ফজলুল বারী: এরমাঝে নানান রিপোর্টে স্পষ্ট ইউক্রেন যুদ্ধের আসল খবর আসছেনা। কারন যুদ্ধটা হচ্ছে পশ্চিমা মিডিয়ার সঙ্গেও। ইউক্রেন সরকারের প্রতিরোধ যুদ্ধও এখন পর্যন্ত ধারনার চেয়েও সফল। এই প্রতিরোধ যুদ্ধ দেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা মিত্ররা নানান অস্ত্র সহায়তার ঘোষনা দিতে শুরু করেছে।
পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমগুলোর সূত্রমতে ইউক্রেনের ভিতরে এখন রাশিয়ার সৈন্য সংখ্যা ৭৫ হাজারের বেশি। বেলারুশও এই যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে। রবিবার থেকে রুশ হামলা শুরু হয়েছে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে! শুরুতে মনে হচ্ছিল সত্য-মিথ্যা প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে রাশিয়া।
ইসরাইলপন্থী ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট জেলেন্সকি রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে গেছেন এমন খবর রাশানরা প্রথম ছড়ায়। অতঃপর প্রাসাদের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ধারনকৃত ভিডিও বার্তার মাধ্যমে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট এর জবাব দিয়েছেন। একদিনে একাধিক ভিডিও বার্তা দিচ্ছেন জেলেন্সকি।
রাজধানী কিয়েভের সিটি সেন্টারে রাশান সৈন্যরা ঢুকে পড়েছে এ খবর ২৪ ঘন্টারও বেশি আগে দিয়েছিল কোন কোন পশ্চিমা মিডিয়া। কিন্তু এর কোন বিশ্বাসযোগ্য ছবি তারা দিতে পারেনি। কার্ফু চলছে রাজধানী কিয়েভে। এই কার্ফু ইউক্রেনের সরকারের দেয়া।
ইউক্রেন সরকারের পক্ষে বলা হয়েছে কার্ফুর মধ্যে বেসামরিক লোককে যদি রাস্তায় দেখা যায় তাহলে তাদেরকে শ্ত্রুপক্ষের গুপ্তচর মনে করা হবে। কিয়েভের বাসিন্দা রুশ বংশো্দভূতদের সরকার যে বিশ্বাস করছেনা, এ ঘোষনা সে ইঙ্গিতবাহী।
পশ্চিমা মিডিয়ায় দেখানো হচ্ছে ইউক্রেনীয় নারীরা পেট্রোল বোমা বানাচ্ছে। রাস্তায় অবিস্ফোরিত গোলা খুঁজে বেড়াচ্ছে ইউক্রেনীয় সেনারা, এসব ছবি প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর অস্ত্র সহায়তার ঘোষনা আসতে শুরু করেছে। কিন্তু রবিবার রুশ সৈন্যদের সাফল্যের খবরও আসা শুরু করে।
এখন পর্যন্ত যত প্রতিশ্রুতি এসেছে সে টাকায় বাংলাদেশের মতো দেশের কয়েক বছরের বাজেট করা সম্ভব হবে। এসব ঘোষনার সঙ্গে আরও স্পষ্ট হলো, পশ্চিমা মিত্ররা অস্ত্র দেবে, অস্ত্র বিক্রি করবে, কিন্তু নিজেদের সৈন্য-সামন্তসহ যুদ্ধে জড়াবেনা। যুদ্ধে জড়ানোর মার্কিন অভিজ্ঞতা ভালো নয়।
গত চারদিনে প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ ইউক্রেন থেকে পালিয়ে গেছেন। ট্রেন-বাস-কার সহ যে যেভাবে পারছেন এখনো পালাচ্ছেন। বেশিরভাগ লোক গিয়ে উঠছেন পোলান্ডে। হেঁটেও পালাচ্ছেন অনেকে। আজ বাংলাদেশের এক বন্ধুর ফেসবুক পোষ্ট দেখে তাকে ফোন করেছিলাম।
তিনি তার পোষ্টে উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের লোকজন যে বিনা ভিসায় পোলান্ডে গিয়ে ঢুকবে এটা সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য! তাকে জিজ্ঞেস করলাম এই যে এরমাঝে প্রায় দেড় লক্ষ শরণার্থী সীমান্ত পেরিয়ে পোলান্ডে গিয়ে উঠেছেন, পোলান্ড তাদের আশ্রয় দিচ্ছে, এসব কোন সরকারের সাফল্য?
