুল বারী:স্বৈরাচার এরশাদ আমলে ছোটন ভাই নামের এক যুবনেতার সঙ্গে আমাদের বিচিন্তা কর্মীদের দারুন সখ্য হয়। পুরো নাম নুরুল ইসলাম ভূইয়া। তখন তিনি ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। বিচিন্তা কর্মীরা তখন দেশের মিডিয়া মুল্লুকের ইমার্জিং টাইগার্স। মিনার মাহমুদের নেতৃত্বে আমরা নতুন একদল সাংবাদিক প্রতি সপ্তাহে বিচিন্তা বের করি। জাতীয় প্রেসক্লাব ভিত্তিক সিনিয়র সাংবাদিকদের বড় অংশ ভয়ে অথবা লোভে এরশাদের অনুগত। সে কারনেও পাঠকরা তখন ভয়ডরহীন বিচিন্তা টিমটিকে পছন্দ করতো। সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত রাজনৈতিক নেতাদের যারা গ্রেফতার এড়াতে হুলিয়া মাথায় আত্মগোপন করে আছেন তাদের খুঁজে বের করে ইন্টারভ্যু করার দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। ঢাকায় নতুন একজন সাংবাদিক হিসাবে ব্যাপারটি আমার পক্ষে সহজ ছিলোনা। নিজেরই তখন চালচুলো ছিলনা। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদেরও অনেককে নামে চেহারায় চিনি। ব্যক্তিগতভাবে আলাপ হয়নি। এরপর আবার সেই নেতাদের ইন্টারভ্যু করতে হবে যারা হুলিয়া মাথায় আত্মগোপন করে আছেন! বিশ্বস্ত মনে না হলে তখন তারা কারোর সঙ্গেই তারা দেখা করছিলেননা। কারন একজন রিপোর্টারের মাধ্যমেও সামরিক স্বৈরাচারের তল্পিবাহক গোয়েন্দারা তাদের অবস্থান জেনে যেতে পারেন। ছোটন ভাইর সঙ্গে সখ্য হওয়ায় কাজটি সহজ হয়ে যায়। মূলত তার মাধ্যমেই ওই সময়ে আমি প্রথমে জাসদের হাসানুল হক ইনু, পরে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা হায়দার আকবর খান রনোর ইন্টারভ্যু করি। ধানমন্ডি এলাকার দুটি বাড়িতে আমি তাদের কাছে পৌঁছতে পারি ছোটন ভাইর কল্যানে। তখন থেকে তারা আমার ইনু ভাই, রনো ভাই। আজ প্রিয় রনো ভাইর ৭৭তম জন্মদিন। শুভ জন্মদিন প্রিয় রনো ভাই।
আসুন তাঁর ব্যাপারে আমরা আগে বিস্তারিত জানি। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম নেতা হায়দার আকবর খান রনোর জন্ম ১৯৪২ সালের ৩১ আগস্ট কলকাতায় নানার বাসায়। জন্ম হয়েছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। তাই তাঁর ডাক নাম রাখা হয়েছিল রণো। এখন তিনি এ নামেই পরিচিত। পিতৃভূমি নড়াইল জেলার সদর থানাধীন চিত্রা নদীর পাড়ে বরশালা গ্রাম (বর্তমানে নড়াইল পৌরসভার অধীন)। নানাবাড়ি নড়াইল থানায় মির্জাপুর গ্রামে। নানা সৈয়দ নওশের আলী ছিলেন উপ-মহাদেশের বিখ্যাত রাজনীতিক। রনো ভাইর বাবা হাতেম আলী খান ছিলেন একজন প্রকৌশলী। ১৯৬৮ সালে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সড়ক ও জনপথ বিভাগের চীফ ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে অবসরগ্রহণ নেন। সৎ ও যোগ্য অফিসার হিসাবে তাঁর খ্যাতি ছিল। ১৯৯৯ সালে তিনি মারা যান। মা কানিজ ফতেমা মোহসিনা ছিলেন সৈয়দ নওশের আলীর দ্বিতীয় কন্যা। বাম রাজনৈতিক কর্মীদের প্রতি রনো ভাইর মা’র অকৃত্রিম ভালবাসা ও সহযোগিতার জন্য বাম প্রগতিশীল মহলের তিনি বিশেষ পরিচিত ও শ্রদ্ধার স্থানে অবস্থান করেছিলেন। রণো ভাইর মানসিক গড়নে তার বাবা-মা’র যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। তাঁর ছোট ভাই হায়দার আনোয়ার খান জুনোও একজন বিশিষ্ট বামপন্থি রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। হায়দার আকবর খান রণো’র একমাত্র সন্তান রানা সুলতানা। তার দুই নাতি আছে। অরিত্র ও অন্তিক। এরা এখন কানাডা প্রবাসী।
