ফজলুল বারী: বিরোধীদল দূর্বল। তাই প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা এখন বিরোধীদলের নেতৃত্বও ঠিক করছেন! এরশাদ যে এবার বিরোধীদলের নেতা হয়েছেন, রাজনৈতিক ওয়াকিফহালরা জানেন এটি শেখ হাসিনাই ঠিক করেছেন। এর আগে ২০১৪ সালের নির্বাচনে এরশাদের অংশগ্রহন দ্বন্দ্বে রওশন এরশাদকে তিনি বিরোধীদলের নেত্রী বানান। যেহেতু এরশাদ, রওশন এরশাদের সম্পর্ক ভালোনা তাই এবারও শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত নিতে বেগ পেতে হয়নি। কারন জাপার রওশন গ্রূপ আবার মন্ত্রিসভায়ও থাকতে চেয়েছে। জাতীয় পার্টির মন্ত্রিত্ব এড়াতে শেখ হাসিনা এবার বিরোধীদলের নেত্রীত্ব থেকে সোজা বাদ দেন। শেখ হাসিনার ইচ্ছা জেনে এ নিয়ে রওশনও প্রকাশ্যে কোন মন্তব্য করেননি। কারন শেখ হাসিনার দয়ায় রওশন এরশাদ গত পাঁচ বছর শুধু বিরোধীদলের নেত্রীই ছিলেননা, অনেক কড়িও কামাই করেছেন। এবারও রওশন যে এমপি হয়েছেন এর নেপথ্যেও শেখ হাসিনার দয়া ছিল। জাতীয় পার্টির এখন যে অবস্থা তাতে রওশনের বিরুদ্ধেও যদি আওয়ামী লীগের কোন প্রার্থী দেয়া হতো তাতে তিনি পাশ করতেননা।
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে যতগুলো আসন দেয়া হয়েছিল তাদের সবাই পাশ করেননি। সিলেটে বিশ্বনাথ-বালাগঞ্জ আসনে জাতীয় পার্টির ২০১৪ সালের এমপি প্রার্থী চতুর্থ হয়েছেন। লক্ষীপুরের রায়পুর আসনে মহাজোটের জাতীয় পার্টির প্রার্থী স্বতন্ত্র এক প্রার্থীর টাকা পেয়ে সটকে পড়াতে ওই স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন, এমন ঘটনাও ঘটেছে। এমন দেশজুড়ে নানাকাহিনী আছে। আবার উন্মুক্ত আসনে জাতীয় পার্টির কোন একজন প্রার্থীও বিজয়ী হননি। এসব ঘটনায় দেশজুড়ে জাতীয় পার্টি নামের সামরিক শাসনের গর্ভে জন্ম নেয়া দলটির বর্তমান অবস্থা বোঝা সম্ভব। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারী শাসনের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। অথচ বিএনপি-জামায়াত জোটকে মোকাবেলায় সেই জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সখ্যকে আওয়ামী ঘরানার লোকজন খুব একটা নেতিবাচক বিবেচনাতেও দেখেননা। আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরাও না। ক্ষমতার হালুয়া-রুটির আশায় জাতীয় পার্টির নেতৃত্বও এখন আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার কৃপা প্রার্থী।
শেখ হাসিনা এভাবে যে শুধু জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব ঠিক করছেন তাই নয়। বিএনপির নেতৃ্ত্ব সম্পর্কেও তিনি তাঁর পছন্দ বলে রেখেছেন। ক্ষমতার গত মেয়াদে একদিন মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বলেছিলেন তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা রহমান রাজনীতিতে এলে ভালো করবেন। সেখানে আলাপ হয়েছিল শেখ হাসিনার বেয়াই ও সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশররফ হোসেনের আত্মীয়া জোবাইদা রহমান। এসব আলোচনা মিডিয়াতেও ছাপা হয়েছে। এবার এরশাদকে বিরোধীদলের নেতা নির্বাচন শুধু নয়, কে সরকারি দল কে বিরোধীদলে থাকবেন না থাকবেন তা নিয়ে শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক একটি সিদ্ধান্ত অস্বস্তিকর টানাপোড়েনের সৃষ্টি করে ১৪ দলীয় জোটে।
কারন ১৪ দল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আদর্শিক জোট। দল হিসাবে যত ছোট হোক না কেনো ১৪ দলের সবগুলো দল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, ধর্ম নিরপেক্ষ বামপন্থী চেতনার। জাতীয় পার্টির সঙ্গে এসব দলের রাজনৈতিক আদর্শিক মিল নেই। ক্ষমতার ধান্ধাবাজিতে এরশাদ যখন ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম করেন, এই দলগুলো এর কড়া বিরোধিতা করেন। এই দলগুলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধেও সক্রিয় জড়িত ছিলো।
আওয়ামী লীগের শহীদ নূর হোসেনের মতো এই দলগুলোও এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের শহীদ নেতাকর্মী আছেন। এরশাদের পতনের পর তার বিরুদ্ধে অবৈধ ক্ষমতা দখলের মামলাটিও করেন ১৪ দলের অন্যতম শরীক দল জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত জোটের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামের সহযোগী হিসাবেই আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক সমমনা এই দলগুলোকে নিয়ে আওয়ামী লীগ ১৪ দলীয় জোট গঠন করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রেখেছেন ১৪ দলের নেতাকর্মীরা।