যুদ্ধ লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায়না। যুদ্ধের সময় পলায়নপর মানুষকে ঠেকানো যায়না। তাদেরকে আশ্রয় দিতে হয়। সাবেক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র পোলান্ড সীমান্তে শুধু আশ্রয় নয়, স্তুপ করে শীতের কাপড় রাখা হয়েছে যার গায়ে যেটা লাগে।
রোহিঙ্গারা যখন বাংলাদেশে গিয়ে উঠে তখন তাদেরকে বাংলাদেশ সরকার দাওয়াত করে নেয়নি, ভিসাও দেয়নি। বাংলাদেশের লোকজনের পোলান্ডে পনের দিনের ভিসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভিসার ব্যবস্থা না হলেও সীমান্তে তাদের আটকানো যেতোনা। এসব পরিস্থিতিতে মানুষের ঢল ঠেকানো যায়না।
ইউক্রেন পরিস্থিতি বাংলাদেশের এখনই কিন্তু বড় একটি ক্ষতি করে ফেলেছে! তাহলো বিশ্ব শক্তির কাছে রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যু গুরুত্ব হারালো। পশ্চিমা বিশ্ব এখন ইউক্রেনীয় শরণার্থী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, ইয়েমেন সহ সব আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর কান্না আড়াল হয়ে গেলো।
এখন কে কতভাবে ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের পক্ষ নেবে তা প্রতিযোগিতারও বিষয়! অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন রবিবার অস্ট্রেলিয়ান ইউক্রেনীয়দের চার্চে একটি প্রার্থনা সভায় যোগ দিতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ঘোষনা দিয়েছেন ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের ভিসার আবেদনকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে বসে বসে খাওয়ার টাকা দিতে রাজি অস্ট্রেলিয়া সরকার। অস্ট্রেলিয়া নিতে রাজি নয়। কিন্তু রবিবার অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের মধ্যে যোগ্যদের স্কিল মাইগ্রেশনের জন্যেও অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনা করবে অস্ট্রেলিয়া সরকার।
এমন ঘোষনা তার মুখ দিয়ে এর আগে কেউ শোনেনি। আব্বা আমেরিকা কিসে খুশি হবে তা নিয়ে অস্ট্রেলিয়া সরকার অনেক ভাবে। বিরোধীদল লেবার পার্টিও সরকারের সব উদ্যোগকে সমর্থন দিয়েছে। কারন অস্ট্রেলিয়ানরা জানে এদেশের ক্ষমতায় যেতে ক্ষমতায় থাকতে আমেরিকার আর্শীবাদ লাগে।
ইউক্রেন পরিস্থিতির সুযোগে আমেরিকা তার মিত্রদের সংঘকে ঐক্যবদ্ধ করার পাশাপাশি এরমাঝে সফলভাবে রাশিয়াকে একঘরেও করে ফেলেছে। যত ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে তাতে পুতিনকে এরমাঝে সাদ্দাম-গাদ্দাফির কাতারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
একদার সোভিয়েত ইউনিয়নের যত মিত্র ছিল পুতিনের পক্ষে এখন বেলারুশ ছাড়া কেউ নেই। পুতিনের ঘনিষ্ঠ হাঙ্গেরিও এবার তার সঙ্গ ছেড়েছে। কারন অর্থনৈতিক যত নিষেধাজ্ঞা এখন পুতিনের মাথার ওপর তার পক্ষ নেয়া কেউ বাঁচবেনা।
আমেরিকার যুদ্ধবাজ তকমাটা তারা এবার সফলভাবে পুতিনের মাথায় ধরিয়ে দিয়েছে। এরপর হয়তো পুতিনের মাথার মূল্যও ঘোষনা করা হতে পারে। কাজেই আগামী কয়েকদিনে যত ঘটনাই ঘটুক, শান্তি পাবেননা পুতিন। নিরীহ ইউক্রেনীয়দের জীবনের শান্তিও তিনি ধংস করেছেন।