যেভাবে শপথ নেয় বাংলাদেশের প্রথম সরকার

যেভাবে শপথ নেয় বাংলাদেশের প্রথম সরকার

ফজলুল বারী: একাত্তরের মুজিবনগর সরকার নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়েছে! সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের ছেলে সোহেল তাজের বক্তব্য উজ্জ্বল এখন সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেই সরকারকে প্রথম সরকার হিসাবে উল্লেখ করে এর স্বীকৃতি চাইছেন তাজউদ্দিন পুত্র।

মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের প্রথম সরকার, এই কথাগুলো সরকারি নথিপত্রে নেই। সোহেল তাজ কিছুদিন আগে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের দিনকে প্রজাতন্ত্র দিবস ঘোষনার দাবি জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে মানিক মিয়া এভিনিউ থেকে মিছিল করে গণভবনে গিয়ে স্মারকলিপি দিয়েছেন।

এমন ঘোষনা আসবে মনে হয়না। উজ্জ্বল থাকবেন শুধু একজন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এক ধরনের ঠান্ডা লড়াই নতুন নয়। বিএনপি নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের দল দাবি করে কিন্তু ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, মুজিবনগর দিবস এসব পালন করেনা!

অথচ দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ছিলেন মুজিবনগর সরকারের নিয়োগকৃত সেক্টর কমান্ডার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুজিবনগর এসব মুছে দিয়ে পাকিস্তান হয়, বাংলাদেশ নয়। আওয়ামী লীগেরও মাথায় ঢুকেছ  কোথাও কাউকে ক্রেডিট দেয়া যাবেনা!

অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সবাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ও প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করেছেন। সবাইকে নিয়ে সবার মাথার মুকুট তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। মুজিবনগর সরকারটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের বিশেষ সময়ের সরকার।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে সরকারটি গঠন করা হয়। সেখানেই প্রকাশ করা হয় স্বাধীনতার ঘোষনাপত্র। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ছিল সেই সরকারের শ্লোগান।

একাত্তরে তাজউদ্দিন আহমদ, ব্যারিষ্টার আমির উল ইসলামের সঙ্গে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বৈঠকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের পরামর্শ হয়। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর থেকে তখন প্রতিদিন লাখ লাখ শরণার্থী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছিলেন।

তাজউদ্দিন আহমদ-ব্যারিষ্টার আমির উল ইসলাম কলকাতা পৌঁছলে তাদেরকে ইন্দিরার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যে দিল্লী নিয়ে যাওয়া হয়। ভারত তখনও রাজনৈতিক কূটনৈতিক ভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংশ্লিষ্ট হবার সিদ্ধান্ত নেয়নি। বিশ্বকে জানাচ্ছিল মানবিক কারনে তারা শুধু শরণার্থীদের আশ্রয় দিচ্ছে।

এরজন্যে ইন্দিরার সঙ্গে তাজউদ্দিন-আমির উল ইসলামের সাক্ষাৎ গোপন রাখতে তাদেরকে সাধারন প্যাসেঞ্জার ফ্লাইটে দিল্লী না নিয়ে সামরিক বাহিনীর একটি মালবাহী বিমানে করে নেয়া হয়। সেই সাক্ষাতে তাজউদ্দিনরা বাংলাদেশ পরিস্থিতি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেন।

শরণার্থীদের আশ্রয় দেবার জন্যে ভারতীয় সরকার ও জনগনকে কৃ্তজ্ঞতা জানিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার অনুরোধ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তখন বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে একটি প্রবাসী সরকার গঠনের পরামর্শ দেন।

দিল্লী বৈঠকের অনুসরনে ভারতে আওয়ামী লীগের যে সব এমপিএ, এমএনএ গিয়ে পৌঁছেছেন তাদের একটি বৈঠক ডাকা হয় ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা সার্কিট হাউসে। বাংলাদেশের ছাত্র-শ্রমিক-রাজনৈতিক সামরিক নেতৃবৃন্দের বেশিরভাগ ত্রিপুরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন।