ছাত্রজীবনে মেধাবী ছাত্র ছিলেন হায়দার আকবর খান রনো । স্কুলজীবনে বরাবরই ক্লাসে ফার্স্ট হতেন। যশোর জিলা স্কুল, রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও ঢাকার সেন্টগ্রেগরী স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। ম্যট্রিক পাশ করেন ১৯৫৮ সালে ঢাকাস্থ সেন্টগ্রেগরী স্কুল হতে। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে মেধা তালিকায় ১২তম হন। ঢাকার নটরডেম কলেজ হতে আই এস সি পাশ করেন ১৯৬০ সালে। সে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু কারাবাস ও অন্যান্য কারণে পদার্থবিদ্যার কোর্স সম্পন্ন করতে পারেননি। পরে কারাগারে থাকা অবস্থায় আইনে ব্যাচেলর হন। হাইকোর্টের সনদও পেয়েছিলেন। কিন্তু পেশা হিসাবে কখনও ওকালতি করেননি।পড়ার সময়ে ১৯৬০ সালে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন রনো। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারীতে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার মাধ্যমে শুরু সক্রিয় রাজনীতি। ১৯৬৩ সাল হতে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ছিলেন তখনকার সবচেয়ে বড় ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। মেধাবী ছাত্র হিসাবে ১৯৬১ সালে পান সিয়াটো স্কলারশিপ। এই স্কলারশিপের পুরো টাকাই তিনি চাঁদা হিসাবে দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টিকে।
দেশে তখন পাকি জেনারেল আইয়ুবের সামরিক শাসন। প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ। কোন ছাত্র সংগঠনেরও প্রকাশ্য তৎপরতা ছিল না। ওই সময়ে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ছাত্র গোপনে সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি নেন। এদের মধ্যে প্রধান ভূমিকায় ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ ও হায়দার আকবর খান রনো। টার্গেট ছিল ২১ ফেব্রুয়ারীর মিছিল থেকে শুরু হবে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন। এরমাঝে ৩০ জানুয়ারী শহীদ সোহরাওয়ার্দী গ্রেফতার হলে টার্গেটের তারিখ এগিয়ে আনা হয়। ঠিক হয় ১ ফেব্রুয়ারী ছাত্র ধর্মঘট হবে। রনোসহ নেতারা ধর্মঘটের ব্যবস্থা করেন। ১ ফেব্রুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট হয় এবং ঐদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় যে ছাত্র সভা হয়েছিল, সেখানে একজনই বক্তা ছিলেন হায়দার আকবর খান রনো। সেই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তিনিই প্রথম প্রকাশ্য বক্তব্য রাখেন।
১৯৬২ সাল জুড়ে যে ঐতিহাসিক সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন ও পরবর্তীতে শিক্ষা আন্দোলন হয় রনো তার নেতৃত্বে ছিলেন। তখনো পর্যন্ত কোন সংগঠিত ছাত্র সংগঠন ছিল না। ছাত্র নেতারা ঠিক করলেন ১৯৫২ সালে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নকে ( যা ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসনের পর বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো ) পুনর্জীবিত করা হবে। পুরাতন নাম নিলেও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নকে তখন নতুন করে গঠন করা হয়েছিল। অক্টোবর মাসে এক সম্মেলনের মাধ্যমে এই সংগঠনের পুনর্জন্ম হয়। সম্মেলনে হায়দার আকবর খান রণো ৬২-এর আন্দোলনের উপর রাজনৈতিক রিপোর্ট পড়েন। ডাঃ আহমদ জামানকে সভাপতি, কাজী জাফর আহমদকে সাধারণ সম্পাদক ও হায়দার আকবর খান রনো’কে যুগ্ম সম্পাদক করে গঠন করা হয় ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটি। ১৯৬২ সালে রণো দুইবার গ্রেফতার হন। ৬২-এর মার্চ মাসে তাঁকে গ্রেফতার করে প্রথমে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে রাখা হয়েছিল। পরে পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। সেখানকার ছাব্বিশ সেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও তিনি একসঙ্গে ছিলেন।
