ফজলুল বারী: হঠাৎ করে দেশটার কিছু মানুষের মধ্যে মুসলমান হবার তাগিদ সৃষ্টি হয়েছে! যেন এতদিন তারা মুসলমান ছিলেননা! বাংলাদেশের প্রথম দরকার মানুষ হবার তাগিদ। দরকার শুধু সৎ কর্মী মানুষ। নতুবা বাংলাদেশ কোনদিন উন্নত দেশ হবেনা।
ওই পুলিশের মতো গাড়লদের হঠাৎ করে যেন মনের ভিতর সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে তাদের এবং আশপাশের মানুষের জীবন বুঝি মুসলমানের জীবন নয়! বা তাদের আশেপাশের সব ধর্মের মানুষেরও মুসলমান হতে হবে। আদতে এটা একটি রোগের নাম। এই রোগটির নাম পাকিস্তান রোগ।
প্রভাষক লতা সমাদ্দারকে টিপ পরা দেখে পুলিশের যে সদস্যদের মাথা আওলাই গেছে এরপর আত্মগোপন করেছে, সে লোকটিও পাকিস্তান রোগে আক্রান্ত। কিন্তু এই ঘটনা যে দেশের সব মানুষকে নাড়া দিয়েছে তাও নয়।
দুর্নীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত দেশটার বেশিরভাগ পুরুষের উদ্যোগে বেশিরভাগ মহিলার মুখ এখন তালিবান দেশের স্টাইলের বোরকায় ঢাকা! এদের পুরুষরা যা খুশি করে বেড়ায়! নারীজাতিকে ঢেকে রাখতে হবে অবগুন্ঠনে! হায়রে, কি দেশ ছিল আমাদের! কি হয়ে গেল!
লতা সমাদ্দারের ঘটনার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় টিপ পরে প্রতিবাদী ছবিগুলো দেখে দেখে আমার দুই মহিয়সী নারীর কথা মনে পড়েছে। তাদের একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী-গবেষক সনজিদা খাতুন। অপরজন ভাস্কর্য, বীরাঙ্গনা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। তাদের টিপপরাটা চোখে লেগে আছে!
আর তাদের দেশেরই এই প্রজন্মের কিছু মেয়ে কিনা এনআইডিতে ছবি বাধ্যতামূলক না করতে মানববন্ধন করে! সাম্প্রতিক একটা সংবাদ সম্মেলনের সব মুখ ছিল তালিবান দেশের স্টাইলের বোরকায় ঢাকা! কারা কারা এসেছিল নিশ্চিত কেউ জানেনা! নুসরাতের ঘাতকরাও বোরকার আশ্রয় নিয়েছিল।
মফঃস্বলের এক কলেজের প্রথম দিনের ওরিয়েন্টেশন ক্লাসের একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়! আরেকটা ছবি-নিউজ অতি সাম্প্রতিককালের! সন্তানদের সময় দেয়া আর পর্দার বরখেলাপ হয় বলে সরকারি চাকরি ছেড়েছেন বিসিএস ক্যাডার এক নারী!
অথবা বাসের মধ্যে এক টি শার্ট পরিহিতাকে এক বোরকাওয়ালীর ধমকানো! দিনে দিনে এরা কি বেপরোয়া হয়ে পড়ছে? অথবা এটাই তাদের এসাইনমেন্ট? এই কিছুদিন আগেও এই বোরকাগুলো ইসলামী ছাত্রী সংস্থা এবং জামায়াতের মহিলা কর্মীরা বাড়ি বাড়ি দাওয়াত দিতে গিয়ে পরতেন।
বাংলাদেশের জন্মবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত-শিবির নাকি এখন দেশে নেই! কিন্তু এই ছবিগুলো প্রমান দিচ্ছে জামায়াত-শিবির এখন ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে! লতা সমাদ্দারকে নিয়ে এখন সবাই কথা বলছেন! আমিতো দেখছি এই মহিলার জীবনও এখন আর বাংলাদেশে নিরাপদ নয়।
তাদের মুসলমানিত্ব নিয়ে যে মহিলা সাহস করে প্রশ্ন তুলেছেন, গোঁড়াটা ধরে ঝাঁকুনি দিয়েছেন তাকে কি তারা ছেড়ে দেবে মনে করেছেন? কাজেই ভাত দেবার দরকার নেই আগে কুত্তা সামলান। লতা সমাদ্দারের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। নতুবা দেখবেন পথেঘাটে তাকে পিষে মেরে ফেলা হয়েছে!
অবগুন্ঠনওয়ালাদের পোশাকও তাদের অধিকার। কিন্তু দেশটা কী করে এভাবে বদলে গেলো! দেশের দুর্নীতি অনাচারের কোন প্রতিকার হলোনা। যেন হবেওনা কোনদিন! পুলিশের ইভটিজিং নিয়ে এখন আলোচনা-প্রতিবাদ চলছে। কিছুদিন আগে এক মন্ত্রীর ইভটিজিং সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে!
