ফজলুল বারী: দক্ষিন আফ্রিকায় সিরিজ জয়ের পর আনন্দে ভাসছে দেশ। ক্রিকেট ছাড়া আর কিছুতে বাংলাদেশের মানুষজনের বরাতে এমন আনন্দ জোটেনা। ক্রিকেটের কারনে দেশেবিদেশে জাতীয় পতাকা ছাড়াও বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের যত জার্সি-ক্যাপ বিক্রি হয়, সেই অর্থনীতিও বিশাল।
ক্রিকেটের কারনে বিদেশের বিভিন্ন ভেন্যুতে প্রানের লালসবুজ জাতীয় পতাকা উড়তে দেখে আমাদের প্রবাসীদের যে আনন্দ-প্রতিক্রিয়া হয়, তা লিখে বোঝানো যাবেনা। বিদেশে খেলার মাঠে দলের সঙ্গে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গাইতে গাইতে আমরাও আনন্দে কাঁদি।
এখন এই আনন্দ কান্নার স্বাদ পাচ্ছেন দক্ষিন আফ্রিকা প্রবাসী বাংলাদেশীরা। তারা ভাগ্যবান। দল সেখানে তাদের সামনে সিরিজ জিতেছে। এই জয় দক্ষিন আফ্রিকায় প্রবাসী বাংলাদেশীদের সম্মান বাড়াবে।
দেশেবিদেশে ক্রিকেটের ওয়ানডে ফরমেটে আমাদের বাংলাদেশের জাতীয় দলটি এখন এমনিতে ভালো একটি দল। কখনো কখনো দুর্ধর্ষও। এখনতো আইসিসির পয়েন্ট তালিকারও শীর্ষে অবস্থান করছে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল! স্বপ্নের মতো একটি পরিস্থিতি।
এক সময় গতিতে সেরা হওয়ায় পাকিস্তানের ফার্স্ট বোলার শোয়েব আখতারের নাম হয় পিন্ডি এক্সপ্রেস। রাওয়ালপিন্ডিতে বাড়ি বলে তার এই নাম হয়েছিল। ২০০৩ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১৬১ দশমিক ৩০ কিলোমিটার গতিতে বল করেছিলেন শোয়েব আখতার।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের গতির রাজা হিসাবে নড়াইল এক্সপ্রেস নাম হয় আমাদের মাশরাফি বিন মর্তুজার। তার নেতৃত্বে ২০০৬ সাল থেকে আমাদের জাতীয় দলটি দেশে-বিদেশে জিততে শিখে যায়। দেশে যখন যে দল খেলতে আসে আমরা তাদের ছেড়ে কথা বলিনা।
সর্বশেষ শুধু পাকিস্তানের সঙ্গে সিরিজগুলো ছিল বেশি হতাশার। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্ট জয় ব্ল্যাক ক্যাপস দল সহ ক্রিকেট বিশ্বকে ঝাঁকুনি দিয়েছে টিম টাইগার্স। দক্ষিন আফ্রিকার বিরুদ্ধে সিরিজ জয়ে তিন কোটি টাকার বোনাস পাচ্ছে বাংলাদেশ দল।
যদিও এই সিরিজ জয়টি ঘোষিত বোনাস-পুরস্কারের চেয়ে অনেক অনেক দামী। দক্ষিন আফ্রিকা যাত্রার আগে সেখানে যে আমরা ওয়ানডে সিরিজ জিতে ফেলবো, এমন কেউ কল্পনায়ও ভাবেনি। এর আগে দক্ষিন আফ্রিকায় বাংলাদেশ দলের জয়ের কোন রেকর্ডও নেই।
