হাছিনা আক্তার মিনি:একুশে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষ্যে দেশে-বিদেশে সাজ সাজ রব। ভাষা দিবস পালন করার জন্য বহুদিন ধরে চলে আয়োজন। পুরো অস্ট্রেলিয়া তার ব্যতিক্রম নয়। অর্থাৎ যেখানে বাঙ্গালী বাস করছে সেখানেই চলে ভাষা দিবস পালনের প্রস্তুতি। বিদেশে গিয়েও বাঙ্গালী নিজের মাতৃভাষাকে ভুলে যায়নি, সংস্কৃতি চর্চা থেকে পিছিয়ে নেই, এতে নিঃসন্দেহে ভালো লাগায় মন ভরে যায়। কিন্তু মনটা বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে যায় যখন দেখি অধিকাংশ বাঙ্গালীর মাতৃভাষার প্রতি এই ভালবাসাটা কেবলমাত্র কয়েকটি বিশেষ দিবসের আনন্দ উপভোগ করার আর সংগঠনগুলোর মাতৃভাষা প্রীতি শুধু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ! এরা তাদের সন্তানদের বাংলাভাষায় স্বাক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন করার জন্য তাদের বাংলা শিক্ষা কেন্দ্রে পাঠাননা। কেউবা সন্তানদের শুধু গান-নাচের চর্চা করান বিশেষ দিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য অর্থাৎ বাংলাভাষায় নিরক্ষর বা অন্ধশিল্পী বানিয়েই তারা খুশী। কেউবা শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত বাংলা শিক্ষা কেন্দ্রেই তাদের সন্তানদের পাঠান কিন্তু ‘বোর্ড অফ স্টাডিজ’ চালিত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত বাংলা শিক্ষা কেন্দ্রে পাঠাননা। তাই সরকার প্রদত্ত মাতৃভাষা শিক্ষা লাভের সুযোগ আমরা হারাতে বসেছি ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যার অপ্রতুলতার কারণে।
অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষা নীতির একটি হচ্ছে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে (৭ম -১০ম শ্রেণীতে) ইংরেজির পর ২য় যেকোনো একটি ভাষা শিখা আবশ্যক। একে LOTE (Language Other Than English) বলে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় এই ভাষাটিকে অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে নিলে এতে প্রাপ্ত নম্বর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে যোগ হবে (UAI–University Admission Index) যা শিক্ষার্থীকে তার কাঙ্ক্ষিত বিষয় নিয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে সহায়তা করবে। পারিবারিক পরিবেশে মাতৃভাষার নিয়ত চর্চা, মা বাবার সহযোগিতায় ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষে খুব অল্প সময়ে অধিক নম্বর পাওয়া সম্ভব। মিশ্র সংস্কৃতির এই দেশের সরকার প্রত্যেক জাতি এবং ভাষাভাষীকে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার, মাতৃ ভাষায় কথা বলা এবং লিখতে পড়তে শিখার সুযোগ করে দিয়েছে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর বহু ভাষাভাষী তাদের মাতৃভূমি, মাতৃভাষা এবং পূর্বপুরুষদের সাথে তাদের পরবর্তী প্রজন্মের অটুট বন্ধন ধরে রাখার লক্ষ্যে তাদের সন্তানদের Saturday School of Community Languages (SSCL) এর অধিন ভাষা শিক্ষা কেন্দ্রে তাদের মাতৃভাষা লিখতে পড়তে শিখার জন্য পাঠায়। পর পর তিন বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অন্ততঃ ১৫জন ছাত্র-ছাত্রী সংশ্লিষ্ট ভাষা নিয়ে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়। এভাবে বোর্ডের শর্ত পূরণ করে তারা তাদের মাতৃভাষা কে বোর্ড অনুমোদিত UAI Status প্রাপ্ত ভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে পেরেছে। কয়েকটি দেশের আঞ্চলিক ভাষাও এই মর্যাদার আসনে বসতে পেরেছে। অথচ বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা যা পৃথিবীর একমাত্র মাতৃভাষা যে ভাষায় কথা বলার অধিকার অর্জন, সন্মান রক্ষা করতে হয়েছে বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে, অমূল্য জীবন বিসর্জন দিয়ে; তার স্থান সেখানে নেই। হাজার হাজার বাঙ্গালী অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছে, প্রতি বছর ১৫০-২০০ বাঙ্গালীর সন্তান উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হচ্ছে অথচ সমগ্র অস্ট্রেলিয়া থেকে মাত্র ১৫জন ছেলে মেয়েও LOTE বিষয় হিসেবে বাংলা ভাষা নিচ্ছেনা। অন্য যেকোনো দেশের ভাষা নিচ্ছে কিন্তু বাংলা নয়! অন্য ভাষা শিখতে কোন বাধা নেই, আগে নিজের ভাষায় স্বাক্ষরতা অর্জন করো তার পর যত খুশি অন্য যেকোনো ভাষা শিখো।