১৯৬৩ সালে হায়দার আকবর খান রনো পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্ব সাংগঠনিক যোগ্যতার কারণে সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ক্ষুদ্র অবস্থা থেকে তখনকার সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। ছাত্র আন্দোলনের কারণে ১৯৬৪ সালে তাঁর নামে হুলিয়া বের হয়। যা তখনকার সব পত্রিকায় প্রথম পাতায় ছাপা হয়। তিনি চলে যান আত্মগোপনে। কিন্তু দুই মাস পর ধরা পড়েন। গোয়েন্দা সংস্থার কার্যালয়ে তাঁকে দুই দিন ও দুই রাত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রাখা হয়েছিল। ঘুমাতে দেয়া হয়নি। মাথার ওপর রাখা হয় অনেক পাওয়ারের বৈদ্যুতিক বাতি।
১৯৬৫ সালের তাঁর জেলে থাকাকালেই ছাত্র ইউনিয়নের একাংশকে (মেনন গ্রুপ) সংগঠিত করার কাজে মন দেন। মুক্তি পেয়ে ১৯৬৫ সালে যুক্ত হন রেল ধর্মঘটের সঙ্গে। আবার গ্রেফতার হন। জেলে থাকা অবস্থায় সিদ্ধান্ত নেন, মুক্তির পর আর ছাত্র সংগঠন করবেন না। সরাসরি যুক্ত হবেন শ্রমিক বা কৃষক আন্দোলনের সাথে। ১৯৬৬ সালে কাজী জাফর আহমদ ও হায়দার আকবর খান রনো টঙ্গি শ্রমিক এলাকায় শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। দুইজন একসঙ্গে টঙ্গি অঞ্চলে যে শ্রমিক আন্দেলন গড়ে তুলেছিলেন তা বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়।
ঢাকার বাসা ছেড়ে হায়দার আকবর খান রনো টঙ্গির শ্রমিক বস্তিতে থাকতে শুরু করেন। সপ্তাহে এক আধবার রাজনৈতিক কারণে ঢাকায় আসতেন। মধ্যবিত্ত ঘর থেকে আসা রাজনৈতিক কর্মীর নিজস্ব বাড়ী-ঘর ছেড়ে শ্রমিক বস্তিতে দিনের পর দিন থেকে তৃণমূল পর্যায়ে শ্রমিক আন্দোলন ও বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার ঘটনা আমাদের দেশে খুব বেশী নেই। রনোর এই জীবন বিপ্লবীদের জন্য এক দৃষ্টান্ত। গ্রেফতারি পরোয়ানা এড়িয়ে তিনি শ্রমিক কলোনী বা বস্তিতে থাকতেন। টঙ্গিতে যে ধরণের শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছিল তাতে এবং শ্রমিকদের মধ্যে তাঁর যে ধরণের বিশাল জনপ্রিয়তা ছিল, তাতে টঙ্গি অঞ্চল থেকে পুলিশের পক্ষে খুব বড় রকমের প্রস্তুতি ও ঝুঁকি নেয়া ছাড়া তাঁকে গ্রেফতার করা সহজ ছিল না। এরপর তিনি আর কখনো গ্রেফতার হননি। তবে আত্মগোপনে গেছেন অনেকবার।
১৯৬৯ সালের জেনারেল আইয়ুব বিরোধী গণঅভ্যুত্থান সংগঠনেও তাঁর ভূমিকা ছিল। একদিকে টঙ্গিতে শ্রমিক আন্দোলন, পাশাপাশি জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনে সংগঠকের ভূমিকা দুটোই পাশাপাশি চালিয়ে গেছেন। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে টঙ্গি থেকেই শুরু হয় ঐতিহাসিক ঘেরাও আন্দোলন। এই আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। পরে ঘেরাও আন্দোলন অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। রনোকে তখন টঙ্গির বাইরে অন্যান্য শ্রমিক অঞ্চলেও সংগঠন গড়ে তুলতে ও নেতৃত্ব দিতে যেতে হয়েছে । বলা যেতে পারে তখন তাঁর নেতৃত্বে এক নতুন ধারার শ্রমিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল।
