ফজলুল বারী: তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সর্বশেষ ইউক্রেন-রাশিয়ার আলোচনার পর অনেকে যুদ্ধ বন্ধের আশা করেছিলেন। কিন্তু ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেছিলেন, রাশিয়ার প্রতি তার আস্থা কম। আসলে যেন তাই হচ্ছে। এক মাসের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধে রাশিয়াকে ক্লান্ত মনে হলেও তারা থামছেনা।
যুদ্ধের ময়দানের বাইরে আরও নানা যুদ্ধ চলছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যেমন নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে রাশিয়াও পাল্টা ‘অবন্ধুসুলভ দেশের তালিকা’ করেছে। এই তালিকা ধরে রাশিয়া বলেছে এখন থেকে তেলের দাম তাকে রুবলে দিতে হবে। নতুবা সে বাতিল করবে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে তেল চুক্তি।
বলাবাহুল্য ফ্রান্স, জার্মানির মতো ইউরোপীয় দেশগুলোর উদ্দেশে কথাগুলো বলেছে ক্রেমলিন। যারা রাশিয়ার তেল-গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল, আবার আমেরিকার ঘনিষ্ট মিত্র। ইউক্রেন ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞার পর রাশিয়ার তেল-গ্যাস সহ রপ্তানিপণ্যের মূল্য পরিশোধ নিয়ে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।
এখন রাশিয়া প্রতিপক্ষকে বলেছে, রাশিয়ার তেল-গ্যাস কোন চ্যারিটি সামগ্রী নয় যে তোমা নিলা আর নিষেধাজ্ঞার কথা বলে দাম দিলা না! আর রাশিয়ার নতুন সিদ্ধান্তকে ব্ল্যাকমেইলিং বলেছে জার্মানি। কারন এখন রাশিয়া সরবরাহ বন্ধ করে দিলে জার্মানির মতো দেশ বিপদে পড়ে যাবে।
রাশিয়াকে চাপে ফেলতে রাশান তেল-গ্যাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আমেরিকা। রাশান তেল-গ্যাস এতদিন আমেরিকাও রপ্তানি হতো। এখন আমেরিকা নিজের সরবরাহ নিশ্চিত রাখতে প্রতিদিন বাড়তি ১০ লাখ ব্যারল তেল উত্তোলনের ঘোষনা দিয়েছে।
আমেরিকার নিজের তেল-গ্যাস আছে। কিন্তু নিজের রিজার্ভ বহাল রাখতে এতদিন দেশটি আমদানিকে প্রাধান্য দিয়ে আসছিল। চারদিকের নিষেধাজ্ঞায় অবিক্রিত জ্বালানি তেল বিক্রি করতে রাশিয়া তাদের তেলের দাম অস্বাভাবিক কমিয়েছেও। আর এর সুযোগ নিয়েছে ভারত।
নিষেধাজ্ঞা দেবার পরও ভারত দেদারসে রাশিয়ার তেল কিনছে দেখে ভয় দেখিয়েছে আমেরিকা। ভারতকে উদ্দেশ্য করে বলেছে তারাও নিষেধাজ্ঞায় পড়তে পারে। কিন্তু চাণক্য কূটনীতির দেশ ভারত এসব দেখার চেষ্টা না করে রাশান তেল কিনছেই। এতে ভারতীয় গরিব লোকজন উপকৃত হবে।
ভারতের দেখাদেখি বাংলাদেশের অনেকে এই সুযোগে কমদামে রাশিয়ান তেল কেনার পরামর্শ দিচ্ছেন! বাংলাদেশ কী ঝুঁকি নিয়ে দেখতে পারে? র্যাব ইস্যুতে একটা নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের মাথার ওপর এমনিতেই আছে। আর মনে হয়না বাংলাদেশ ঝুঁকি নিতে যাবে।
আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড, ইউরোপীয় দেশগুলোর বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক যায়। জাতিসংঘ বাহিনীতে বাংলাদেশের অংশগ্রহন সবচেয়ে বেশি। যারা র্যাব ইস্যুতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জোগাড় করেছে, তারাও নিশ্চয় বসে নেই! এই দেখেন স্যার, বাংলাদেশ আপনাদের বিরুদ্ধে এই করেছে সেই করছে!
বিদেশে প্রবাসীদের মধ্যে দেশপ্রেমিক বেশি। বদের হাড্ডিও কম নেই। সিডনির লাকেম্বার বাংলাদেশী প্রধান এলাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক রেলওয়ে প্যারেডের নাম বঙ্গবন্ধু প্যারেড হয়ে যাচ্ছিল। এই এলাকার পাকিস্তানিদের সঙ্গে নিয়ে বদলোকগুলোই তা আটকে দিয়েছে।
ভারতের বিরুদ্ধে কী আমেরিকার নিষেজ্ঞা দেয়া সম্ভব? অনেকেই তা মনে করেননা। ভারত মহাসাগর এলাকায় চীনের প্রভাব রুখতে ভারতকে হাতে রাখা দরকার আমেরিকার। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস থেকে শুরু করে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন।
তবে ইউক্রেন ইস্যুতে রাশান ভূমিকাকে আগামী নির্বাচনে কমলা হ্যারিসের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে পারেন জো বাইডেন। শোনা যাচ্ছে কমলা আগামী নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি পদে লড়তে পারেন। কারন বাইডেনের বয়স হয়েছে। তখন দলে কমলার মনোনয়ন ঠেকাতে ভারত কার্ড খেলতে পারেন বাইডেন!
