একজন সিঙ্গেল মায়ের সন্তান হচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ার নতুন প্রধানমন্ত্রী

একজন সিঙ্গেল মায়ের সন্তান হচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ার নতুন প্রধানমন্ত্রী

ফজলুল বারী: একজন সংগ্রামী সিঙ্গেল মায়ের সন্তান। বাবা ইতালিয়ান, মা আলবিনো। জন্মের আগেই শিশুটির বাবা এক মোটর দূর্ঘটনায় মারা যান। এই সন্তানের নাম রাখা হয় এন্থনি আলবানিজি। দারিদ্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে করতে সরকারি সহায়তার বাড়িতে থেকে তিনি বড় হয়েছেন।
একজন ডিজেবল পেনশনার হিসাবে মায়ের সরকারি ভাতার টাকা ছিল তাদের আয়ের উৎস। সিডনির রকসের পেনকেকস রেষ্টুরেন্টেও তিনি কাজ করেছেন। এভাবে বড় হয়ে ওঠা আলবানিজি পড়াশুনা করেছেন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে। হয়েছেন অর্থনীতিতে স্নাতক। সিডনির ম্যারিকভিল এলাকা থেকে বারবার তিনি হন লেবার পার্টির এমপি।
আলবানিজি এখনও কথায় কথায় তাঁর মায়ের সংগ্রামের কথা বলেন। একজন সিঙ্গেল মায়ের সংগ্রাম তিনি জানেন। যে মা তাকে বড় হতে শিখিয়েছেন। তিনি হতে চলেছেন অস্ট্রেলিয়ার ৩১তম প্রধানমন্ত্রী। তিনি যখন লেবার পার্টির নেতা হবার জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, পোস্টাল ব্যালটে আমি তাকে ভোট দিয়েছিলাম।
অস্ট্রেলিয়ার রাজনৈতিক দলের সদস্যরা এভাবে দলের নেতা নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে পারেন। তাঁর সিঙ্গেল মায়ের সন্তান’ আত্মপরিচয় দেবার পদ্ধতিটি আমাকে স্পর্শ করেছিল। কিন্তু আলবানিজি সেই নির্বাচনে বিল শর্টনের কাছে হেরে গিয়ে দলের নেতা হতে পারেননি।
বিল শর্টনের নেতৃত্বে লেবার পার্টি সংসদ নির্বাচনে হেরে গেলে আলবানিজি নেতৃত্বে আসেন। কিন্তু প্রেফার্ড প্রধানমন্ত্রী হিসাবে স্কট মরিশনের চেয়ে অনেক পিছিয়ে থেকে তিনি নির্বাচনী দৌড় শুরু করেন। লেবার পার্টির নেতৃত্বের বেশিরভাগ সময় তিনি স্কট মরিশন থেকে পিছিয়েই ছিলেন।
সেই আলবানিজির নেতৃ্ত্বে শনিবারের নির্বাচনে লেবার পার্টির জয়ে মাধ্যমে অবসান হতে চলেছে লিবারেল-ন্যাশনাল কোয়ালিশনের ৯ বছরের শাসনের। লেবারেল-লিবারেল কোয়ালিশনের নেতা, প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিশন পরাজয় মেনে নিয়েছেন। কারচুপির মুখস্ত অভিযোগ করেননি।
বিজয়ের জন্য আলবানিজিকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন মরিশন। ফোনের জবাবে আলবানিজি স্কট মরিসনকে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেশ ও জনগণকে চমৎকার সার্ভিস দেবার জন্যে তাঁকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। এটাই অস্ট্রেলিয়ার গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।
সমর্থকদের উদ্দেশে দেয়া বক্তৃতায় স্কট মরিশন বলেছেন, তিনি দলের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়াবেন। তবে সংসদ সদস্য থাকবেন। বিদায়ী সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিটার ডাটন লিবারেল পার্টির নেতৃত্বে আসতে আগ্রহী। এর আগে পিটার ডাটনের নেতৃত্বে দলের অভ্যন্তরীন বিদ্রোহে ম্যালকম টার্নবুল প্রধানমন্ত্রীত্ব হারান।
কিন্তু পিটার ডাটন তখন নেতৃত্ব পাননি। নেতা হন স্কট মরিশন। স্কট মরিশনের কারনে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার জন্যে লিবারেল-কোয়ালিশন জোটের শক্তিশালী নেতৃত্ব ছিল। করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধেও কোয়ালিশন সরকার শক্তিশালী নেতৃ্ত্ব দেয়।
