বাংলাদেশকে নিয়ে গত ২৬শে মার্চ অবমুক্ত হল ‘‘মা আমার মা, মাটি আমার মা’ এই গানটি।
এই গানটি লিখেছেন গীতিকার কল্পনা সরকার। এই গানটায় সুর দিয়েছেন সরোদ শিল্পী-গায়ক তানিম হায়াত খান রাজিত। মিউজিক ডিরেক্টর-গায়ক এজাজ ফারাহ। আর দেশের গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন রাজিত, এজাজ ফারাহ, শান, তাজরীন গহর, পল্লবী রায় ও ফাহাদ ফাহিম।এই গানটির সাউন্ড ডিজাইন আর মিক্সিং করেছেন রেজওয়ান সাজ্জাদ।
এক নজরে দেখা যাক শিল্পীদের পরিচয় :
কল্পনা সরকার : বাংলাদেশ বেতারের একজন সিনিয়র গীতিকার । ১৯৯২ থেকে বাংলাদেশ বেতারের এনলিস্টেড গীতিকার হিসেবে গান লিখে যাচ্ছেন। বাবা অবিভক্ত ভারতবর্ষের ডাক্তার ছিলেন – ডা. কুঞ্জবিহারী দাস পুরকায়স্থ। কল্পনা সরকার ১৯৮০ সালে কলেজে পড়ুয়া অবস্থায় সিরাজগঞ্জ থেকে প্রকাশিত যমুনা পত্রিকা তে দারুন লেখার স্বীকৃতি স্বরূপ ‘কাব্য বিনোদনী ‘ উপাধিতে ভূষিত হন। এখন পর্যন্ত ২০০র বেশি গান লিখেছেন কল্পনা সরকার । গান লেখার পাশাপাশি তিনি সচিত্র বাংলাদেশেও নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন তিনি । এছাড়াও কল্পনা সরকার বাংলাদেশ বেতারের নিয়মিত অনুষ্ঠান ‘সুখের সংসার ‘ আর ‘কিষান বধূ ‘ ও করতেন। একজন আবৃত্তিকার হিসেবে তিনি স্বরচিত কবিতা আবৃতি করে থাকেন সবসময় । কল্পনা সরকারের লেখা গানে কণ্ঠ দিয়েছেন শিল্পী জিনাত রেহানা , বদরুন্নেসা ডালিয়া , চমচমি দেওয়ান, বাবুল রেজা , আফসানা আউয়াল প্রমুখ ।
উল্ল্যেখ্য যে, কল্পনা সরকারের স্বামী রবীন্দ্রনাথ সরকারের মিউজিক ডিরেশনে কলিম শরাফী , সুবীর নন্দী , হৈমন্তী শুক্লা , শুভব্রত মুখার্জির মতো শিল্পীরা কণ্ঠ দিয়েছেন ।
শান : শান ছোটবেলা থেকেই গানের মাঝে বেড়ে উঠেছেন। হাতে খড়ি সেজ চাচা আফসার উদ্দীন মিঠুর কাছে। পরবর্তীতে শংকরবাবুর কাছে গুরু শিষ্য পরম্পরায় সঙ্গীত শিক্ষা করেন। সঙ্গীত জীবনের শুরুতে শান ব্যান্ড মিউজিকের সাথে ছিলেন। ২০০০ সালে শানের প্রথম ব্যান্ডের অ্যালবাম বের হয়। এরপর ২০০৩ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত অনেক গুলো মিক্সড অ্যালবামে শানের গান ছিল। শানের সঙ্গীত জীবনে একক শিল্পী হিসেবে আত্নপ্রকাশ ২০০৭ সালে সলো অ্যালবামের মাধ্যমে। তারপর শুধু সামনেই এগিয়ে চলা। ২০১১ তে দ্বিতীয় অ্যালবাম প্রকাশ পেয়ে যায়। এরপর শুধু গান নয়, শান সঙ্গীত পরিচালনাতেও দারুণ দক্ষতার পরিচয় দেন। ২০১২ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত শানের মিউজিক ডিরেকশনে ত্রিশের অধিক অ্যালবাম রিলিজ হয়েছে। ২০১৭ তে শানের গাওয়া ‘কন্যা’ গানটি বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতের একটা মাইলফলক বললে ভুল হবে না! বাংলাদেশে খুব কম গানই কোটি দর্শকের কাছে পৌছায়। শানের ‘কন্যা’ শীর্ষ স্থানীয় সে হাতে গোনা গান কয়টির মাঝে একটি! শানের মিউজিক ডিরেকশনে ফাহমিদা নবী, কনা, নিশীথা বড়ুয়ার মত শীর্ষ স্থানীয় শিল্পীরা কন্ঠ দিয়েছেন। এর মাঝে ফাহমিদা নবীর সাথে শানের গাওয়া ‘সাদা কালো ‘ গানটি শ্রোতাদের মাঝে বিপুল সাড়া ফেলে।