ইস্তাম্বুল আলোচনায় ঠিক হয়েছিল রাজধানী কিয়েভ ও উত্তরাঞ্চলীয় শহর চেরনিহিভে সামরিক অভিযান কমাবে রাশিয়া। কিন্তু এ দুটি শহরে হামলা থামেনি। মারিয়াপুল শহরটি প্রায় ধংসই হয়ে গেছে। সেখানকারর মেয়র সপ্তাহখানেক আগে বলেছিলেন শহরটায় কমপক্ষে পাঁচ হাজার মানুষ মারা গেছেন।
এক সপ্তাহে এই মৃত্যু আরও বেড়েছে। মারিয়াপুলে আটকাপড়া লোকজনকে বেরিয়ে যেতে সময় দিয়েছে রাশিয়া। অনেকের মতে সময় দেয়া মানে রাশিয়ার নিজেরও জিরিয়ে নেবার সময় নেয়া। এর আগে রুশ সৈন্যরা মারিয়াপুলে ইউক্রেনীয় সেনাদের আত্মসমর্পনের কথা বলেছিল।
কিন্তু ইউক্রেনীয় সেনারা আত্মসমর্পন করতে অস্বীকৃতি জানায়। মারিয়াপোল হয়ে ক্রিমিয়া পর্যন্ত নিয়ন্ত্রনের নিজস্ব করিডোর চায় রাশিয়া। সে কারনে শক্ত প্রতিরোধ পেয়ে তারা যেন পোড়ামাটি নীতি নিয়েছে। কিন্তু সবাই মনে করছেন মারিয়াপোল রুশরা নিয়ন্ত্রনে নেবেই। এখানে বারবার তারা যুদ্ধে আসবেনা।
এখনও মারিয়াপোলের যারা বেঁচে আছেন, শহর ছেড়ে যাননি তারা একমাস ধরে বিধবস্ত ভবনগুলোর বেসমেন্টে বসবাস করছেন। বিদ্যুৎ পানি গ্যাস-খাদ্যবিহীন কঠিন সময় সেখানে চলছে। এরপরও আমেরিকা ও পশ্চিমের অব্যাহত অস্ত্র সহায়তা পেয়ে ইউক্রেনীয়রাও এখন অনেক চাঙ্গা।
সৈনিকদের পাশাপাশি সেখানকার বেসামরিক নাগরিকরাও গত একমাসে পুরোদস্তুর যোদ্ধা হয়ে উঠেছেন। আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশের স্বেচ্ছাসেবক যোদ্ধারাও যোগ দিয়েছেন তাদের সঙ্গে। বাইরে থেকে এই যুদ্ধকে যাই বলা হোকনা কেনো, এই যুদ্ধ এখন আর ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে সীমাবদ্ধ নেই।
সবাই মিলে যুদ্ধ করছেন আর পশ্চিমা মিডিয়ায় রিপোর্ট করাচ্ছেন, রাশিয়া পারেনা। এমন সম্মিলিত সহায়তায় চাঙ্গা ইউক্রেনীয় বাহিনী এতদিন রাজধানী কিয়েভ সহ নানান এলাকা রক্ষার কৌশল নিয়ে ব্যস্ত ছিল। রুশ আক্রমন প্রতিরোধ ছাড়াও তাদের লক্ষ্য ছিল শহরের নিয়ন্ত্রন যাতে রুশ সেনাদের হাতে চলে না যায়।
এখন তারা উল্টো পারলে রুশ সেনাদের ওপর হামলা করছে। রুশরাও গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর চারপাশ প্রায় ঘিরে রেখেছে। রুশপন্থী দনবাস এলাকায় এখন ক্রেমলিনের নজর। সংখ্যাগরিষ্ঠ রুশভাষী দনবাস এলাকায় গণহত্যার অভিযোগ তুলে রাশিয়া এবার ইউক্রেনে হামলা শুরু করে।
এতদিন ইউক্রেনে তারা গ্রাউন্ডে স্থানীয় লোকজনের সহায়তা সেভাবে না পেলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ রুশভাষী দনবাসে সেটা পাবেন মনে হচ্ছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিও এখন থেকে বলা শুরু করেছেন, দনবাসও আমাদের। ইউক্রেনের এক ইঞ্চি জমিও আমরা ছাড়বোনা।