১৯৬৯-৭০ সালে দ্বিতীয় সামরিক শাসন আমলে টেক্সটাইল শ্রমিকদের দুইমাস ধরে ঐতিহাসিক যে ধর্মঘট হয়েছিল এর নেতা ছিলেন রনো। টঙ্গি অঞ্চলে অসংখ্য বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ে সেনাপতির ভূমিকা পালন করেছিলেন এই সাহসী নেতা। সে ঘটনাগুলো এখনো কিংবাদন্তির মতো রয়েছে। ১৯৭০ সালে তিনি তদানিন্তন সর্ববৃহৎ শ্রমিক সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ছেলে বেলায় পারিবারিক সূত্রে কমিউনিস্ট মতাদর্শের সংস্পর্শে আসেন রনো। স্কুলজীবনে কিছু মার্কসবাদী বই কলকাতা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। ১৯৬৫ সালের আগে এখানে নিষিদ্ধ ছিল মার্কসবাদী সাহিত্য । ১৯৬৬ সালে গোপন কমিউনিস্ট পার্টি আন্তর্জাতিক মতবিতর্কের ফলে বিভক্ত হলে তিনি তথাকথিত চীনপন্থী অংশের সঙ্গে যুক্ত হন। পরবর্তী দুই বছরে ঐ অংশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়। ১৯৬৯ সালে তিনি আরও কয়েকজনের সঙ্গে গঠন করেন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি।
১৯৭১ সালে এই সমন্বয় কমিটির নেতৃত্বে বাংলাদেশে বিভিন্ন এলাকায় ১৪টি সশস্ত্র ঘাঁটি তৈরী হয়েছিল। এই সকল অঞ্চলগুলির সঙ্গে যোগাযোগ ও রাজনৈতিক পরিচালনা এবং মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার কাজে তিনি নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে তিনি শিবপুর যান যেখান থেকে পরবর্তীতে সমন্বয় কমিটির নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র ঘাঁটি অঞ্চলগুলির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হতো। শিবপুরের সমন্বয় কমিটির অন্যতম সদস্য মান্নান ভুঁইয়ার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল বিশাল মুক্তিবাহিনী এবং ঘাঁটি অঞ্চল। সেখান থেকে তিনি এবং রাশেদ খান মেনন নানা পথ ঘুরে মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে দেখা করতে (৩ এপ্রিল, ১৯৭১) টাঙ্গাইলের বিন্নাফুর গ্রামে গিয়েছিলেন। পরদিনই মাওলানা ভাসানীর বাড়ি আক্রমন করে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী। এর একদিন পরেই ভাসানীর সঙ্গে রণো মেনন বিচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। যুদ্ধের সময় অনেক চেষ্টা করেও তারা আর যোগযোগ করতে পারেননি। ১৯৭১ এর ১ ও ২ জুন কলকাতার বেলেঘাটায় ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সহায়তায় বামপন্থীদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যেখানে বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়। হায়দার আকবর খান রনো এই কমিটির ঘোষাণাপত্র রচনা ও পড়েন।
ছাত্রজীবন থেকেই মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার সুযোগ তাঁর হয়েছিল। পরবর্তীজীবনে তিনি মাওলানা ভাসানীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালেই ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মোজাফফর আহমদসহ ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন নেতার সঙ্গে রনোর পরিচয় হয়। এখনও কমরেড রনোর সঙ্গে অনেক বিদেশী কমিউনিস্ট ও ওয়ার্কাস পার্টির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট পার্টিসমুহের অনেক আন্তর্জাতি সম্মেলনেও তিনি যোগ দিয়েছেন।
১৯৭৩ সালে কমরেড রনো ও অন্যান্য সহকর্মীরা মিলে গঠন করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী)। পরে ১৯৭৯ সালে পার্টির নাম পরিবর্তন করা রাখা হয় বাংলাদেশের ওয়ার্কাস পার্টি। প্রথম থেকেই তিনি পলিটব্যুরোর সদস্য ছিলেন। ১৯৭৯-৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০০৯ সালে রাশেদ খান মেননের সাথে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত বিরোধ তৈরি হলে তিনি ওয়ার্কাস পার্টির একাংশ নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হন। বর্তমানে ঐ পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য। তিনি কমিউনিস্ট ঐক্যের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মাওলানা ভাসনীর ঘনিষ্ঠ অনুসারী হলেও এবং