বাংলাদেশ কী ভারতের এই বেআইনি দাবির প্রতিবাদ করবে

বাংলাদেশ কী ভারতের এই বেআইনি দাবির প্রতিবাদ করবে

ফজলুল বারী:সংবাদ সম্মেলনে বিএসএফ এর ডিজি পংকজ কুমার সিং এর বক্তব্যের শিরোনাম পড়ে চমকে উঠেছি। সীমান্তে হত্যার শিকাররা সবাই অপরাধী! একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি সুস্থ্য মস্তিষ্কে  এভাবে কথা বলেন কী করে? বাংলাদেশ কী এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করবে? না সীমান্তে হত্যা চলতেই থাকবে?

বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সীমান্ত ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার বা ২ হাজার ৫৪৬ মাইল। দুই বন্ধু প্রতিম রাষ্ট্রের বড় এক প্রতিবন্ধক এই সীমান্ত হত্যা। শুধু ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৫শ’র বেশি মানুষ সীমান্তে বিএসএফ’এর গুলিতে মারা গেছেন। অথচ এই ভারতের সর্বাত্মক সহায়তায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।

প্রথম প্রথম যখন সীমান্ত হত্যা শুরু হয় তখন বলা হচ্ছিল বিএসএফ এর এসব সদস্য পাকিস্তান সীমান্ত থেকে বদলি হয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে এসেছেন! এখানে এসেও তারা মনে করেছেন এটাও বুঝি পাকিস্তান সীমান্ত! তাছাড়া বিএসএফ এর হিন্দিভাষী সদস্যরা বাংলা বোঝেনা, ইত্যাদি! খোড়া সব যুক্তি।

পাকিস্তান সীমান্তে বিএসএফ কথায় কথায় গুলি চালাতে পারবেনা। পাল্টা গুলি হবে। উত্তেজনার সৃষ্টি হবে সীমান্তে। এক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে গোলাগুলিতে ভারতের জয় নেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রাউন্ডের মানুষের সমর্থন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এরজন্যে হেরেছে।

জামায়াতে ইসলামী, রাজাকার-আল বদর-আল সামস এরা ছিল জন্মভূমির সঙ্গে বেঈমানি করা দেশোদ্রোহী। পাকিস্তানি বাহিনী তাদেরকেই বাংলাদেশ মনে করে ডুবেছে। সীমান্তে বিএসএফ এর গুলির শিকাররা অপরাধী হতে পারেন। কিন্তু আদালতের সিদ্ধান্ত ছাড়া কেউ কাউকে অপরাধী বলতে পারেনা।

বিএসএফ এর ডিজি ঢাকায় দু’দেশের বৈঠকের পর ওই সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। সেখানেই তিনি বলেছেন সীমান্তে তারা যাদেরকে গুলি করে মারেন তারা সবাই অপরাধী! মহাত্মা গান্ধীর ভারত এখন যে কত মানবতা বিরোধী বর্বর এক দেশ পংকজ কুমারের বক্তব্য যেন সেই প্রতিধ্বনি শুনিয়েছে!

এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সহ মার্কিন মাতব্বররা এরজন্যে কী কোনদিন ভারতের বিরুদ্ধে কোন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন? না সব মাতব্বরি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে! ভারত যে আমেরিকাকে পাত্তা কম দেয়, তা ইউক্রেন ইস্যুতেও স্পষ্ট হয়েছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে কমদামে রাশিয়ার তেল বেশুমার কিনছে ভারত!