কুমিল্লার কসবা সীমান্তে ছাত্রলীগ নেত্রী মমতাজ বেগমের বাড়িতে আশ্রয় নেন কর্নেল ওসমানী।  সত্তুরের নির্বাচনে তিনি এমএনএ নির্বাচিত হন। কিন্তু তিনি ভারতে যেতে ভয় পাচ্ছিলেন। কারন ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে তিনি পাকিস্তানের হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন।

ওসমানী ভয় পাচ্ছিলেন ভারতীয়রা চিনতে পারলে তাকে গ্রেফতার করতে পারে। তখন তাকে অভয় দিয়ে বলা হয় ভারতে তাকে এমএনএ হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হবে। পাকিস্তানি বাহিনীর সাবেক অফিসার হিসাবে নয়। এমন অভয়বানীতে আশ্বস্ত হবার পর ওসমানী ভারতে যেতে রাজি হন।

আগরতলা সহ ত্রিপুরার ভারতীয় বাঙালিদের বেশিরভাগের পূর্ব পুরুষ ছিলেন বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলের। পূর্ব পুরুষের দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের তাই তারা নানাভাবে সহায়তা করছিলেন। ভারতীয় বার্তা সংস্থা পিটিআই ও আনন্দবাজার পত্রিকার আগরতলা সংবাদদাতা ছিলেন সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্য।

তাঁর স্ত্রী গৌরী ভট্টাচার্য ছিলেন সরকারি হাসপাতালের স্টাফ নার্স। তাঁর একতলা টিনের চালের সরকারি বাড়িটি হয়ে ওঠে সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়া বাংলাদেশী নেতৃবৃন্দের মিটিং পয়েন্ট। প্রবাসী সরকার গঠন ও  একটি ঘোষনাপত্র তৈরির বৈঠক হয় আগরতলা সার্কিট হাউসে।

সেই বৈঠকেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঘোষনাপত্র চূড়ান্ত হয়। প্রবাসী নেতৃবৃন্দের বৈঠকের সিদ্ধান্ত প্রচারে তখন সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তখনকার ভারত এবং ত্রিপুরা রাজ্য প্রযুক্তিতে অনেক পিছিয়ে ছিল। ফোন, টেলিগ্রাম, টেলিপ্রিন্টারে খবর পাঠাতে হতো।

আগরতলা বৈঠকের খবর প্রচারের পর বিশ্ব জানতে পারে নতুন একটি দেশের জন্ম সংবাদ। বাংলাদেশ তার নাম। তখন গোপন একটি সিদ্ধান্ত হয় ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের শপথ হবে চুয়াডাঙ্গায়। ডাঃ আসাবুল হক ছিলেন চুয়াডাঙ্গা আওয়ামী লীগের সভাপতি।

এলাকার লোকজনের কাছে তিনি হ্যাবা ডাক্তার নামে পরিচিত ছিলেন। তাকে শপথ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়। কিন্তু তাঁর এক ভুলের কারনে বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠানস্থলের গৌরব থেকে বঞ্চিত হয় চুয়াডাঙ্গা। কথায় কথায় একজন বিদেশি সাংবাদিককে শপথ অনুষ্ঠানের কথা বলে দেন ডাঃ আসাবুল হক। ওই সাংবাদিকের খবর প্রচার হয়ে গেলে পাকিস্তানিরা চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয়।

এরপর শপথ অনুষ্ঠান আয়োজনের নতুন দায়িত্ব দেয়া হয় চুয়াডাঙ্গা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সহসভাপতি এডভোকেট ইউনুস আলীকে। ইউনুস আলী তাঁর সহযোগীদের নিয়ে মেহেরপুরের  বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননের স্থানটি নির্বাচন করেন।

সীমান্ত লাগোয়া এলাকাটি নির্বাচনের পর আরেক সমস্যা দেখা দেয়। এ ধরনের একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের চেয়ার-টেবিল বা অবকাঠামো সে গ্রামে ছিলোনা। গ্রামের লোকজনের বাড়িঘর থেকে চৌকি এনে বানানো হয় মঞ্চ। চেয়ার যেগুলো পাওয়া যায় সেগুলোর কোনটির পা অথবা হাতল ভাঙ্গা।

