ফজলুল বারী: প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষা করেছেন অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তারা। এরমাধ্যমে পেশাদারিত্বকে উজ্জ্বল করায় তারা এখন প্রশংসায় ভাসছেন। অভিযোগটি অস্ট্রেলিয়ার সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনের বিরুদ্ধে। গত ২১ মে দেশটায় সাধারন নির্বাচনে তাঁর দল পরাজিত হয়।
অভিযোগ উঠেছে কেয়ারটেকার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের দিন প্রশাসনকে ব্যবহার করে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিলেন। সেদিন একদল শ্রীলংকান নৌকায় করে অবৈধভাবে অস্ট্রেলিয়ায় ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু নৌসেনারা নৌকাটিকে অস্ট্রেলিয়ার জলসীমার বাইরে তাড়িয়ে দেন।
স্কট মরিসনের নেতৃত্বে নৌকায় করে অবৈধপথে অভিবাসন প্রত্যাশীদের অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশ বন্ধ হয়। কিন্তু মরিসন সরকারকে ডায়ীং গভর্নমেন্ট তথা মৃত্যু পথযাত্রী মনে করে নির্বাচনের দিন ওই অভিবাসন প্রত্যাশীরা অস্ট্রেলিয়ায় ঢোকার চেষ্টা করে!
উল্লেখ্য এর আগে ২০০৭ সাল থেকে কেবিন রাড ও জুলিয়া গিলার্ডের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টির সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কমপক্ষে পাঁচশ নৌকায় কয়েক হাজার শরণার্থী অস্ট্রেলিয়ায় আসেন। অস্ট্রেলিয়ায় যত রোহিঙ্গা শরণার্থী, এরা মূলত ওই সময় দেশটায় এসেছিলেন।
তারা জেলে ছিলেন দীর্ঘদিন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার জেলখানাগুলোর রক্ষণাবেক্ষন ব্যয় অনেক বেশি। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেশ না থাকায় তাদের ডিপোর্টও করা যাচ্ছিলনা। অতঃপর কমিউন রিলিজ কর্মসূচিতে তাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়েছে।
শরণার্থী চাপে লেবার পার্টি তখন জনপ্রিয়তা হারিয়ে ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হয়। টনি এবোটের নেতৃত্বে লিবারেল–ন্যাশনাল কোয়ালিশন সরকারের সীমান্ত নিরাপত্তা মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে স্কট মরিসন শক্ত হাতে নৌকায় করে অস্ট্রেলিয়ায় ঢোকা বন্ধ করেন। ক্রমে ক্রমে মরিসন দেশের প্রধানমন্ত্রী হন।
গত ২১ মে নির্বাচনের দিন শেষ সংবাদ সম্মেলনের আগে মরিসন খবর পান, সীমান্ত রক্ষীরা আশ্রয়প্রার্থীদের একটি নৌকার প্রবেশ নস্যাত করে তাদের ফেরত পাঠিয়েছেন। উল্লেখ্য অস্ট্রেলিয়ার কোন স্থল সীমান্ত নেই। সীমান্ত বলতে জলসীমা। বিমানে আকাশপথ।
মরিসন বোঝেন ভোটারদের প্রভাবিত করার এটি মোক্ষম এক সুযোগ! তিনি কর্মকর্তাদের এ ব্যাপারে একটি বিবৃতি প্রকাশের জন্যে চাপ দেন! ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সাংবাদিকের ফোন নাম্বার, ই–মেইল এড্রেস মরিসন কর্মকর্তাদের দিয়ে অনুরোধ করেন তারা যেন খবরটি এসব সাংবাদিকদের দেন।
ফেসবুক–টুইটারেও এ ব্যাপারে পোষ্ট দিতে নির্দেশ দেন কেয়ারটেকার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এতে সাড়া দেননি। তারা প্রত্যাখ্যান ডায়ীং সরকারের প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ! কর্মকর্তারা মনে করেন প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহের পিছনে জাতীয় স্বার্থের চাইতে রাজনৈতিক স্বার্থ বেশি।
শেষ বিদায়ের আগে কর্মকর্তারা তার কথা শুনছেননা দেখে ভিন্ন কৌশল নেন স্কট মরিসন। লিবারেল–ন্যাশনাল কোয়ালিশনের প্রচার সেলের মাধ্যমে কয়েক হাজার ভোটারকে এ ব্যাপারে একটি এসএমএস পাঠানো হয়। ভোটারদের মনরক্ষার মরিয়া চেষ্টার এসএমএস!