এই ১৪ দলকে সঙ্গে নিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের ব্যানারে বিপুল ম্যান্ডেট পান শেখ হাসিনা। ১/১১’র আগে এই মহাজোটে এরশাদের জাতীয় পার্টি ছাড়াও ডক্টর কামালের গনফোরাম, অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্প ধারা, কর্নেল (অবঃ) অলি আহমদের দলও এসেছিল। ১/১১’র পর ডক্টর কামাল, অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী, অলি আহমদের পথ ভিন্ন হয়ে গেলেও রাজনৈতিক আদর্শিক জোট হিসাবে ১৪ দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্য টিকেছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে ১৪ দলের দিলীপ বড়ুয়াকে টেকনোক্রেট মন্ত্রী করা হয়। পরে দিলীপ বড়ুয়াকে বাদ দিয়ে মন্ত্রিসভায় নেয়া হয় রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনুকে। এই দু’জন সহ ওয়ার্কার্স পার্টি-জাসদের সদস্যরা ২০০৮, ২০১৪ এবং গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেছেন। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এতো বেশি আসন পেয়েছে যে মেনন-ইনুকে আর মন্ত্রিসভায় স্থান দেয়া হয়নি। মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের আরও বাঘা অনেক নেতা বাদ পড়ায় ইনু-মেননের বাদ পড়াও চলতি রাজনৈতিক আলোচনায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ন নয়।
গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠেছে এদের রাজনীতি এবং আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কিছু বক্তব্য। ওবায়দুল কাদের প্রথম বলেছেন মন্ত্রিত্ব দেবার শর্তে এই নেতাদের মহাজোটে নেয়া হয়নি। এখন আবার বলছেন আওয়ামী লীগের আদর্শিক জোট ১৪ দল থাকবে। ১৪ দলের নেতারা সংসদে বিরোধীদলের আসনে বসলে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করলে সংসদ কার্যকর হবে ইত্যাদি। বিএনপির সদস্যদের সংসদে যোগ দেয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার মুখে শাসকদল এসব কথা বলছে বা ভাবছে বলা চলে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা এবং অসাম্প্রদায়িক ধর্ম নিরপেক্ষ নেতা রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনুদের মন্ত্রিসভায় জায়গা না দেন তাদেরকে এরশাদকে বিরোধীদলের নেতা মেনে এরশাদের নেতৃত্বে বিরোধীদলের আসনে বসতে বলা কী তাদের রাজনৈতিক আত্মহত্যার সামিল নয়? ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিজয়ী শিরীন আখতার, ফজলে হোসেন বাদশাহ ছিলেন এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেত্রী-নেতা। তাদের পক্ষে কী এরশাদকে বিরোধীদলের নেতা মেনে কাজ করা সম্ভব?
শেখ হাসিনার নেত্রীত্ব এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ভিন্ন উচ্চতায়। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর সংসদের চেহারার কারনে এখন শেখ হাসিনা যা চাইবেন তাই করতে পারবেন। কিন্তু সবার আগেতো বিবেচ্য মানুষ হিসাবে রাজনৈতিক নেতাদের সম্মান। এরশাদ বা এর নেতাকর্মীরা যে কোন সময় যে কোন ভূমিকা নিতে পারবেন। এরশাদের মৃত্যুর পর বা আগামী নির্বাচনের সময় চলতি জাতীয় পার্টির বর্তমান অনেক এমপি-নেতা বিএনপিতেও যোগ দিতে পারেন। কিন্তু এটা কী রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, মাইনুদ্দিন খান বাদল, শিরীন আখতার বা ফজলে হোসেন বাদশা’র পক্ষে সম্ভব? বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ন জয়ন্তী অথবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনেও ইনু-মেননদের লাগবে।
এরশাদের দলের লোকজনকে এসব কাজে মনের দিক দিয়ে পাওয়া যাবেনা। কারন জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় থাকতে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আস্কারা বন্ধ করেনি। যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমতায়ন জাতীয় পার্টিও করেছে। আরেকটি দিক হয়তো অনেকে ভুলে বসে আছেন। তাহলো, যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি যখন চারদলীয় জোট গঠন করে তখন এরশাদের জাতীয় পার্টিও সেখানে ছিল। এরশাদ বিশ্বস্ত না হওয়ায় বিএনপি জাতীয় পার্টিকে ছেড়েছে, কিন্তু জামায়াতকে ছাড়েনি।
এখন ক্ষমতাটি এক তরফা হয়ে যাওয়াতে এই শেখ হাসিনা ভিন্ন শেখ হাসিনা। তাকে একটা অনুরোধ করছি। তাহলো, মুক্তিযোদ্ধা এবং ধর্ম নিরপেক্ষ নেতা হাসানুল হক ইনু-রাশেদ খান মেনন-মাইনুদ্দিন খান বাদলদের এরশাদের নেতৃত্ব গ্রহনে বাধ্য করবেননা বা চাপ দেবেননা। মুক্তিযোদ্ধা এই নেতারা সংসদে পৃথক একটি গ্রূপ করে সংসদে পৃথক স্বতন্ত্র একটি অবস্থান নিয়ে বসতে থাকতে পারেন কিনা তা ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি। তাদের দল এখন যত ছোট না কেনো তাদের মর্যাদার বিষয়টি যেন কেউ ভুলে না যান। রাজনৈতিক মর্যাদাহীন মানুষ বাঁচেনা।