ফজলুল বারী :মাউন্ট মঙ্গানুইর চূড়ায় লালসবুজ পতাকাটা কিন্তু এখনও সাহসে উড়ছেই। আগেরদিন পর্যন্ত এটা সম্ভব করেছেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। মঙ্গলবার ঝান্ডা সমুন্নত রেখেছেন এবাদত হোসেন। বাংলাদেশ এই সীমারকে এতদিন খুব কমই আমল পাত্তা দিয়েছে।
এবাদত মঙ্গলবার শেষ বিকেলের ঘটনা না ঘটালেও আমি কিন্তু লিখতাম মঙ্গানুই টেস্টে বাংলাদেশের এই দলের জন্যে মোটামুটি সর্বোচ্চ ভালো যা যা হবার তাও পাওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু নতুন পরিস্থিতি হলো স্বাগতিক নিউজিল্যান্ড দল কিন্তু অতিথি এইদলের সামনেই হারের শংকায় পড়েছে।
আদিবাসী মাউরিদের মাটিতে এটি কিউই দলের বাংলাদেশকে তেত্রিশতম মোকাবেলা। তেত্রিশতম মোকাবেলায় নিউজিল্যান্ড জিতবেই এটা কিন্তু চতুর্থ দিনের খেলা শেষে কিউই দলের ব্যাটিং কোচ নিশ্চিত ভরসা দিয়ে বলতে পারেননি।
হোষ্টদের দেশের মাটিতে এমন নড়বড়ে নিউজিল্যান্ড দলকেও বাংলাদেশ এর আগে পায়নি। নিউজিল্যান্ড হারের শংকায় পড়লেও খেলায় বাংলাদেশের জয়টা এখনও ‘যদি’তে’ নির্ভরশীল! পঞ্চম দিনের শুরুতে রস টেলরকে আউট করতে হবে। রস একজন আইল্যান্ডার বংশোদ্ভূত।
এমন অনেক দ্বীপ দেশ আছে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের প্রতিবেশী। তার মা সামোয়া দ্বীপবাসিনী ছিলেন। বাবা’র জন্ম নিউজিল্যান্ডে। রসের দ্বীপ ভাষার নাম লুটেরু রস পৌতোয়া লোট টেলর। তিনি এক সময় নিউজিল্যান্ড দলের অধিনায়কও ছিলেন।
সাইত্রিশ বছর বয়সী রস টেলর কিন্তু মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে পারলে বিপদ। জিততে হলে বাংলাদেশকে বুধবার দিনের শুরুতে রসকে আউট সহ ঝটপট কিউই দলের সবগুলো উইকেট নিতে হবে। নতুবা মঙ্গানুই টেস্টের ড্র হবার সম্ভাবনা বেশি।
বাংলাদেশকে জিততে হলে আরেকটা কাজ করতে হবে। তাহলো যতটা সম্ভব কম রানে কিউই দলের অবশিষ্ট পাঁচ উইকেট নিতে হবে। কিউই দলের রান বেশি হয়ে গেলে কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের পুরনো স্মৃতির ভয় মাথায় চেপে বসতে পারে।
আপনারা হয়তো বলবেন টেস্ট যদি না জেতে তাহলে বাংলাদেশ দলের ভালোটা হলো কিসে? বিদেশ বিভূঁইয়ে বাংলাদেশ দলের ‘ভালো খেলিয়া হারিয়া যাওয়া’ আর অভিজ্ঞতা অর্জন আর কতো! এসবও সত্য কথন। কিন্তু আয়নায় বন্ধুর মুখওতো দেখতে হবে ভাই।
এই দলটা যখন নিউজিল্যন্ড রওয়ানা হয় তখন ভাঙ্গাচোরা দলটি টেস্ট ম্যাচ জিতে যাবে এমন আশা করেছিলেন মোট কয়জন? আশা না করলেও শুরু থেকে কিন্তু এখন পর্যন্ত কিন্তু এই দলটির সবকিছু স্বপ্নের মতো এগোচ্ছে।
টস জিতে নিউজিল্যান্ড দলকে ব্যাটিং’এ পাঠিয়ে স্বপ্নের মতো বোলিং এর কারে হোষ্ট কিউইদের প্রথম ইনিংস ৩২৮ রানের মধ্যে আটকে দেয়া সম্ভব হয়। ব্ল্যাক কেপসদের প্রথম ইনিংসকে শাসন করেছে বাংলাদেশের এই দলের মেহেদি হাসান মিরাজ নেতৃত্বাধীন স্পিন শক্তি।
