ফজলুল বারী:এন্থনি আলবানিজি অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এখন অস্ট্রেলিয়া দেশটায় আইনত বর্ণবাদ নিষিদ্ধ-দন্ডনীয় অপরাধ হলেও এংলো ব্রিটিশদের মনের মধ্যে বর্ণবাদ আছে। তবে বাংলাদেশের মতো অতোটা নয়। সেই দেশে এই প্রথম এন্থনি আলবানিজির মতো এমন একজন প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেছেন, যার শরীরে ব্রিটিশ রক্ত নেই।
পেনি ওয়াং এর মতো এমন এক মহিলা পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে গেছেন যাকে বলা হচ্ছে প্রথম ফরেন বরর্ণ ফরেন মিনিষ্টার! এই লেখা যখন তৈরি করা হচ্ছে তখন প্রধানমন্ত্রী আলবানিজি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওয়াং জাপানে অবস্থান করছিলেন। পেনি ওয়াং এর আর পরিচয় লেখা হলোনা। তাতে হুজুরা এই লেখার গায়ে দোররা মারবেন।
অথচ হুজুর অস্ট্রেলিয়ায় কম নেই। এখানে কেউ কাউকে দোররা মারা বা তা উচ্চারন করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ হলে আলবানিজিকে মন্দ বলা হতো। কারন তার বাবার সঙ্গে মায়ের বিয়েই হয়নি। আলবানিজি বড় হচ্ছিলেন একটি গল্প শুনে। গল্পটা হলো তাঁর জন্মের আগেই বাবা সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গেছেন।
কিন্তু এদেশে সহজে কেউ মিথ্যা কথা বলেনা। আলবানিজির মা’ও ছেলেকে একটি মিথ্যা গল্পের ওপর বড় হতে দেননি। তাই নিজেই একদিন ছেলেকে বলেন তাঁর বাবা’র সঙ্গে তাঁর বিয়েই হয়নি। উন্নত বিশ্বে এটি স্বাভাবিক বিষয়। বাংলাদেশে এটি দোররা মারায় বিষয় হলেও মাদ্রাসায় দোররা মারার ঘটনা কেউ শোনেনি।
আলবানিজির বাবা ছিলেন ইতালিয়ান। বড় হয়ে তিনি তাঁর সৎ ভাইবোনের সঙ্গে দেখা করতে ইতালি গিয়েছিলেন। ইতালিয়ান হওয়ায় সোনিয়া গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। আলবানিজি অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছেন। এটাই অস্ট্রেলিয়ার গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।
এখন প্রধানমন্ত্রী আলবানিজি নির্বাচনে জিতেই যা করেছেন তা বাংলাদেশে শেখ হাসিনা করলে কিন্তু এতোক্ষনে মির্জা ফখরুলের পাশাপাশি বিশেষ তিনটি পত্রিকায় দেশ গেলো দেশ গেলো’ এমন অনেক রিপোর্ট হয়ে যেতো! ঢাকার বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে দফায় দফায় হাজিরা দিতেন রেজা কিবরিয়াগং!
বাংলাদেশে নির্বাচনের পর গেজেট, সংসদীয় কমিটির বৈঠক, নেতা নির্বাচন, সংসদ সদস্যদের শপথ, সংসদ নেতা-উপনেতা নির্বাচন, মন্ত্রিপরিষদের শপথ এসব নানান পবিত্র পর্ব(!) জড়িত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও বিজিতদের কারচুপির অভিযোগ, শপথ নেবোনা, শপথ নিলাম, এসব থাকতে হয়।
অস্ট্রেলিয়ার বিজয়ী দল এখন পর্যন্ত সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। সরকার গঠন করতে ৭৬ আসন লাগে। আলবানিজি যখন প্রধানমন্ত্রীর শপথ নিয়ে জাপান চলে গেলেন তখন পর্যন্ত তাঁর দল ৭২ টি আসন পেয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে বহনের জন্যে বিশেষ একটি উড়োজাহাজ আছে।
পুরো ফলাফল ঘোষনা, সংসদ সদস্য, মন্ত্রিপরিষদের শপথের আগেই ঊপপ্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমন চারজনের শপথ পড়ে নির্বাচনের ৪৮ ঘন্টার আগেই প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উড়াজাহাজ নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে আলবানিজি উড়ে গেলেন জাপানে, কোয়াডের বৈঠকে!