কল্যান রাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়ায় বেকারদের জব সিকার নামে সাপ্তাহিক ভাতা দেয়া হয়। চাকুরি খুঁজে পেতেও দেয়া হয় নানান সহযোগিতা। করোনার সময় কোয়ালিশন সরকার জব কিপার নামে নতুন একটি ভাতা ব্যবস্থা চালু করে।
করোনায় দেশের আন্তর্জাতিক সীমান্ত দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। এমনকি দেশের এক রাজ্যের সঙ্গে আরেক রাজ্যের সীমান্তও বন্ধ ছিল দিনের পর দিন। এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে যাতায়াতেও কোয়ারিন্টাইন ব্যবস্থা মেনে চলতে হতো। তখন নাগরিকের হতাশা দূর করে জব কিপার ভাতা।
লকডাউন ও করোনার নানান কড়াকড়ির কারনে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মালিকরা যাতে কর্মচারীদের বেতন দিতে পারেন, কর্মচারীদের চাকরি রক্ষা হয়, এরজন্যে সপ্তাহে সাড়ে সাতশ ডলারের ওই জব কিপার ভাতা চালু করা হয়।
উল্লেখ্য করোনা কালে অস্ট্রেলিয়ার বিমান কর্মীদের চাকরিও স্থানান্তর করা হয় সুপার মার্কেটে। ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে দেয়া হয় নানান প্রনোদনা । এমনকি বিশেষ প্রনোদনা দেয়া হয় শিল্পী-কলা-কুশলী সহ ক্ষতিগ্রস্ত নানান শ্রেনী-পেশার মানুষজনদের।
এরপরও সরকার দেশের সব মানুষকে খুশি করতে পারেনি। একটি ক্ষমতাসীন সরকার কখনোই দেশের সব মানুষকে খুশি করতে পারেনা। ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সারা দুনিয়ার মতো অস্ট্রেলিয়ায়ও জীবনযাপনের ব্যয় অনেক বেড়েছে। এ অবস্থায় স্কট মরিশন জনপ্রিয়তা হারাতে থাকেন।
এমন পরিস্থিতিতে ২১ মে’র নির্বাচনে লেবার পার্টি ক্ষমতায় আসছে অথবা দেশে একটি ঝুলন্ত সংসদ হচ্ছে এমন আভাস জনমত জরিপগুলোতে দেয়া হচ্ছিল। অবশেষে জরিপই সত্যি হলো। শনিবারের নির্বাচনে অস্ট্রেলিয়ান লেবার পার্টি এখন পর্যন্ত ৭২ আসনে জিতেছে।
কিন্তু সরকার গঠনের মতো আসন পায়নি। ১৫১ আসন বিশিষ্ট অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল পার্লামেন্টের নির্বাচনে জিতে সরকার গঠনের জন্যে ৭৬ আসন দরকার হয়। এখন সরকার গঠনের বাকি ৪ জন এমপির সমর্থন কিভাবে জোগাড় হবে তা এ লেখার সময় পর্যন্ত লেবার পার্টি প্রকাশ করেনি।
তবে নানা সূত্রগুলো ধারনা দিয়েছে ফলাফল ঘোষনা হয়নি এমন ৪ টির বেশি আসনে লেবার পার্টির প্রার্থীরা এগিয়ে আছেন। অথবা স্বাভাবিক হিসাবে সরকার গঠনের জন্যে লেবার পার্টিকে অস্ট্রেলিয়ান গ্রীনস এবং স্বতন্ত্র সদস্যদের সমর্থন সংগ্রহ করতে হবে।
উল্লেখ্য রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এখনও অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্র প্রধান। গভর্নর জেনারেল এখানে রানীর প্রতিনিধিত্ব করেন। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ এবং সাংবিধানিক পদে মনোনয়নপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা শপথ গ্রহনের উদ্দেশে গভর্নর জেনারেলের কাছে যান।
এন্থনি আলবানিজি আভাস দিয়েছেন শপথ গ্রহনের জন্যে সোমবার গভর্নর জেনারেলের কাছে যেতে পারেন। শনিবারের নির্বাচনের আগেই ৫৫ লাখের বেশি ভোটার অগ্রিম ভোট দেন। ২০ লাখের বেশি ভোটার পোস্টাল ভোটের জন্যে নিজেদের নাম রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন।