এতে অবৈধ নৌকা রুখে দেবার ঘটনা উল্লেখ করে লেখা হয়, কোন ভুল করা যাবেনা। অস্ট্রেলিয়ার সীমান্ত সুরক্ষিত রেখে অবৈধ শরণার্থী বোঝা করদাতাদের ঘাড়ে যাতে না চাপতে পারে, সে জন্যেও কোয়ালিশন সরকারের আবার অস্ট্রেলিয়ায় ক্ষমতায় আসা দরকার।
নির্বাচনে মরিসন সরকারের পরাজয় নিশ্চিত হবার পর অভিবাসী নৌকা ইস্যু রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টার বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়ে। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুরো ঘটনাটি তদন্তের নির্দেশ দেয়। তদন্ত রিপোর্টটি সম্প্রতি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়েছে।
তদন্ত রিপোর্টে বলা হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনের অফিস বর্ডার সিক্যুরিটি কর্তৃপক্ষকে নির্বাচনের দিন বিশেষ একটি নির্দেশ দেয়। নির্দেশে সন্দেহভাজন আশ্রয়প্রার্থী নৌকার ঘটনা প্রকাশ করতে বলা হয়। কিন্তু প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা ওই পরিস্থিতিতে একটি মিডিয়া বিবৃতি প্রকাশের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে সততার পরিচয় দিয়েছেন।
রিপোর্টে বলা হয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীরা অবৈধ অভিবাসনেচ্ছুকদের নৌকা তাড়ানোর অপারেশনটি সফল করেছেন। কিন্তু ওই সময়ে বিষয়টি সাংবাদিকদের পৌঁছানো বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশের নির্দেশ উপেক্ষা করায় কর্মকর্তাদের অরাজনৈতিক চরিত্র সংরক্ষিত হয়েছে।
হোম এফেয়ার্স সেক্রেটারি মাইক পেজজুলো তদন্ত প্রতিবেদনটি তৈরি করেন। এতে বলা হয় উর্দিধারী এবিএফ(অস্ট্রেলিয়ান বর্ডার ফোর্স) ও অস্ট্রেলিয়ান প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা ওই অভিযানটি পরিচালনা করেন। কিন্তু ভোটের দিন রাজনৈতিক উদ্দেশে তা ব্যবহারের জন্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনের সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনের আগে তাদেরকে ওই চাপ দেয়া হয়।
সরকারি কর্মকর্তাদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের উদ্দেশে দেয়া হয় ওই চাপ। প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকেও খবরটি ‘নির্বাচিত সাংবাদিকদের‘ কাছে ইমেল করার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু স্বরাষ্ট্র বিভাগের সচিব মাইক পেজজুলো ২১ মে একটি নির্দেশনায় বলেন, ‘কোনো অবস্থাতেই আমরা রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহৃত হবোনা।
মরিসন সরকারের নির্বাচিত সাংবাদিকদের কাছে আমাদের পেশাদারিত্বের অভিযানের গল্পটি ছেড়ে দেবো না।‘প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে এমন একটি নির্দেশ দিয়ে নির্বাচনী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অত্যন্ত বিতর্কিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে’।
এটি একটি নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য লজ্জাজনক। তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী এক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের বাইরে গিয়ে হীন রাজনৈতিক স্বার্থে প্রশাসনকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। এ ধরনের ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে আর না ঘটে সে জন্যে তদন্তে রিপোর্টে কিছু সুপারিশ রাখা হয়।
সুপারিশে বলা হয়েছে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক কনভেনশনগুলোর প্রাসঙ্গিক দুটি বিধানগুলোর সংশোধন করার জন্য বিবেচনা করা যেতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক কনভেনশনগুলো প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীর দ্বারা বিঘ্নিত করা যাবে না। কর্মকর্তারা সবক্ষেত্রে আইনসম্মত নির্দেশাবলী অনুসরণ করতে বাধ্য।
‘জীবনের জন্য হুমকি থাকলে বা জননিরাপত্তা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত অন্য কোনো জরুরি বিষয় জড়িত থাকলে সংবেদনশীল তথ্য যা সম্ভাব্য রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ তা তত্ত্বাবধায়ক সময়কালে জনসমক্ষে প্রকাশ করা উচিত নয়’।
তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্লেয়ার ও‘নিল বলেছেন, মরিসন সরকারের মরিয়া ভূমিকাটি লজ্জাজনক, অসম্মানজনক। একটি সামরিক নেতৃত্বাধীন অভিযানকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের অপচেষ্টা অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে নজিরবিহীন।‘
‘সাবেক সরকারের দায়িত্ব ছিল অস্ট্রেলিয়ার স্বার্থকে প্রটেক্ট করা । তা না করে তারা রাজনৈতিক স্বার্থে দেশের সার্বভৌম সীমান্ত রক্ষাকারী প্রোটোকলগুলোকে ব্যবহার করেছে। তাদের কার্যক্রম এই জটিল অপারেশনের অখণ্ডতাকে ক্ষুণ্ণ করেছে। এটিকে করে তুলেছে আরও কঠিন এবং বিপজ্জনক।‘
অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ সহ প্রশাসনের অবশ্য সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ছড়ি ঘোরানো নতুন নয়। একবার পত্রিকায় ছবি ছাপা হলো প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল ভেস্ট ছাড়া একটি স্পিডবোটে বসে আছেন। কিন্তু আইন হচ্ছে স্পিডবোটের চালক সহ যাত্রীদের দৃষ্টিগোচর হয় এমন ভেস্ট পরা থাকতে হবে।
ওই ছবি দেখে এ দেশের নৌপুলিশ প্রধানমন্ত্রীর ঠিকানায় চিঠি পাঠায়। প্রধানমন্ত্রী জরিমানা পরিশোধ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বশেষ যখন অস্ট্রেলিয়া সফর করেন তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন টার্নবুল। মাস্ক ছাড়া একটি পেট্রোল স্টেশনে ঢোকায় সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী বার্নবি জয়েসকে জরিমানা করা হয়।
উপপ্রধানমন্ত্রী মাস্ক ছাড়া একটি পেট্রোল স্টেশনে ঢুকেছেন দেখে কেউ একজন পুলিশকে ফোন করেন। পুলিশ পৌঁছার আগেই জয়েসে সেখান থেকে চলে যান। কিন্তু পুলিশ সিসিটিভির ফুটেজ দেখে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে উপপ্রধানমন্ত্রীর ঠিকানায় জরিমানার চিঠি পাঠায়। জয়েসে জরিমানা পরিশোধ করেন।