অনলাইন ডেস্ক: ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার বিচারকাজ শেষ হলেও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের অধিকাংশ এখনো রয়েছে দেশের বাইরে।
প্রায় ৩৫ বছর পর এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সরাসরি জড়িত সাবেক সেনা সদস্যদের দণ্ড দেয়া হলেও বেসামরিক কোন ব্যক্তির বিচার হতে দেখা যায়নি।
বিশ্লেষকরা একমত যে, এটি নিছক হত্যাকাণ্ড নয়, বরং এর পেছনে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। হত্যা মামলার রায়েও যেই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা সংক্ষিপ্ত আকারে উল্লেখ রয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্টে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত সরকার হত্যাকারীদের বিচার না করার বিধান রেখে জারি করে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ।
দুই দশকেরও পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হয় এবং তার চূড়ান্ত রায়ে ১২ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয়। দণ্ডপ্রাপ্ত এই ১২ জনের সবাই তৎকালীন মধ্যম সারির সেনা কর্মকর্তা যারা সরাসরি হত্যাকাণ্ড এবং পরিকল্পনায় অংশ নিয়েছিল।
কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের যে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল এবং তৎকালীন রাজনীতিকদের সাথে সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি বিচারকাজ শেষ হওয়ার পরও অনেকটা অস্পষ্ট রয়ে গেছে।
“এই হত্যাকাণ্ডের যে দুটো ডাইমেনশন, একটা অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং আরেকটি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এর কোনটাই কিন্তু এই বিচারে উঠে আসেনি। দেশের প্রচলিত আইনে আর দশটা হত্যাকাণ্ড যেভাবে হয়ে থাকে সেভাবেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে”। বলেন সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান।
১৯৯৬ সালে ১৫ই অগাস্টের হত্যাকাণ্ডের যে মামলা দায়ের করা হয় সেখানে সেনা সদস্যদের বাইরে যে কয়জনকে আসামি করা হয়েছিল তাদের মধ্যে মূল একজন খন্দকার মোশতাক আহমেদসহ তিনজন আগেই মারা গিয়েছিল, যেকারণে তাদের নাম আগেই মামলা থেকে বাদ দেয়া হয়।
মামলাটির প্রধান কৌশুলী ছিলেন বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
“এই মামলায় যারা দণ্ডিত হয়েছেন তাদের অনেকেই ষড়যন্ত্র এবং হত্যা করার জন্য দণ্ডিত হয়েছেন। সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে যারা হত্যা এবং ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত ছিলেন সেটা প্রমাণিত হয়েছে এবং তাদের সাজা দেয়া হয়েছে”। বলেন মি. হক।
১৯৯৮ সালে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে নিম্ন আদালত থেকে রায় দেয়া হলেও পরবর্তীতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার এবং সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দীর্ঘ সময় উচ্চ আদালতে আপিলের কার্যক্রম ঝুলে থাকে।
পরবর্তীতে ২০০৯ সালে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে উচ্চ আদালত চূড়ান্ত রায় দেয়। ২০১০ সালের ২৮ শে জানুয়ারি ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।
দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ৬ জন এখনো যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। একজন মারা গেছেন।
হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয় সেখানে শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রীসভার এবং বাকশালের অনেকেও যোগ দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন মাহবুবে আলম চাষী এবং তাহের উদ্দিন ঠাকুরসহ আরো অনেকে।
আওয়ামীলীগের সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ বলছেন, অনেকেই হয়তো চাপের মুখে সেখানে যোগ দিয়েছিলেন। তবে সামরিক এবং বেসামরিক যারা এর সাথে জড়িত তাদের যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল তা শেষপর্যন্ত সফল হয়নি।
“যেই দেশী এবং বিদেশী শক্তি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হয়েছে, আন্তর্জাতিকভাবে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে স্বাধীনতাবিরোধীদের সাহায্য করেছে, তারা যৌথভাবে ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে যাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ধ্বংস হয়ে যায়”। বলেন মি. আহমেদ।
তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, ১৫ই অগাস্টের হত্যাকাণ্ডের পরবর্তীকালে যারা সরকার গঠন করেছে এবং হত্যাকারীদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করেছে তারা এর সাথে জড়িত।
গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলছেন, ১৫ই অগাস্টের হত্যাকাণ্ডের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী অবস্থা বিবেচনা করলে এর সাথে বেসামরিক একটি অংশের সম্পর্ক রয়েছে বলে বোঝা যায়।
“ঐদিনই এ ঘটনাটি ঘটবে এবং শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করা হবে এইভাবে হয়তো অনেকে চিন্তা করেন নাই। কিন্তু পরিবর্তন একটা হবে সেটা অনেকেই মনে মনে ভাবছিলেন। আপনি যদি পরের দিনের পত্রিকার সম্পাদকীয় দেখেন, সবাই সেটাকে স্বাগত জানিয়েছিল। সুতরাং এটা হুট করে কয়েকজন মেজর এবং কিছু সোলজার মিলে এটা করেছে সেটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়”।
মি. আহমদের মতে, পরবর্তীতে এই হত্যাকাণ্ডের সাথে রাজনীতিকদের যোগশাযশের বিষয়ে যথেষ্ট গবেষণা বা তদন্ত হয়নি। হত্যা মামলার রায়ে ষড়যন্ত্রের কথা বলা হলেও এর পেছনে ঠিক কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল এবং রাজনীতিকরা ঠিক কিভাবে এই ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত সেবিষয়টি মামলায় উঠে আসেনি।
খন্দকার মোশতাকের সরকার ক্ষমতায় ছিল প্রায় আড়াই মাস। এই সময়ের মধ্যে তারা হত্যাকারীদের দায়মুক্তির অধ্যাদেশ জারি করে, কিন্তু তাদের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কি ছিল তা অনেকটা অস্পষ্টই রয়ে গেছে।
“মেজর ডালিম রেডিও স্টেশন দখল করে বাংলাদেশকে একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা দেন কিন্তু এনিয়ে কোন পূর্ব আলোচনা বা পরিকল্পনা দেখা যায় না। পরদিন জুলফিকার আলী ভুট্টোও ইসলামিক রিপাবলিক অফ বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানান এবং এই ধারণা সৌদি আরবকেও দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র থেকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র তৈরির ধারণা টেকেনি এবং বিস্ময়কারভাবে খন্দকার মোশতাকও সেটা আর চেষ্টা করেননি”। বলেন সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান।
আওয়ামীলীগের নেতারাও মনে করেন যে হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কিছু বিষয় পূর্ণাঙ্গভাবে উঠে আসেনি। তবে এক্ষেত্রে তারা জোর দিচ্ছেন আন্তর্জাতিক যোগশাযশের দিকে।
আওয়ামীলীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ বলছেন, এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে আরো কারা ছিলেন এবং কি উদ্দেশ্যে ছিলেন সেটি নিয়ে আরো তদন্ত হতে পারতো।
“হত্যাকাণ্ডে সরাসরি যারা জড়িত তাদের বিচার আমরা করেছি। আমরা একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে পারতাম যদি আমরা একটি বেসামরিক তদন্ত কমিটি করে এই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র ছাড়াও আরো কারা নেপথ্যে আছে এটা যদি আমরা বের করতে পারতাম তাহলে জাতি উপকৃত হতো।”
১৯৭৫ সালে আওয়ামীলীগের বাইরে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী বড় কোন দল না থাকলেও বেশ আগে থেকেই দীর্ঘদিন যাবত সরকার পতনের আন্দোলন করে আসছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ।
যদিও দলীয়ভাবে জাসদ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে চেয়েছিল এমনটা মনে করেন না গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ। তবে তিনি মনে করেন, হত্যাকাণ্ডের পরপরই কর্নেল তাহেরের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
মি. আহমেদ মনে করেন, পরবর্তীতে আওয়ামীলীগ হত্যাকাণ্ডের বিচার করলেও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের দিকটি তারা অনেকটা এড়িয়ে গেছেন।
“আড়াই মাস যারা খন্দকার মোশতাকের সরকারে যোগ দিয়ে আড়াই মাস ছিলেন, তাদের অনেকে বিদেশেও গিয়েছিলেন। এতে মনে হয় যে তাদের সবাইকে যে জোর করে নেয়া হয়েছিলো যে সেটা না। জোর করে নিলে বিদেশ গেলে প্রথম সুযোগে তারা পালিয়ে যেতে পারতেন। আওয়ামীলীগের অধিকাংশ নেতা তার সরকারে যোগদান করাতে খন্দকার মোশতাকও একটি রাজনৈতিক বৈধতা পেয়ে গিয়েছিলেন।” বলেন মহিউদ্দিন আহমদ।
যদিও আইনমন্ত্রী মি. হক বলছেন, ১৫ই অগাস্টের হত্যাকাণ্ডের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং যোগশাযশের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এই তদন্ত কবে শুরু হবে সেটি এখনো নিশ্চিত নয়, তবে এবিষয়ে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের কাজ এখনো চলছে।
“বঙ্গবন্ধুর পজিশন বিবেচনা করলে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ছাড়া গুটিকয়েক বিপথগামী সামরিক সদস্য এবং তার দলের একজন বেঈমান এই ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয় না। এটা বের করার চেষ্টা এখনো চলছে”। বলেন মি. হক।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, নির্মোহ একটি গবেষণা হলে হয়তো ১৫ই অগাস্টের হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনেক অস্পষ্টতাই দুর হয়ে যাবে। (সূত্র:মীর সাব্বির, বিবিসি বাংলা )