মিরাজের পর অনিয়মিত বোলার মমিনুলের স্পিনও কাজে দিয়েছে। দিন ভালো গেলে যা হয় আরকি। এরপর বাংলাদেশ ব্যাট করতে নেমে অভ্যাসমতো হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়েনি। শুরু থেকে এই দল যে টেস্ট মেজাজ দেখিয়ে চলেছে তা অনেকদিন ধরে দেশের ক্রিকেট বোদ্ধারা মনে থেকে চেয়ে আসছেন।
ব্যাটিং এর প্রথম দিনতো বটে, শুরু থেকে দলের পাঁচ-ছ’জন ব্যাটসম্যানের চমৎকার পারফরমেন্সে ১৩০ রানের লিড সহ গিয়ে থেমেছে দলের প্রথম ইনিংস। মাহমুদুল হাসান জয়, লিটন দাশ, অধিনায়ক মমিনুল সেঞ্চুরির আশা জাগিয়ে নিরাশ করেন। এরপর মিরাজ-ইয়াসিরের কারনে দলের লিড হয় ১৩০।
কিউই স্বাগতিকদের দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের পেসারদের দাপটের স্বাক্ষী থাকলো মাউন্ট মঙ্গানুই’র মাঠ! নিউজিল্যান্ডের পিচকে সবাই জানেন মানেন পেসারদের স্বর্গরাজ্য। এতদিন এই দাপট শুধু দেখিয়ে গেছেন ট্রেন্ট বোল্ট-টিম সউদি-নীল ওয়াগনাররা।
বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা বছরের পর বছর শুধুই কিউই পেসারদের বাউন্স সামাল দিয়ে যাবেন তা কি হয়! এবার যেন তাসকিনরা শপথ করেছিলেন বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান! তাসকিনও এবার তার ক্যারিয়ারের সেরা একটি সময়ে নিউজিল্যান্ড এসে দেশবাসীকে হতাশ করেননি।
দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুতে তাসকিন তাই কিউই অধিনায়ক টম ল্যাথামকে দিয়ে বিসমিল্লাহ করেন! এরপর বাকিটা এবাদতকে করতে দেন! বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সদস্য এবাদতের পরিশ্রম আর উইকেট পেলে সেনা কায়দায় স্যালুট দিয়ে উদযাপনের বিষয়টি নতুন নয়।
বাংলাদেশের মৌলভীবাজারের সন্তান এবাদতকে তাঁর এবারের কৃতিত্বের জন্যে মাউন্ট মঙ্গানুই’র মাঠ তাকে মনে রাখবে। এবাদতের আগুন ঝরানো দুর্দান্ত বোলিং’ স্পেলে ৩৯ রানের বিনিময় চার উইকেট প্রাপ্তির কারনে বাংলাদেশকে এখন হিসাবে রেখে কথা বলছেন সব ক্রিকেট বোদ্ধা!
মঙ্গলবার মঙ্গানুই টেস্টের তৃতীয় সেশনে এবাদতের হোষ্ট দলকে দুমড়ে মুচড়ে দেবার ঘটনার আগ পর্যন্ত কিন্তু নিউজিল্যান্ডের জয়ের ক্ষণগননা চলছিল! কারন তখনও বাংলাদেশের বাজে ফিল্ডিং আর রিভিউ অপচয়ের বিষয়টি ছিল আলোচনার শিরোনামে।
কিন্তু এবাদত ঝড়ের পর নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডের অনলাইন সংস্করনে লেখা হয়েছে ‘দ্য ব্ল্যাক ক্যাপস আর ইন ট্রাবল, বিগ ট্রাবল এজ বাংলাদেশ ক্লোজ ইন অন ফেমাস উইন! পত্রিকাটির মতে এই প্রথম নিউজিল্যান্ড দল দেশের মাটিতে বাংলাদেশের বিপক্ষে হারের শংকা নিয়ে শুরু করবে পঞ্চম দিনের খেলা।
বে ওভালের চতুর্থ দিনের শেষ বিকেলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে তেত্রিশতম চেষ্টায় এমন জয়ের সুবাস পাচ্ছে বাংলাদেশ। ব্ল্যাক ক্যাপস দলের ব্যাটিং কোচ লুক রনচিও দলের সহজ জয়ের ভরসা দিতে পারেননি।
মমিনুলরা কী এমন একটি অনুকূল সুযোগকে কাজে লাগাতে পারবেন? টিম বাংলাদেশ তেমন একটি ইতিহাস সৃষ্টির সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে। আমাদের জন্য বুধবার দিনটি শুভ হোক।