বিভিন্ন সময় ন্যাপের কর্মকন্ডে ভূমিকা রাখলেও তিনি কখনও ন্যাপে যোগ দেননি। ১৯৭৪ সালে ইউপিপি গঠিত হলে তিনি তাঁর সহ-সভপতি ছিলেন ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত। সুদীর্ঘ রাজনৈতিকজীবনে জাতীয় পর্যায়ের সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে তিনি যে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময় তিনি বুর্জোয়া সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন এবং প্রতিটি রাজনৈতিক প্রশ্নে শ্রমিক শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন তত্ত্বগতভাবে এবং বাস্তব সাংগঠনিক আন্দোলনগত কাজের মধ্য দিয়ে। রনোর মধ্যে বাস্তব সংগ্রাম ও তত্ত্বেও সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। সাহস, দৃঢ়তা, কৌশলগত নমনীয়তা ও বুদ্ধিমত্তার এক অর্পূব সমন্বয় দেখা যায়।
এরশাদ সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে তিনি প্রথম থেকেই নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছেন। সাতবার তাঁর নামে হুলিয়া জারী হয়েছে। প্রতিবারই তিনি আত্মগোপনে থেকে আন্দোলনকে সংগঠিত করেছেন। এরশাদ আমলের নয় বছরে তাঁর বাসায় পঞ্চাশ বারের বেশী মিলিটারী পুলিশ রেইড করেছিল। ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের তিনি ছিলেন অন্যতম রূপকার।
ছোট বয়েসেই রনো পড়েন বাংলা ও বিদেশী ক্ল্যাসিক্যাল সাহিত্য। কিশোর বয়সেই বাবার কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল, নজরুল, সেক্সপিয়ারের বিভিন্ন কাব্য শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো। চমৎকার আবৃত্তির পাশাপাশি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্ক ও সাহিত্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বহু পুরস্কার পান। ভালো বক্তা হিসাবেও পরিচিতি পেয়েছিলেন। ছাত্রজীবনেই তাকে বলা হতো অনলবর্ষী বক্তা। রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন এমনকি সাহিত্য ও বিজ্ঞানের উপরও তাঁর অজস্র লেখা আছে। তাঁর প্রথম বই প্রকাশিত হয় ২৪ বৎসর বয়সে “সাম্রাজ্যবাদের রূপরেখা”। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৫টি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১) শতাব্দী পেরিয়ে, ২) ফরাসী বিপ্লব থেকে আক্টোবর বিপ্লব, ৩) পুজিবাদের মৃত্যু ঘন্টা, (৪) সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সত্তর বছর, ৫) রবীন্দ্রনাথ- শ্রেণী দৃষ্টিকোন থেকে, ৬) মানিক বন্দোপাধ্যায় ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, ৬) রাজনীতির কথা প্রসঙ্গে, ৭) বিবিধ প্রসঙ্গ, ৮) গ্রাম শহরের গরীব মানুষ জোট বাঁধো, ৯) মার্কসবাদের প্রথম পাঠ, ১০) মার্কসীয় অর্থনীতি, ১১) মার্কসবাদ ও সশস্ত্র সংগ্রাম, ১২) কমিউনিস্ট আন্দোলনের তিনধারা (পুস্তিকা), ১৩) সিপিবির বন্ধুদের প্রতি (পুস্তিকা), ১৪) চীনপন্থী বন্ধুদের প্রতি (পুস্তিকা), ১৫) কোয়ান্টাম জগৎ— কিছু বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক প্রশ্ন। তাঁর কিছু কিছু বই ও প্রবন্ধ বিশেষ সময়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ২০০৫ সালে তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ “শতাব্দী পেরিয়ে” প্রথম আলোর নির্বাচনে বছরের সেরা বই হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। তাঁর কিছু লেখা বিদেশী ভাষায় অনুদিত হয়েছে। ২০১৬ সালে বই মেলায় প্রকাশিত হয় তাঁর বই: ১. মানুষের কবি রবীন্দ্রনাথ- প্রকাশক, বাংলা একাডেমি। ২. বাংলা সাহিত্যে প্রগতির ধারা (প্রথম খন্ড) প্রকাশক, ছায়াবীথি। ৩. নির্বাচিত প্রবন্ধ সংকলন (প্রথম খন্ড), প্রকাশক, অগ্রদূত। ৪. উত্তাল ষাটের দশক।