কিছুদিন আগে ভারত-শ্রীলংকার মতো দল দক্ষিন আফ্রিকায় খেলতে গিয়ে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে। আর বাংলাদেশ তাদের মাটিতে তাদেরকে হারিয়ে করেছে সিরিজ জয়! একটা জয় পরাজয়ের পর সংশ্লিষ্ট দেশের মিডিয়ায় নানান রিপোর্ট হয়।
আইপিএল এই খেলার জয় পরাজয়ে ভূমিকা রেখেছে কিনা প্রোটিয়াস মিডিয়ায় সে প্রশ্নও রাখা হয়েছে! বলা হচ্ছে আইপিএল খেলতে যাবার ক্ষণগণনায় ব্যস্ত থাকায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে খেলায় প্রোটিয়াস দলের কিছু খেলোয়াড়ের মনোসংযোগে ঘাটতি ছিল।
ওয়ানডে সিরিজ শেষ হবার পরই আইপিএল’এ খেলতে প্রোটিয়াস বোলার কাগিসো রাবাদা ও লুঙ্গি এনগিডিরা ভারতের বিমান ধরেন। রাবাদা এবারের আইপিএল’এ কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের হয়ে খেলবেন। বলিউড তারকা প্রীতি জিনতার দল এরজন্যে তাকে ৯ কোটি ২৫ লাখ টাকায় কিনেছে।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে টেস্টম্যাচে তাই দলের গুরুত্বপূর্ণ এই সদস্যদের পাবেনা দক্ষিন আফ্রিকা দল। প্রোটিয়াস দলের অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা অবশ্য বলেছেন, বাংলাদেশের কাছে হারের এটা কোন অজুহাত হতে পারেনা। বাংলাদেশ ভালো খেলেছে।
বাংলাদেশ দলের এবারের দক্ষিন আফ্রিকা যাত্রার আগে সাকিবকে নিয়ে নানান ঘটনা ঘটেছে। আইপিএল’এ সাকিব যখন অবিক্রিত থাকলেন অথবা দল পেলেননা তখন তার স্ত্রী ফেসবুকে লিখেছিলেন, আইপিএল’এর একাধিক দলের সঙ্গে সাকিবের আলাপ চলছিল।
কিন্তু জাতীয় দলের বিদেশ ট্যুরের কারনে সাকিব তাতে রাজি হননি। বিএপিএল, আইপিএল’এ যারা সাকিবের খেলা দেখেন তারা জানেন সেখানে তার চোখ-মুখও খেলে। কারন এক বছর বছর ভালো খেললে পরের বছর ভালো পারিশ্রমিকে দল পাওয়া যায়।
শিশির যাই লিখুননা কেনো, এবার আইপিএল’এ দল না পাওয়ায় সাকিব যে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছেন, এর প্রতিক্রিয়া এসেছে দক্ষিন আফ্রিকা সফরের আগ মূহুর্তে। কারন তার যে বয়স তার আর হয়তো আইপিএল’এ খেলা হবেনা।
মানসিক ওই অবস্থায় শুরুতে দক্ষিন আফ্রিকা যেতে অনীহা দেখান সাকিব। দলের বেতনভূক্ত খেলোয়াড় হওয়া স্বত্ত্বেও বিসিবিও তার সিদ্ধান্তকে সম্মান দেখায়। শুরুতে তাকে দক্ষিন আফ্রিকা সফরের দলে রাখলেও পরে বাদও দেয়। বিসিবির পক্ষে আব্দুর রাজ্জাক একটা কঠিন কথা বলে ফেলেন!
