ফজলুল বারী: মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্ট নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে লিখছি। এবার দেশের ক্রিকেট নিয়ে লেখার শুরুতে নিজের একটা কথা অকপটে উল্লেখ করেছিলাম। তাহলো, খেলার আগে প্রিভিউতে দেশের দলের যা কিছু ভালো সবকিছু লিখে ফেলা! কারন অতীত অভিজ্ঞতা হলো পরে অনেক কিছু লেখা আর সম্ভব হয়না।
এমনকি মঙ্গানুই টেস্টের চতুর্থ দিন শেষে ইবাদতের জাদুকরি চার উইকেট বিজয়ের কারনে বাংলাদেশ যখন চালকের আসনে ফিরে আসে, তখনও সাবধানে ভবিষ্যত বানী করতে হয়েছে! কারন আমাদের যে ঈমান দূর্বল, অতীতের অনেক অভিজ্ঞতা ভালো নয়। কিন্তু এই দলটি আমাদের ঠকায়নি।
খেলার চতুর্থ দিন শেষেও ক্রিজে দাঁড়িয়ে ছিলেন নিউজিল্যান্ড দলের অন্যতম ব্যাটিং স্তম্ভ রস টেলর! এরা এমন মাপের খেলোয়াড় যে তাদের কেউ একজন ক্রিজ কামড়ে পড়ে থাকলে যে কোন ঘটনা ঘটতে পারে। মঙ্গলবারের লেখায় লিখেছিলাম, জিততে হলে সবার আগে রস টেলরকে আউট করতে হবে।
এবং বেশি রান না দিয়ে ঝটপট নিতে হবে সবগুলো উইকেট। আমি যেহেতু ২০১৭ সালে নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটনের বেসিন রিজার্ভ মাঠের প্রেস গ্যালারিতে ছিলাম, ২০১৬ সালে ছিলাম ভারতের ব্যাঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে, আমি তাই দেখেছি আমাদের দল কিভাবে জেতা ম্যাচ হেরে যায়!
বুধবার খেলাটা যখন শুরু হয় বাংলাদেশে তখন ভোর চারটা বাজে। তামিম ইকবাল সহ খেলা প্রেমিক বাংলাদেশিদের বড় অংশ এদিন ঘুমাননি। যারা মনে করেছেন এক ঘুম দিয়ে উঠে খেলা দেখবেন, তারা খেলাটি মিস করেছেন। কারন স্বপ্নগুলো খুব অল্প সময়েই ঘটে অথবা ভেস্তে যায়!
ওই সময়ে আরেকটা ঘটনা ঘটেছে। আম্পায়াররা ইচ্ছা করেই এ’দিন মধ্যাহ্নভোজের বিরতি দিতে দেরি করেছেন। আম্পায়াররা এটা পারেন। মধ্যাহ্নভোজের বিরতি দিতে দেরি করাতে বিষয়টি বাংলাদেশের পক্ষেই গেছে। টাইগারবাহিনী ছন্দে থাকতে থাকতে সিলগালা করেছে মঙ্গানুঈ টেস্টের জয়।
মধ্যাহ্ন বিরতির পর আমাদের অনেকের ভাতঘুম আসে। বাংলাদেশের অতীত কষ্টগুলো একটু মনে করিয়ে দিলেই বুঝবেন দলের জয় নিয়ে আমাদের ঈমান কি করে দিনে দিনে দূর্বল হয়েছে! টেস্ট স্টেটাস নিয়ে তৎকালীন ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির কাটাঘায়ে নুন ছিটানোর মন্তব্যটি এখনও মনে পড়ে।
আমরা তখন টেস্ট স্টেটাস নিয়ে আনন্দে আটখানা ছিলাম! আর সৌরভ গাঙ্গুলি তথা কলকাতার এই ভারতীয় বাবু কিনা তখন আমাদের মুখের ওপর বলেছিলেন, ‘পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত প্রস্তুতি ছাড়া টেস্ট মর্যাদা নিয়ে আপনাদের কি লাভ! এটা দিয়ে আপনারা কি করবেন?
এটাতো ভারত সহ বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর জন্য নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টিতে সহায়ক হবে’! ২০০০ সালের নভেম্বর মাসে ভারতীয় দল নবীন টেস্ট সদস্য বাংলাদেশের অভিষেক ম্যাচ খেলতে ঢাকায় আসে। নবীন দলের অভিষেকে ভারত খেলতে আসায় আমরা তখন খুশিতে কৃতজ্ঞতায় গদগদ।
শেখ হাসিনা তখনও প্রধানমন্ত্রী। সাবের হোসেন চৌধুরী বিসিবির সভাপতি। ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। দেশের ঐতিহাসিক প্রথম টেস্ট ম্যাচ উদ্বোধনে সেদিনও ক্রীড়াপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাঠে চলে গিয়েছিলেন!