করোনার কারনে ৪৫ হাজার ভোটার ফোনে ভোটের জন্যে নিজেদের নাম রেজিস্ট্রেশন করলেও শেষ পর্যন্ত ফোনে ভোট দিয়েছেন ২৭ হাজার ভোটার। এসব কারনে ভোটের দিন ৮০ লাখের কিছু বেশি ভোটার ভোটকেন্দ্রগুলোতে আসেন। উল্লেখ্য অস্ট্রেলিয়ায় যেহেতু ভোট না দিলে জরিমানা হয়, সে কারনে অনেকেই অগ্রিম ভোট দিয়ে ফেলেন।

পরিবেশবাদীদের দল অস্ট্রেলিয়ান গ্রিনস জনপ্রিয়তার দিক থেকে অস্ট্রেলিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। আগে সংসদের নিম্নকক্ষে দলটির একটি মাত্র আসন থাকলেও এবারে দলটির আসন বেড়ে হয়েছে তিনটি। নীতিগতভাবে বামঘেঁষা লেবার ও গ্রীনস দুটিই কাছাকাছি দল।
গ্রীনস এর আগেও লেবার পার্টিকে সরকার গঠনে সহায়তা দিয়েছে। এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক তথা এখন পর্যন্ত দশজন স্বতন্ত্র সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের বেশিরভাগ জয়ী হয়েছেন সরকার দলীয় সদস্যদের হারিয়ে। কাজেই সরকার গঠনে স্বতন্ত্র সদস্যদের সমর্থন আদায় কঠিন হবেনা।
বিদায়ী মরিশন সরকারের ট্রেজারার জশ ফ্রাইডেনবার্গও একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার ট্রেজারার পদটি প্রধানমন্ত্রীর পরেই গুরুত্বপূর্ণ। স্কট মরিশন এর আগে ম্যালকম টার্নবুল সরকারের ট্রেজারার ছিলেন। দলের অভ্যন্তরীন বিদ্রোহে ম্যালকম টার্নবুল ক্ষমতাচ্যুত হলে মরিশন প্রধানমন্ত্রী হন।
দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী এন্থনি আলবানিজি পরবর্তী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিনেটর পেনি ওয়াং’কে নিয়ে জাপানে কোয়াড নেতাদের বৈঠকে যাবার ঘোষনা দিয়েছেন। সিনেটর পেনি ওয়াং এর ক্ষমতায়ন অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে নতুন একটি ঘটনা হবে। তিনি হবেন অস্ট্রেলিয়ার প্রথম সমকামী মন্ত্রী।
স্কট মরিশন প্রধানমন্ত্রী হবার আগে অস্ট্রেলিয়ার ইমিগ্রেশন ও বর্ডার প্রটেকশন, সামাজিক নিরাপত্তামন্ত্রী, ট্রেজারার ছিলেন। সব ভূমিকাতেই তিনি ছিলেন সফল। বিশেষ করে তিনি ইমিগ্রেশন ও বর্ডার প্রটেকশন মন্ত্রী থাকাকালে নৌকায় অস্ট্রেলিয়ায় অবৈধপথে অভিবাসী প্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়।
লেবার পার্টির কেবিন রাড ও জুলিয়া গিলার্ডের আমলে পাঁচশ’র বেশি নৌকায় ইন্দোনেশিয়া থেকে সমুদ্রপথে অবৈধ অভিবাসীরা অস্ট্রেলিয়ায় ঢুকেছেন এমন একটি অন্যতম প্রধান অভিযোগে তখনকার নির্বাচনেও লেবার পার্টি ক্ষমতাচ্যুত হয়। ওই সময় বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীও অস্ট্রেলিয়ায় ঢোকেন।
মরিশন ক্ষমতা পেয়ে নৌবাহিনীর একজন ফোর স্টার রিয়ার এডমিরাল জেনারেলের নেতৃত্বে সমুদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করায় লিবারেল-ন্যাশনাল কোয়ালিশন সরকারের আমলে নৌকায় করে অবৈধপথে কেউ অস্ট্রেলিয়ায় ঢুকতে পারেনি। ইন্দোনেশিয়ার মানবপাচারকারীদের নৌকাগুলো কিনে ফেলারও আলোচনা ছিল।
শনিবারের নির্বাচনে লিবারেল-ন্যাশনাল সরকার ক্ষমতাচ্যুত হচ্ছে এমন আভাসে শুক্রবার এমন একটি অবৈধ নৌকা অস্ট্রেলিয়ার জলসীমায় ঢোকার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু অভিবাসন ইচ্ছুক শ্রীলংকান দলটির অবৈধভাবে ঢোকার সেই প্রচেষ্টা নস্যাত করে দেয়া হয়।
এখন লেবার পার্টি ক্ষমতায় এসেছে বলে অস্ট্রেলিয়ায় আবার অবৈধভাবে নৌকায় প্রবেশ করা যাবে এমন যাতে কেউ না ভাবেন। লেবার পার্টি আবার ক্ষমতাচ্যুত হবার ঝুঁকি নেবেনা। অতীতে এ ইস্যুতে ক্ষমতা হারানোর অভিজ্ঞতায় এই লেবার সরকার এ ইস্যুতে আরও কড়া ভূমিকা নিতে পারে।