বিসিবির নির্বাচক প্যানেলের সদস্য, সদ্য সাবেক স্পিনার বোলার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সাকিব এমন মাপের খেলোয়াড় যে তিনি নিজের থেকে সরে না গেলে বিসিবির পক্ষে তাকে সরিয়ে দেয়া কঠিন। এর পরেই মত পাল্টে দক্ষিন আফ্রিকা যান সাকিব।
এখন নানাকিছুর শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। জাতীয় দলের খেলোয়াড়রাও সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয়। সবকিছু দেখেশুনে দুবাই থেকে ভার্চুয়াল বৈঠক শুরু হয়। এরপর ঢাকায় এসে সরাসরি বৈঠকে শেষে জানানো হয়, সাকিব দক্ষিন আফ্রিকা যাবেন এবং খেলবেন।
সাকিবের মতো খেলোয়াড়ের এসব টানাপোড়েনের প্রতিক্রিয়া দলে পড়ে। দক্ষিন আফ্রিকার বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে সে প্রমানও সবাই দেখেছেন। অনেকদিন পর তিনি পেয়েছেন রানের দেখা। দলও বিজয়ী হয়েছে। ম্যাচ সেরা পুরস্কারও পেয়েছেন বাংলাদেশের ক্রিকেট পোস্টার সাকিব আল হাসান।
এরপর আবার যখন সাকিবের মা-শাশুড়ি-বাচ্চাদের অসুস্থতার খবর আসে তখন সোশ্যাল মিডিয়ার সহানুভূতি তার পক্ষে দাঁড়ায়। টিকেট ক্যান্সেল করে সাকিব যখন ওয়ানডে সিরিজ পর্যন্ত দক্ষিন আফ্রিকায় থাকতে-খেলতে চান, দেশের মানুষও তার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে দলে এবং দল জিতেছে।
এটা গেলো জাতীয় দলের একটা দিক। দল যখন হারে আমরা তখন ধারাবাহিকতার অভাবকে সামনে নিয়ে আসি। যারা এসব নিয়ে বলি-লিখি তারা আয়নায় নিজেদের দেখিনা। মানুষ হিসাবে ধারাবাহিকতার অভাব আমাদেরও আছে। বাংলাদেশ দলের সদস্যরাও আমাদের বাইরের কেউ নন।
ক্রিকেটে সেরা দেশগুলো খেলোয়াড়রা যে সব অবকাঠামোয় গড়ে-বেড়ে ওঠে বাংলাদেশ এখনও সে সবের যোজন যোজন দূরে। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিটি পাড়া মহল্লায় মাঠ-স্টেডিয়াম-ইনডোর স্টেডিয়াম-জিম সহ নানান অবকাঠামো আছে। আমাদের খেলোয়াড়রা তা বিদেশ এলে দেখেন।
বাংলাদেশের প্রতিভাগুলো হঠাৎ হঠাৎ মোস্তাফিজের মতো ব্যক্তিগত উদ্যোগে মিরাকলের মতো সৃষ্টি হয়। মিরাকল প্রতিদিন ঘটেনা। বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত নতুন ক্রিকেটার পাবার শক্তিশালী পাইপ লাইন সৃষ্টি হয়নি। নিশ্চিত করা হয়নি ক্রিকেট প্রতিভার ঝরে পড়া ঠেকানোর পদ্ধতি।
এরজন্যে একজন ক্রিকেটার দল থেকে একবার বাদ পড়লে তার দলে ফেরা কঠিন হয়। এমনকি সেই ক্রিকেটারদের প্র্যাকটিস-জিমের সুযোগ সুবিধাও কঠিন হয়ে যায়। তাদেরকে গড়তে দেশের যে বিপুল ব্যয় হয়েছে তার অপচয় হয়। কর্তাদের চেয়ার ঠিক থাকলেই তারা মনে করেন সব ঠিক!
আমাদের ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। সরকার বদলের পরপর এটির রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিবর্তিত হয়। আলী আসগর লবীর জায়গায় নাজমুল হাসান পাপন আসেন। এই সংস্থা ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতেও ক্রিকেটারদের জবাবদিহি করাতে চায়।
তাদের কোন জবাবদিহির ব্যবস্থা নেই। কর্তা সব সময় প্রধানমন্ত্রীর ফোন দেখিয়ে বোঝাতে চান সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে তাঁর সরাসরি সম্পর্ক! পৃথিবীর সব বিখ্যাত কোচ বাংলাদেশে এসে কেন টিকতে-থাকতে পারেন নাই, আজ পর্যন্ত এ নিয়ে একটা তদন্ত কমিটিই হলোনা।
এখন এক কোচ চলে গেলে আর সে রকম মান সম্মত কোচও পায়না বাংলাদেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেরা সাবেক ক্রিকেটাররা কোচ হন। কিন্তু কোচ হিসাবে বাংলাদেশে যারা আছেন তাদেরও কোনদিন জাতীয় দলের দায়িত্ব দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়নি।
জাতীয় দলের মগজের এমন নানান অসুখ না সারিয়ে শুধু তিন কোটি টাকা বোনাস দিয়ে দলের ধারাবাহিক জয়ের পরিবেশ-পরিস্থিতি সৃষ্টি হবেনা।