এমন চেয়ারগুলোর নীচে ইট রেখে তা বসার উপযোগী করা হয়। নতুন সরকারকে গার্ড অব অনার দেবার জন্যে আনসারের কয়েক সদস্যকে নিয়ে গড়া হয় একটি দল। তখন সমস্যা দেখা দেয় বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ তা কে গাইবে।

তখন জানা যায় সীমান্তের ওপারের কৃষ্ণনগরের একটি মেয়ে গানটি জানে। খবর পাবার পর লোক পাঠিয়ে অনুষ্ঠানের আগের রাতে সেই মেয়েটিকে নিয়ে আসা হয়। মা সহ আসা ক্লাস এইটের ছাত্রী মেয়েটি আগের রাতে এসে গ্রামের এক বাড়িতে থাকেন।

১৬ এপ্রিল বিকেলে কলকাতা প্রেসক্লাবে আসেন ব্যারিষ্টার আমির উল ইসলাম। সেখানে গিয়ে তিনি বলেন পরের দিন বাংলাদেশ সরকারের একটি অনুষ্ঠান হবে। যারা যেতে চান তারা যেন সকাল ৬ টার মধ্যে প্রেসক্লাবে উপস্থিত থাকেন। গাড়িতে করে তাদের অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে যাওয়া হবে।

এ কথা বলেই প্রেসক্লাব থেকে চলে যান ব্যারিস্টার আমির উল ইসলাম। কিসের অনুষ্ঠান কোথায় অনুষ্ঠান তা খোলাসা হয় না। মুহুর্তে খবরটি চাউর হয় গোটা মিডিয়া পাড়ায়। মিডিয়াও তখন এত বেশি না। হাতে গোনা উত্তেজনায় অনেক সাংবাদিক রাতে প্রেসক্লাবে থেকে যান।

সকালে সেখানে কয়েকটি গাড়ি আসে। গাড়ির বহর রওয়ানা হয় সীমান্তের উদ্দেশে। কলকাতায় থাকা বিদেশি সাংবাদিকরাও বহরে যোগ দেন। এদিকে বিশেষ একটি সতর্কতা নেয়া হয় বৈদ্যেরনাথতলায়। সাংবাদিকদের আস্থা অর্জনের জন্যে অভিনয়েরও আশ্রয় নেয়া হয় বলা চলে।

শপথ নিতে মন্ত্রিসভার সদস্যরা আগেভাগে সে গ্রামে চলে আসেন। বৈদ্যেরনাথতলার আম্রকানেনের জঙ্গল এলাকায় একটি ইপিআর ক্যাম্প ছিল বাংলাদেশের দখলে। মন্ত্রিসভার সদস্যদের সেই ইপিআর ক্যাম্পে নিয়ে বসিয়ে রাখা হয়।

সে কারনে বিদেশি সাংবাদিকরা দেখেন বাংলাদেশ মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা বাংলাদেশের ভিতর থেকে আসছেন। শপথ অনুষ্ঠান শেষে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা আবার হেঁটে ইপিআর ক্যাম্পের দিকে চলে যান। বিদেশি সাংবাদিকরা দেখেন বাংলাদেশের মন্ত্রীরা বাংলাদেশের ভিতর চলে যাচ্ছেন।

এলাকাটি  বিপদজ্জনক,  পাকিস্তানি বাহিনী যে কোন চলে আসতে পরে বলে বিদেশি সাংবাদিকদের কলকাতা নিয়ে যাওয়া হয়। সাংবাদিকরা চলে যাবার পর বাংলাদেশ মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরাও ভারত রওয়ানা হন। তারা চলে যাবার আধঘন্টার মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা পৌঁছে যায় বৈদ্যনাথতলায়।

চরম আক্রোশে তারা তছনছ করে অনুষ্ঠানস্থল ও গোটা গ্রাম। কিন্তু ততক্ষনে বিশ্ব জেনে গেছে নতুন বাংলাদেশ সরকার শপথ নিয়ে ফেলেছে। সেই থেকে বৈদ্যেরনাথতলার নাম হয় মুজিবনগর। বাংলাদেশের প্রথম সরকারের নাম হয় মুজিবনগর সরকার।