প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ যখন ৪০০ রান করে তখন আমরা অনেকেই ভাবছিলাম, সৌরভ দাদা’র তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের কথার একটা জবাব দেয়া হবে! হুম! প্রথম দিন শেষে ৬ উইকেটে বাংলাদেশ ২৩৯ রান তুললে দেশজুড়ে খুশির হিল্লোল বয়।
দিনটা ছিল শুক্রবার। শনিবার লাঞ্চ পর্যন্ত আর কোন উইকেট না পড়ে রান দাঁড়াল ৩০২! কিন্তু চা বিরতির কাছাকাছি গিয়ে বাংলাদেশ ৪০০ রানে অলআউট হলেও সবাই খুশি। আমিনুল ইসলাম বুলবুল খেলেন ১৪৫ রানের এক স্মরনীয় ইনিংস।
রবিবার তৃতীয় দিন শেষে ৭ উইকেটে ভারত সংগ্রহ করে ৩৬৬ রান! কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ ৯১ রানে অলআউট হয়ে গেলে ইতিহাস গড়া আর হয়নি। এরপরও সবাই বাংলাদেশের প্রশংসা করে বলেছেন এভাবে খেলতে খেলতে নবীন দলটি একদিন টেস্ট মেজাজ অর্জন সম্ভব হবে।
২০০৩ সালে পাকিস্তানের মুলতানে প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ ২৮১ রান করে। হাবিবুল বাশার সুমন ১৫৩ বল খেলে করেন ৭২ রান। জাবেদ ওমর গোল্লা ৩৮ আর রাজিন সালেহ ৪৯ রান করেন। খালেদ মাহমুদ সুজন আর মোহাম্মদ রফিক পাকিস্তানের প্রথম ইনিংস বেঁধে ফেলেন ১৭৫ রানে!
হোষ্টদের চেয়ে ১০৬ রানে এগিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংস খেলতে নামে বাংলাদেশ! কিন্তু বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস ১৫৪ রানে গুটিয়ে যায়। ২৬১ রানের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে খেলতে নেমে ইনজামাম উল হকের ১৩৮ রানের অবিশ্বাস্য এক ইনিংসের সুবাদে জয়ের গন্ধমাখা সেই টেস্টে বাংলাদেশ ১ রানে হেরে গেলে অনেকেই কান্না থামাতে পারেননি।
২০১৭ সালে নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটনে প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ ৮ উইকেটে ৫৯৫ রান তুলে ইনিংস ঘোষনা করেছিল। উপমহাদেশের বাইরে এটি ছিল এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সংগ্রহ। সাকিব আল হাসানের ২১৭ রানের ইনিংস খেলা সে ম্যাচে বাংলাদেশ ৭ উইকেটে হেরেছিল।
কিন্তু মমিনুল হক সৌরভের নেতৃত্বাধীন এই দলটি পূর্ণ করেছে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে নিউজিল্যান্ডকে হারানোর দেশের মানুষের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন। কাপ্তান মমিনুল চুপচাপ মজাজের ছেলে। দলের জয়ক্ষুধা নিয়ে তাঁর শপথটাই জানা যাক। খেলার পরে মমিনুল বলেছেন, টেনশনে আগের রাতে তিনি ঘুমাননি!
এই দলটিতে সেভাবে দলের স্টার খেলোয়াড়রা না থাকায় একটা সুবিধা হয়েছে! স্টাররা নিজেদের জন্যে খেলে! আর মমিনুলদের এই দলটি খেলেছে দলের জন্যে। দেশের জন্যে। দলগত সাফল্য এসেছে সেশন টু সেশন খেলার জন্যে। এটাই টেস্ট জয়ের মূলমন্ত্র।
টস জিতে বল হাতে নেয়ায় মাউন্ট মঙ্গানুইর গরম আবহাওয়ার সুফলকে কাজে লাগান বোলাররা। গরমে পিচের ঘাস শুকিয়ে যাওয়ায় প্রথম ইনিংসে স্পিনাররা সুবিধা পান। কিউই দলটিকে দ্বিতীয় দিনেই অলআউট করা সম্ভব হওয়ায় খেলার নিয়ন্ত্রন বাংলাদেশের হাতে চলে আসে।
দিন যখন ভালো আসে এর কদর বুঝে সমাদর করতে হয়। বোলাররা যখন দলকে একটি ভালো অবস্থায় এনে দিয়েছেন তখন দলের ব্যাটসম্যানরা এর সুযোগকে হাতছাড়া হতে দেননি। পেসারদের স্বর্গরাজ্য নিউজিল্যান্ডের বাউন্সি উইকেট, সেখানে তাসকিন-ইবাদত -শরিফুলরা ছেড়ে কথা বলবেন কেনো!
কিউই পেসারদের তুলনায় বাংলাদেশের শরিফুল-ইবাদত -তাসকিনদের বয়স-ক্ষিপ্রতা-চৌকস বুদ্ধিমত্তা বিজয়ী হয়েছে। আসল কথা হলো একটি দল যখন দলগতভাবে খেলে তখন সে দলটিকে যে হারানো সম্ভব নয়, সে কথাই সবাইকে মনে করিয়ে দিলো বাংলাদেশের এই দলটি।
এই দলটিতে সাম্প্রতিক বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেক সমস্যা কম। করোনার কড়াকড়ি আর ভাবের কারনে অনেক কুতুব ঢাকায় থেকে যাওয়ায় দলের জন্যে সাপেবর হয়েছে। যে কারনে এই দলটি আমাদের ঠকায়নি। অতি সন্নাসীর অভাবে গাজন নষ্ট হতে পারেনি।
মমিনুল সহ পুরো দলটিকে টুপিখোলা অভিনন্দন। ‘আমরার মলইবাজারী পুয়া’ ইবাদত অথবা ইবাদত হোসেন চৌধুরীকে স্পেশাল একটি থ্যাংকস। বিমান বাহিনীর এই ছেলেটা সব সময় আমাদের স্যালুট জানায়। এবার না হয় আমরা সবাই মিলে তাকে জানালাম, স্যালুট। এটা তোমার প্রাপ্য ভাই। জয় বাংলা।