সিডনীতে একাধিক এলাকায় বাংলা শিক্ষা কেন্দ্র রয়েছে যেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সমমাণের বাংলা শিখানো হয়। এই বাংলা শিক্ষা কেন্দ্রগুলোর শিক্ষকমণ্ডলী এবং এর পরিচালনা কমিটির সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ, একুশে একাডেমী, বাংলা একাডেমী অস্ট্রেলিয়া, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ যারা বছরের বিশেষ দিনে, সময়ে বাংলা ভাষাকে পুঁজি করে তাদের সকল কর্মকাণ্ড চালান; তারা যদি তাদের সন্তানদের উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রে পাঠাতেন, তাদের শিক্ষা কেন্দ্র থেকে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা শেষ করে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়গামী ছাত্র-ছাত্রীদের শনিবার ভাষা শিক্ষা কেন্দ্রে যেতে উৎসাহিত করতেন, সহযোগিতা করতেন তাহলে শনিবার ভাষা কেন্দ্র ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যার অপ্রতুলতার কারণে আজ অস্তিত্ব রক্ষার হুমকির সম্মুখীন হতোনা।
একটি জাতির পরিচয়ের প্রথম স্তম্ভ তার ভাষা, তাই মাতৃভাষা লিখতে পড়তে জানা প্রত্যেকের জন্য আবশ্যক। একটা ছোট্ট পাখিও যেখানে নিজের ছানাকে নিজের বুলি শিখায় সেখানে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হয়েও বাঙ্গালী নিজের ভাষা না শিখিয়ে সন্তানদের অন্য দেশের/জাতির ভাষা শিখাতে গর্ববোধ করে। মাতৃভাষা শিখার জন্য সরকারী সব রকমের সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে অন্য ভাষা শিখতে যাওয়া কতোটা শোভনীয়? ধৃষ্টতার নয়কি?
১৯৫২ সালে মাতৃভাষার অধিকার এবং সন্মান রক্ষার জন্য মানুষ জীবন বলি দিয়েছে আর আজ এত সহজে পাওয়া অধিকার পায়ে মাড়িয়ে যাচ্ছে হতভাগা বাঙ্গালী। সপ্তাহে একটা দিন দুটো ঘণ্টার জন্য সন্তানদের বাংলা শিক্ষা কেন্দ্রে পাঠানোর কথা চিন্তাই করতে পারেননা তারা! এত অবহেলা আর অসন্মান মাতৃভাষার প্রতি!! বাংলা ভাষা শিখতে যাওয়ার মত তুচ্ছ কাজ, সময় অপচয় বাঙ্গালীরা আর কিছুকেই ভাবতে পারেননা।
বাঙ্গালীর সন্তান কে বাংলা ভাষা শিখার প্রাতিষ্ঠানিক অধিকার পাইয়ে দিতে, এই ভাষাকে সরকারি পর্যায়ে সন্মানের আসনে স্থায়ী ভাবে বসাতে ১৯৯৮ সালে কিছু বাংলাভাষা প্রেমী মানুষের উদ্যোগে বাংলা প্রসার কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির দীর্ঘ দিনের নিরলস প্রচেষ্টার ফল স্বরুপ ২০০৬ সালে SSCL এর তত্ত্বাবধানে Dulwich Hill high School এ অন্য আরও কয়েকটি ভাষার সাথে বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রথম কেন্দ্র চালু হয়। এরপর ২০০৭ সালে ২য় কেন্দ্র শুরু হয় Randwick High School এ। বাংলা ভাষা বোর্ডের অনুমোদন পেয়েছে ৭ম -১২ শ শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্য বিষয় হেসেবে যা দুটো ইউনিট সমমানের। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বাংলা নিয়ে পরীক্ষা দেয়া যাবে, সনদপত্রও (Cerificate) পাবে। শুধু প্রাপ্ত নম্বর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে যোগ হবেনা অর্থাৎ UAI Status পায়নি। বাঙ্গালী সমাজের আন্তরিকতার অভাবে, অসহযোগিতার কারণে ছাত্র–ছাত্রী সংখ্যা ২-১ জনে ঠেকে, তাই কর্তৃপক্ষ ২০১২ সালে Randwick কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়। Liverpool Girl’s High School এ বাংলা শিক্ষার নতুন কেন্দ্র চালু করে এবং SSCL ১১’শ -১২’শ শ্রেণীতে বাংলা চালু করার প্রস্তাব দেয় যা ছিল বাংলা ভাষাকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর সোনালি হাতছানি। এক্ষেত্রেও অন্ততঃ ১২জন ছাত্র – ছাত্রীর ভর্তি নিশ্চিত করতে না পারায় পেয়েও হারিয়ে ফেলতে হলো সুবর্ণ সেই সুযোগটি। একারণে পর পর তিন বছর অন্ততঃ ১৫জন ছাত্র-ছাত্রীর বাংলা ভাষা নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া এবং বাংলা ভাষা বোর্ড অনুমোদিত UAI Status প্রাপ্ত ভাষার মর্যাদা পাওয়া সুদূর স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে। Dulwich Hill কেন্দ্রে বাংলা ভাষা শিক্ষা বন্ধ করে দেয়া হয় ২০১৬।
আজ প্রবাসে বাংলা ভাষার আকাশে শুধু দুর্যোগের মেঘের ঘনঘটাই নয় প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষার মাথায় বজ্রাঘাত পড়তে যাচ্ছে। শেষ শিক্ষা কেন্দ্রই আজ বিলুপ্তির পথে। ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কমে আসায় SSCL কর্তৃপক্ষ সতর্ক করে দিয়েছে যে ১২জন করে ছাত্র-ছাত্রীর ভর্তি নিশিচত করা না হয় তাহলে পুরো অস্ট্রেলিয়ার সরকার চালিত Liverpool Girl’s High School এর একমাত্র বাংলা শিক্ষা কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হবে। শুধু তাই নয়, আগামী ২০ বছরেও নতুন কোন শিক্ষা কেন্দ্রে বাংলা ভাষা চালু করা হবে না। দুর্লভ এই সুযোগ পুনরদ্ধার করা শুধু দুরূহই নয় অসম্ভবও বটে।
বাঙ্গালী সমাজের জাগ্রত বিবেকের কাছে প্রশ্ন “আমাদের মাতৃভাষা আমাদেরই অবহেলা, অসন্মানের কারণে আজ যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে একি আমাদের জন্য লজ্জা আর গ্লানির নয়?” প্রতি বছর ২৪-২৫ হাজার বাঙ্গালী বাংলা মেলা উপভোগ করতে যান। যে মেলার মূল হলো বাংলা সংস্কৃতি আর সংস্কৃতির আত্মা হল বাংলা ভাষা। সেই ভাষাকে পায়ে মাড়িয়ে সবাই মালা পরায় সাংস্কৃতিক উৎসবকে! একদিনের ভালবাসা দেখায় সকাল সন্ধ্যা মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানমালা দিয়ে!! গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি দিয়ে কি কোনদিন গাছ বাঁচিয়ে রাখা যায়?
যারা প্রশ্ন করেন বাংলা শিখে কি হবে? তাদের জন্য অস্ট্রেলিয়ান সরকারের শিক্ষা বোর্ড থেকে পাঠানো বার্তা- যেখানে মাতৃভাষায় স্বাক্ষরতার সুফল বর্ণনা করা আছে সংক্ষেপে।
Saturday School of community language: Developing students knowledge and skills in their background language –
- Provides an opportunity to develop high levels of skills in a student’s background community language
- Improves performance across the curriculum through enhanced literacy skills which are transferable to English
- Helps maintain rewarding relationships with parents, grandparents. relatives and other community members
- Promotes a sense of cultural identity resulting in heightened self-confidence and self- esteem
- Places students in a better position to take advantage of employment opportunities
সকল বাংলা ভাষাভাষী, রাজনৈতিক দল সমূহ, ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সর্ব স্তরের জনতার কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ- আসুন আমাদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গামী সন্তানদের বাংলা শিক্ষা কেন্দ্রে ভর্তি করি, অনেক কষ্টের অর্জন বাংলা শিক্ষার একমাত্র কেন্দ্রটিকে বন্ধ হওয়া থেকে বাঁচাই, সন্তানদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক বাংলা শিক্ষার দ্বার চিরতরে বন্ধ হওয়া ঠেকাই। Board of Studies এর খাতা থেকে বাংলা ভাষার নাম মুছে ফেলা রোধ করি।