বিএসএফ প্রধানের ঔদ্ধ্যত্ত্বপূর্ণ বক্তব্যের সময় বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর প্রধান এ সময় তার পাশে বসা ছিলেন। ছবিতে দেখা গেছে বিএসএফ প্রধানের বক্তব্যের সময় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাকিল আহমেদের চেহারা ভালো দেখায়নি।

তিনি সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিবাদ করলে ভালো করতেন। কিন্তু নিয়মিত বাহিনীর সদস্যরা এভাবে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ বা প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেননা। বিএসএফ ডিজি এর সুযোগটা নিয়েছেন। ঊপযুক্ত মুগুরটা তাকে দেখানো যায়নি। সীমান্তে কি হয় আমার তা নিয়ে সরেজমিন অভিজ্ঞতা আছে।

এক সময় বাংলাদেশের সীমান্তে পাকা রাস্তা পর্যন্ত বানাতে দেয়া হতোনা। ভারত এসে নিয়ে যাবে এই জুজুতে বসাতে দেয়া হতোনা একটা রাইস মিল পর্যন্ত। সীমান্তবাসী অনগ্রসর মানুষজনের কর্মসংস্থানের ছিলোনা কোন সুযোগ। তাদের অনেকে দিনে ঘুমাতেন। রাতে বুঙ্গার কাজ করতেন।

সিলেটের সীমান্তবর্তী গ্রামে চোরাচালানীর স্থানীয় নাম বুঙ্গা। এখন অবশ্য দিন পাল্টেছে। আগে সীমান্তের ভারতীয় প্রান্ত ছিল আলোয় উজ্জ্বল। বাংলাদেশ অংশ ছিল অন্ধকার। এখন আলো এদিকেও জ্বলে। ভালো রাস্তাঘাট হয়েছে। অনেকে প্রবাসে চলে যাওয়াতে সীমান্তের গ্রামগুলোতেও স্বচ্ছলতা এসেছে।

এরপরও চোরাচালানী যে হয়না তা নয়। কিন্তু চোরাচালানী শুধু সীমান্তের বাংলাদেশীরা করেনা। ভারতীয়রাও করে। দুই প্রান্তের সংযোগ সম্পর্ক ছাড়া চোরাচালানী করা যায়না। সীমান্তের বড় অংশজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে ভারতীয়রা। বিএসএফ বা ভারতীয়দের সহায়তা ছাড়া চোরাচালানী করা যায়না।

কাঁটা তারের বেড়ার এপার-ওপার কী করে চোরাচালানী চলে এর ভিডিও ক্লিপও দেখা যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। কাজেই শুধু বাংলাদেশীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। সব ভারতীয় ফেরেশ্তা না। এক হাতে তালি বাজেনা। সীমান্তে মানুষ হত্যার লাইসেন্স কেউ ভারতীয়দের দেয়নি।

সীমান্তে মানুষ হত্যা বন্ধে দু’দেশের সরকার নানা পর্যায়ে আলোচনা করেছে। যখনই এ নিয়ে হৈচৈ বেশি হয় তখনই ভারতের পক্ষে বলা হয় সীমান্তে হত্যা শূন্যের অংকে নামিয়ে আনতে দুই দেশ কাজ করছে। কিন্তু কথিত এই কাজে বাংলাদেশের কোন ভূমিকা নেই।

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপারেশন ক্লিনহার্ট-ক্রসফায়ার-এনকাউন্টারের নামে বিনা বিচারে মানুষ হত্যার অভিযোগ-বদনাম আছে। কিন্তু সীমান্তে মানুষ হত্যা এককভাবে ভারতীয়দের পাপ। ফালানীর ঘটনা নিয়ে অনেক হৈচৈ হয়েছে। বিএসএফ এবং ভারতীয় আদালত ফালানীর পক্ষে দাঁড়ায়নি।

ফালানী হত্যা, বাংলাদেশ সীমান্তে পাখির মতো মানুষ হত্যার প্রতিবাদ বিভিন্ন সময়ে ভারতীয়রাও করছেন। পংকজ কুমার সিং এর ঔদ্ধ্যত্ত্বপূর্ণ বক্তব্যেরও তারা প্রতিবাদ করবেন আশা করি। বাংলাদেশেরও উচিত শক্তভাবে এর প্রতিবাদ করা। হত্যার প্রতিবাদ করলে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়না। শক্ত হয়।