২০১৮ তে শানের ‘সখী’ গানটিও দারুণ আলোচিত হয়। এই গানটিও কোটির থেকেও বেশী শ্রোতার কাছে পৌঁছে যাবে – নিশ্চিন্তেই বলে দেয়া যায়। গান আর মিউজিক ডিরেকশনের পাশাপাশি শান একজন প্রফেশনাল লিড গীটারিস্টও।
তানিম হায়াত খান রাজিত : একজন সরোদ শিল্পী, কম্পোজার এবং গায়ক ׀ তানিম হায়াত খান এর সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো তিনি বিশ্ব বরেণ্য সংগীত ঘরানা সেনিয়া মাইহার ঘরানার একজন সদস্য ׀ তানিম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিশ্ব বিখ্যাত সন্তান উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের ছোট ভাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আরেক উপমহাদেশ খ্যাত সুরবাহার শিল্পী উস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সাহেবের নাতি׀ তানিম সংগীত বিশেষজ্ঞ মোবারক হোসেন খান আর ৬০ এর দশকের জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী ফওজিয়া ইয়াসমিনের কনিষ্ঠ সন্তান ׀ এছাড়াও তানিমের তিন খালাই গানের জগতের বাংলাদেশে অত্যন্ত পরিচিত মুখ। তাঁরা হলেন ফরিদা ইয়াসমিন , নিলুফার ইয়াসমিন এবং সাবিনা ইয়াসমিন׀
তানিম তার সংগীত জীবন শুরু করেন তবলার মাধ্যমে ׀এরপর তানিম পশ্চিমা সংগীতের সাথে পরিচিত হন , হাতে তুলে নেন গিটার ׀ মিউজিক ডিরেক্টর সজল দাসের কাছে তিনি কর্ড প্রোগ্রেশন আর বেজ গিটার শিখেন। ১৯৯৮ সালে তানিম সরোদ হাতে তুলে নেন ׀ ওনার সরোদে হাতে খড়ি ওনার চাচাতো ভাই উপমহাদেশখ্যাত সরোদিয়া উস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান এর কাছে ׀
সরোদ এর পাশাপাশি তানিম একজন মিউজিক কম্পোজার ও সংগীত শিল্পী ׀ ২০১৮ তে রাজিতের অডিও অ্যালবাম “তুমি যদি চাও ” রিলিজ হয়েছে।
এজাজ ফারাহ:এজাজ ফারাহর সঙ্গীতে হাতে খড়ি ছোট বেলায় মায়ের কাছে। একদম ছোটবেলাতে সরগম ছাড়া গান শিখে স্কুলের প্রতিযোগিতায় খালি গলায় গান গেয়ে প্রথম হবার পর থেকে গানের প্রতি আগ্রহ তৈরি।
২০০৬ সালে দ্বৈত এ্যালবাম আর একই বছর একক এ্যালবাম ‘তুমি অহঙ্কারেই বেশ বাংলাদেশ’ শিরোনামে ওয়ার্ল্ড মিউজিক থেকে প্রকাশিত হয়। ছোটদের জন্য নির্মিত টেলিভিশন অনুষ্ঠান সিসিমপুরের জন্য এজাজের মিউজিক কম্পোজিশনের শুরু। ২০১১র দিকে প্রথমবারের মত এজাজের সঙ্গীত পরিচালনায় অ্যালবাম ‘জঙলা পাখি পোষ মানে না’ শিরোনামে এ্যালবাম প্রকাশিত হয়। ২০০৩ সালে নাটক ও আধুনিক গানে বাংলাদেশ বেতারে তালিকাভুক্ত হন এজাজ। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে আধুনিক গানে তালিকাভুক্ত হন।২০১৮ তে এজাজের সঙ্গীত পরিচালনায় ‘তুমি যদি চাও’ শিরোনামে জি-সিরিজের ব্যানারে অডিও এ্যালবাম প্রকাশিত হয়।
তাজরীন গহর : ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো’ – এই অসাধারণ কালজয়ী দেশের গানের স্রষ্টা শ্রদ্ধেয় নঈম গহরের কন্যা তাজরীন। তাজরীনের গানের সাথে পরিচয় একদম ছোটবেলা থেকেই পারিবারিক ভাবে ও মা রিজিয়া গহরের উৎসাহে। সংগীতে হাতেখড়ি বাংলাদেশ বেতারের সংগীত পরিচালক জনাব খবিরুদ্দিনের কাছে. এছাড়াও নজরুল একাডেমিতে গান শিখেছেন তাজরীন.
