সেই ২৫শে মার্চ রাতে বাংলাদেশের মানুষ দুলছিল আশা-নিরাশার দোলায়। কী ঘটতে যাচ্ছে দেশে, কী তাদের ভবিষ্যৎ? নেতারা বলছেন, সামরিক শাসকদের সঙ্গে আলোচনায় অগ্রগতি ঘটছে। তার মানে কি পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে মীমাংসা? আর মন চায় না সেই কাঠামোর মধ্যে থাকতে। অধিকাংশ মানুষই চায় এক দফা: স্বাধীনতা। কিন্তু ভয়ও পায় অনেকে। এই সামরিক শাসকেরা নির্বাচনের ফল মানে না, গণতন্ত্র মানে না, মানে শুধু গায়ের জোর। শোনা যায়, বিমান ভরে সৈন্য আসছে পাকিস্তান থেকে, জাহাজ ভরে অস্ত্র। এসব কিসের আলামত? ভয় পায়ও না অনেকে। অনেক হয়েছে, আর নয়। আর সহ্য হয় না। বঙ্গবন্ধু তো বলেই দিয়েছেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব।
এই আশা-নিরাশা নিয়ে সেই রাতে যারা শয্যায় গিয়েছিল, তাদের অনেকেরই ঘুম ভেঙেছিল অস্ত্রের গর্জনে। নিরস্ত্র, নিরীহ মানুষের ওপর মারণাস্ত্রে সজ্জিত প্রশিক্ষিত, পেশাদার বাহিনীর বর্বরোচিত আক্রমণে। ইতিহাসের এক নির্মম নিষ্ঠুর গণহত্যার সূচনায়। অতর্কিত আক্রমণে তারা দিশেহারা হয়েছে, প্রতিরোধ করতে গিয়ে বুঝেছে, যার যা আছে, তা দিয়ে এর প্রত্যাঘাত চলে না। অস্ত্র চাই, শক্তি চাই। সংগঠিত হওয়ার সময় চাই। চারদিকে আগুনের এই লেলিহান শিখা নির্বাপণ করতে হলে রক্তের ধারা চাই।
পরবর্তী মাসগুলিতে সেটাই তারা করেছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যোগ দিয়েছে প্রশিক্ষিত যোদ্ধা, ছাত্র ও যুবকেরা এনেছে সাংগঠনিক কৌশল, কৃষক ও শ্রমিকেরা দিয়েছে কায়িক শক্তি, নারী দিয়েছে সাহস-কেবল সেবিকার রূপে নয়, যোদ্ধার বেশেও। এত অল্প সময়ে এত মানুষ সর্বস্ব ত্যাগ করার জন্যে এমনভাবে আর কখনো তৈরি হয়নি-অন্তত এদেশে।
একাত্তর সালে আমাদের যে-মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, তা কেবল আত্মরক্ষার যুদ্ধ ছিল না। মানুষ শুধু নিজের প্রাণ কি পরিবারের নিরাপত্তা চায়নি। সে কেবল তার পছন্দের রাজনৈতিক শক্তিকে ক্ষমতায় দেখতে চায়নি। তার চোখে স্বপ্ন ছিল একটা নতুন দেশের। সে-দেশটি কেমন হবে, তাও তার অজানা ছিল না। কতকগুলো মন্ত্র, কতকগুলো আদর্শ তার সামনে ছিল। কেউ সেসব কথা অনেকদিন ধরে ভেবেছিল, কেউ সদ্য সদ্য। কিন্তু ঠিকই সে প্রবৃত্ত হয়েছিল নতুন দেশগঠনে। পাকিস্তানের আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়েছিল পুরোনো কাঠামোর মধ্যে মীমাংসার সকল সম্ভাবনা। আর প্রত্যাবর্তন নয় সেখানে, এবারে নতুন বাসভূমি চাই, যাকে সে মনের মতো করে সাজিয়ে নিতে পারে।
নয় মাস পরে শত্রু পরাস্ত হয়েছিল, অর্জিত হয়েছিল স্বাধীনতা। তারপর দশক দশক চলে গেছে। এখন প্রশ্ন নিজেকে: আমাদের সেদিনের তৃষ্ণার শান্তি কি ঘটেছে?
স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের অর্জন সামান্য নয়। তারপরও এ কথা স্বীকার্য যে, ১৯৭১ সালের অভীষ্ট লক্ষ্যে আমরা আজও পৌঁছতে পারিনি। দেশে অনেককাল গণতন্ত্র নির্বাসিত ছিল, তারপর গণতন্ত্র ফিরে এসেছে বটে, কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হয় রয়ে গেছে দুর্বল, নয় গড়েই ওঠেনি। ধর্মনিরপেক্ষতায় পৌঁছবার আগে প্রত্যাবর্তন ঘটেছে সাম্প্রদায়িকতার। একটা ন্যায়পরায়ণ সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন ঘুচে গেছে।
তাহলে? সেই ২৬শে মার্চে যে-সংগ্রামের শুরু, সেটা তো শেষ হলো না। আলোর পথের যাত্রীকে তো এখানে থামলে চলবে না। যেতে হবে অনেক দূর। অনর্জিত লক্ষ্য সব অর্জন করতে হবে। তবেই সেদিনের গণহত্যার, সেদিনের নৃশংস আক্রমণের সমুচিত জবাব দেওয়া সম্ভবপর হবে।
প্রথম আলো (
, মার্চ ২৬, ২০১৫)