হায়দার আকবর খান রনো খুব সরল জীবনযাপন করেন। নিরহঙ্কার মানুষটি সহজ সরলভাবে মিশতে পারেন যে কোন সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে এবং সকলেই তাঁর আন্তরিকতার স্পর্শে মুগ্ধ হন। বিশেষ করে যে গরীব জনগোষ্ঠীর মধ্যে তিনি কাজ করেন, তারা তাঁকে আপন বলে গ্রহণ করতে পারে রণোর নিজস্ব চারিত্রিক ও আচরণগত বৈশিষ্টের কারণে। একমাত্র রাজনীতি ছাড়া অন্য কোন পেশাও তার ছিল না। তিনি ছিলেন সার্বক্ষনিক রাজনীতিবিদ। তবে খবরের কাগজে কলম লেখা ও প্রকাশিত বইয়ের থেকে তিনি কিছু অর্থ উপার্জন করেছেন। তিনি সাহিত্য পড়তে ভালবাসেন। বাংলা ইংরেজী সাহিত্যের বহু কবিতা তাঁর এখনও মুখস্থ আছে। সুযোগ পেলেই তিনি ভালো সিনেমা ও নাটক দেখেন। ক্রিকেট খেলায় তাঁর আগ্রহ আছে।
ধানমন্ডির পুরনো বত্রিশ নাম্বার সড়কের বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কয়েক বাড়ি পরেই রনো ভাইদের পৈত্রিক বাড়ি। ঢাকায় সাংবাদিকতার প্রথম দিনগুলোয় এরশাদ আমলে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে নানান যাতায়াতে আমি পরিবারটির এক রকম সদস্য হয়ে গিয়েছিলাম। সে বাড়িতে গেলেই ডাইনিং টেবিলে বসতে হতো খেতে হতো। একটা বিষয় আমি তখন খুব উপভোগ করতাম। তাহলো প্রতিদিন সকালে খেয়েদেয়ে মায়ের কাছ থেকে রিকশা ভাড়া হাত খরচের টাকা নিয়ে আন্দোলন করতে বেরুতেন প্রিয় রনো ভাই, প্রিয় হাজেরা আপা। এমনকি সিগারেটের টাকাও নিতেন মায়ের কাছ থেকে। আমি তাকে মজা করে বলতাম আপনিতো রণো বিপ্লব করতে বেরুতেও মায়ের কাছ থেকে রিকশা ভাড়া নেন। তৎকালীন পাঁচদলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা রনো ভাই তখন আমার কাছে সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁস। রিপোর্টার হিসাবে তাঁর কাছে নানান এক্সক্লুসিভ তথ্য পেতাম। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে টানটান উত্তেজনা। কিন্তু তিন রাজনৈতিক জোট তখনও ঢাকা অবরোধের পর কী কর্মসূচি দেবে সে নিয়ে একমত হতে পারছিলোনা। রণো ভাইর কাছে বারবার জিজ্ঞেস করছিলাম পরবর্তী কর্মসূচি কী। যে কোন রিপোর্টারের জন্যে এমন অনুসন্ধিৎসা স্বাভাবিক। এক পর্যায়ে রনো ভাই আমাকে বলেন, ফজলুল বারী, আমরা পরীক্ষার আগের রাতে পড়াশুনা করে পাশ করা ছাত্র। কর্মসূচির অভাব হবেনা। সেই ১০ নভেম্বর বুকে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’, পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে মিছিলে এসে শহীদ হন নূর হোসেন। সত্যি আর কর্মসূচির অভাব হয়নি।
অনেক দিন আমার প্রিয় রনো ভাইর সঙ্গে কথা হয়না। বেশ কয়েকবছর আগে ছোটন ভাই ফোনে বলেছিলেন রনো ভাই এত অসুস্থ যে গাড়িতে সব সময় অক্সিজেন নিয়ে চলেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় তাঁর স্কুল পড়ুয়া ফ্রক পরা মেয়ে রানা এখন বেশ বড় দুই ছেলের মা। স্বামী সংসার নিজের চাকরি নিয়ে থাকে কানাডায়। মূলত ফেসবুকে রানা’র মাধ্যমেই যোগাযোগটি টিকে আছে। রানা’র ফেসবুক টাইম লাইনে রনো ভাইর জন্মদিন দেখে লিখতে ইচ্ছে করলো। এই লেখার তথ্যসূত্রের লিংকও রানা’র দেয়া। শুভ জন্মদিন প্রিয় রনোভাই। আমাদের জন্যে আপনার মতো সৎ ত্যাগী একজন দেশপ্রেমিক বিপ্লবী নেতার আরও অনেক অনেক বেশিদিন বেঁচে থাকা দরকার। আমার প্রিয় রনোভাইর ৭৭ তম জন্মদিনে অভিনন্দন।
কৃতজ্ঞতাঃ
হাবিব ইবনে মোস্তফা ও
মোঃ হাসানূজ্জামান (বিপুল)
http://www.jessore.info/index.php?option=content&value=264&fbclid=IwAR0LFls40af-vaZW78CFGxTXiRQf8idyOfn0qIUyueThhl6JmRv61-DwG4M