তাজরীন ১৯৭৯ তে বিটিভির জন্য জিঙ্গেল করেছিলেন স্কুলে পড়ার সময়ে। মিউজিক ডিরেক্টর আনিসুর রহমান তনুর করা জিঙ্গেল গুলো ছিল বাংলাদেশ বিমান আর ন্যাশনাল বাল্বের । ১৯৭৬ এ মালয়েশিয়ার রাজা যখন বাংলাদেশ সফরে আসেন , তখন যে তিনজন শিশু শিল্পী গান পরিবেশন করেন তাজরীন তাদের মধ্যে অন্যতম। সম্প্রতি বাবা নয়ীম গহরের ‘একুশ আসে’ গানের শিরোনামে একটি সলো এলবামের বের হয় যেটার সংগীত পরিচালনায় ছিলেন শান। একুশ আসে এলবামের সফলতার সূত্র ধরে সংগীতে অবদানের জন্য তাজরীন ২০১৭ সালে স্বাধীনতা স্মারক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন বাংলার সংগীত সংগঠন থেকে। বর্তমানে তাজরীনের নতুন এলবামের কাজ চলছে সিডনি প্রবাসী রাজিতের সুরে আর এজাজ ফারাহর মিউজিক ডিরেক্শনে।
পল্লবী রায় তনু (পল্লবী): ছোট বেলা থেকে কলেজ পর্যন্ত কেটেছে বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁ জেলায় । পরে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগে পড়ার সুযোগ হয় ,তবে সেখানে পড়াশুনা না চালিয়ে পল্লবী পড়তে চলে যান কোলকাতায় রবীন্দ্র ভারতীবিশ্ববিদ্যালয়ে । রবীন্দ্র ভারতী থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স করেন উচ্চাংগ সংগীীতে। প্রথম গুরু ও হাতেখড়ি মোজাম্মেল হক বাবলুর হাতে । তারপর পন্ডিত অরুন ভাদুরীর কাছে শিখেছেন পল্লবী এবং বর্তমানে শ্রীমতী কোয়েল দাসগুপ্তা নাহার কাছে শিখছেন গুরু পরম্পরায় ।ছোটবেলায় গানের বিভিন্ন শাখায় বিভিন্ন জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন পল্লবী। যেমন শিশু একাডেমী পুরষ্কার , নতুন কুঁড়িতে ২০০৩ সালে নজরুল সংগীতে প্রথম এবং ছড়াগানে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন পল্লবী । পল্লবীর একটি একক অ্যালবাম আছে নাম “আরো প্রেমে ” । অ্যালবাম টি প্রকাশিত হয় ২০ ডিসেম্বর ২০১৬ তে জি সিরিজের ব্যানারে । সেখানে মোট ছয় টি গান আছে । তিনটি নজরুল এবং তিনটি রবীন্দ্র সংগীত। এছাড়াও একটি একক রবীন্দ্র সংগীতের কভার আছে ,”হৃদয়ের একুল ওকুল ” গান টি । পল্লবীর নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলের নাম Pallaby Roy Tonu, সেখানে নিয়মিত গানের ভিডিও আপলোড করেন পল্লবী। বর্তমানে গান নিয়ে শিক্ষকতা এবং গান পরিবেশনা নিয়ে ব্যস্ত আছেন তিনি । সামনে বর্ণ চক্রবর্তীর কম্পোজিশনে একটি মৌলিক গান আসছে । ভবিষ্যতে মৌলিক গানের উপরই জোর দিবেন পল্লবী। প্লে ব্যাক এর ইচ্ছেও আছে । গান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার কথা ভাবছেন পল্লবী। সুযোগ পেলে ওনার শেখা গানের উপকরণ গুলো ছড়িয়ে দিতে চান নতুনদের মাঝে ।
ফাহাদ ফাহিম : শৈশব এ বড় ভাই ওমর ফারুক এর সান্নিধ্যে গানের শুরু, পরিচিত হয়ে ওঠা বাদ্যযন্ত্রের সাথে। ফাহিমের আড্ডার উপলক্ষই থাকত গিটার এ একটু টুংটাং করা। এভাবেই স্কুল পার হয়ে কলেজে পড়ার সময়ে বন্ধুদের সাথে নিয়ে একটি ব্যান্ডের দল গঠন করেন। পরবর্তীতে একজন Vocal নিয়ে Pandora নামে নতুন ব্যান্ড শুরু করেন। প্রথম গানের album ‘তুমি যদি চাও’ তে যুক্তভাবে গীটার বাজিয়েছেন ফাহিম যেখানে আরও ছিলেন রাজিত,এজাজ ফারাহ ও সৃজনী দান ।
রেজওয়ান সাজ্জাদ: গত ২৭ বছর ধরে বাংলাদেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রীতে ক্লান্তিববিহীন ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। কখনও মিডিয়ার সামনে, কখনও নেপথ্যে। একটা গান ফাইনাল প্রোডাকশনে নিয়ে আসার সমস্ত কাজটুকু রেজওয়ানের কাজ। মিক্সীং ও মাস্টারিং! ১৯৯১ সালে রেজওয়ানের সঙ্গীত জীবনের চলা শুরু লীড গীটারিস্ট হিসাবে ডিথ্রো, স্প্যাংকিং মাঙ্কিস, সপ্তক ও অবসকিওর ব্যান্ডে। এই অভিজ্ঞতা গুলো রেজওয়ানকে ভীষনভাবে সহযোগিতা করে পরবর্তীতে মিউজিক ডিরেকশনে ও মিউজিক প্রডিউসার হতে। গীটারের পাশাপাশি রেজওয়ানের রয়েছে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল মিউজিক স্কুল (KDB) থেকে ৪ বছরের পিয়ানো কোর্স।