বিমানবালার মুখে মাস্ক পরা থাকায় মন্ত্রী তার মুখ দেখতে পারেননি। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক ভূয়া পোষ্টও হয়। ওই পোষ্টটি ভূয়া দাবি করেছেন কী মন্ত্রী? আমার চোখে পড়েনি। লতা সমাদ্দারের ঘটনা যাদের নাড়া দিয়েছে তারা কী দেশের পুলিশের অনেকের ভেতরটা চিনতে পেরেছেন?
দেশের আইজিপি বোট ক্লাবের সঙ্গে সংশিষ্ট। ইদানীং তিনি রাজনীবিদদের মতো নানা বিষয়ে বক্তব্যও রাখেন। কিন্তু তিনি যে বাহিনীর প্রধান সে বাহিনীর কোন কোন সদস্যের ভিতরটায় এখন এমন পাকিস্তান রোগের কালসাপ বাস করে, তা কী তিনি কখনো ভেবেছেন! এই ঘটনার পর কী ভেবেছেন? লজ্জিত হয়েছেন?
এখন ওই পুলিশ সদস্যকেই নাকি পাওয়াই যাচ্ছেনা! না পুলিশের ওই কালসাপ সদস্যকে পাকড়াও যারা করবেন তাদেরও বেহেস্ত হাতছাড়া হবার চিন্তা! পাকিস্তান রোগটি এমন কঠিন এক বিমার। রোগটা প্রাচীনও বটে। রোগটা এখানে ব্রিটিশরা ঢুকিয়ে দিয়ে যায়। ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে। দেশে দুর্নীতি যত বাড়ে তত বাড়ে ওই পুলিশের মতো বকধার্মিকও।
বাংলাদেশে পাকিস্তান রোগটি আবার ফিরে আসে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর! সেই জঘন্য হত্যাকান্ডের পর থেকে বেতার-টিভিতে কোরান তেলাওয়াত, হামদ-নাত এমনভাবে প্রচার শুরু হয় যেন তারা জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করে অনেক সওয়াবের কাজ করে ফেলেছেন!
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সরকারি প্রচার মাধ্যমে জাতির পিতা সহ আওয়ামী লীগ নেতাদের ইসলামী বিদ্বেষী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়! ইত্তেফাকও তখন কম যায়নি। এরপর জিয়া-এরশাদ আমলে ক্ষমতা দখলকারী, খুনি-দুর্নীতিবাজদের মুসলমান সাজার প্রতিযোগিতা সবাই দেখেছেন।
অথচ জিয়া প্র্যাক্টিসিং মুসলমান ছিলেননা। এরশাদ ছিলেন দুশ্চরিত্র। দুই আমলে দুর্নীতি সহ সামাজিক অবক্ষয় যে বেড়েছে, তা দিনে দিনে শুধুই বেড়েছে এবং বাড়ছেই। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর দেশের ধর্ম নিরপেক্ষ সংবিধান বদলে ফেলা হয়। ধর্ম নিরপেক্ষ সংবিধান দেশে আর ফিরে আসেনি।
অনেকে এসব নিয়ে আওয়ামী লীগের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করেন। কিন্তু ইসলাম বিদ্বেষী এই অপবাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তারা কি এর প্রতিবাদে তখন রাস্তায় নেমেছেন? ইসলাম বিদ্বেষী অভিযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ একুশ বছর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছে।
অতঃপর ক্ষমতায় ফিরতে এই দলের শীর্ষ নেতাদের প্রতিযোগিতা করে মুসলমান সাজার চেষ্টাও করতে হয়েছে। এই আওয়ামী লীগের সিংহভাগ নেতাকর্মীও আর চিন্তায়-দর্শনে ধর্ম নিরপেক্ষ নন। নেতাকর্মীরা যে এখন আর ধর্ম নিরপেক্ষ নয় তা নিয়ে আওয়ামী লীগও চিন্তিত নয়।
কারন দল আবার ক্ষমতাচ্যুত হলে কথায় কথায় হা-হুতাশ করনেওয়ালারাও ভাগবেন। আওয়ামী লীগও বুঝে গেছে ক্ষমতায় থাকতে হবে। সবার ওপর ক্ষমতা সত্য। এমন দেশে টিপবিরোধী সেই পুলিশরা হাওয়া হয়ে যাবেন তখন যখন এখানে সব মানুষের কাজ হবে।
যে সমাজের মানুষ কাজ নিয়ে ব্যস্ত সপ্তাহে হাজার ডলার কামাই না করলে যাদের সংসার চলেনা তারা কে কি পরলো না পরলো তা দেখার সময় পায়না। এমন দেশে এসব নিয়ে প্রশ্ন করা বর্ণবাদের মতো গুরুতর অপরাধ। রাষ্ট্রকে সে পর্যায়ে নিয়ে যেতে না পারা পর্যন্ত টিপ টিপ আন্দোলনের কোন ভবিষ্যত নেই। আবার বলি, লতা সমাদ্দারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।