এশিয়ার এই এলাকায় চীনের আধিপত্য ঠেকাতে কোয়াড আমেরিকার নতুন একটি ফোরাম। কোয়াডে বাংলাদেশকে ঢোকানোর জন্যে আমেরিকা অনেক চেষ্টা করছিল। কিন্ত্য বাংলাদেশে চীনা এত বিনিয়োগ ও অংশগ্রহণ যে ঢাকা এটা সেটা করে কাট মেরেছে। ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভালো নয়।
কোয়াডে ভারত আমেরিকাকে খুশি করতে যোগ দিলেও ইউক্রেন ইস্যুতে অবস্থান নিয়েছে মাঝামাঝি অবস্থান। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞাকে পাত্তা না দিয়ে সস্তায় রাশিয়ার তেল কিনছে। আর অস্ট্রেলিয়া এমন একটি দেশ, আমেরিকাকে খুশি করতে পারলেই খুশি।
তবে এই লেবার পার্টির সরকারের চীন বিষয়ক পৃথক খেলা-চিন্তা আছে। সাবেক মরিশন সরকারের আমলে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটলে অস্ট্রেলিয়ার খামারিরা মাংস, বার্লি সহ নানান ব্যবসা হারিয়েছেন। নির্বাচনে মরিশন সরকার হেরে যাবার খুশিতে বিশেষ অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছে চীন।
এতে খুশিতে উল্লেখ করে বলেছে এন্থনি আলবানিজি নাকি চীনা ভাষায় অনর্গল কথা বলতে জানেন! আসলে চীনা ম্যান্ডারিন ভাষায় কথা বলতে পারতেন সাবেক লেবার প্রধানমন্ত্রী কেবিন রাড। সে যাক বেইজিং এর এই অভিনন্দনে আনন্দে ভাসছেন মরিশন সরকারের আমলে ব্যবসা হারানো ব্যবসায়ীরা।
অস্ট্রেলিয়ার নতুন ভোটারদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চীনা বংশোদ্ভূত।এবিসি টিভির এক রিপোর্টে দেখানো হয়েছে চীনা বংশোদ্ভূত ভোটাররা মরিশন সরকারের বিদায়ে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। কাজেই নতুন আলবানিজি সরকার আমেরিকাকে খুশি করতে কতোটা চীন বিরোধী ভূমিকা নিতে পারবে তা এখন দেখার বিষয়। নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওয়াং চীনা ভাষা জানা এবং চীনা বংশোদ্ভূত।
কিন্তু এভাবে সব এমপিদের শপথ, মন্ত্রিপরিষদ গঠন, সংসদ বসার আগেই শেখ হাসিনা যদি নিজে শপথ নিয়েই ভারত বা বিদেশ চলে যেতেন, তা হলে দেশের হৈচৈটা কোন মাত্রায় হতো! এই নির্বাচনে অস্ট্রেলিয়া সরকার দেখিয়েছে নির্বাচন জনসাধারনের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্যে, আইনে নেই বলে পাথর হয়ে বসে থাকার জন্যে নয়।
এরজন্যে ভোটের দিনের ২৪ ঘন্টারও কম সময়ের আগে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে করোনা রোগীদের টেলিফোনে ভোট নেবার ব্যবস্থা করেছে। উল্লেখ্য পোষ্টাল ভোট ছাড়াও নির্বানের এক সপ্তাহ আগে থেকে আর্লি ভোট সেন্টারের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ায় ভোট নেয়া হয়। এরজন্যে ভোটের দিন দেখা গেলো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটার আগেই ভোট দিয়ে ফেলেছেন।