প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিডনি আসছেন এমন একটা খবর দেখছি ক’দিন থেকে। এও জেনেছি হাই কমিশনার নাকি এ নিয়ে আওয়ামী লীগারদের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। আওয়ামী লীগার না বলে বিদেশে আওয়ামী লীগের যে সব শাখা-প্রশাখা তাদের নেতাদের নিয়ে বৈঠক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আপনি ভালবাসেন বা না বাসেন, চান বা না চান, তাঁর হয়ে কথা বলেন বা না বলেন এসব বিষয়ে আপনার হক নেই। যখনই এমন কিছু হয় তখনই হামলে পড়ে দলের নেতা নামের লোকজনেরা। তখন যারা আসলে নিবেদিত কিংবা আমাদের মতো আমজনতা বা সাধারণ বিদেশী তাদের কাজ হচ্ছে তাজ্জব হয়ে দেখা। আর মনে মনে বলা, বাবা! এত ভালবাসেন তাঁকে আপনারা? আর ভাবতে থাকা, দল ও নেতার জন্য এত ভালবাসা থাকার পরও, এত আনুগত্যের পরও- কেন তবে এই বিভক্তি?
দেশে আওয়ামী লীগের শাখা-উপশাখার নামে প্রতিদিন একটি করে দল গজালেও মূল দল একটাই। যতদিন শেখ হাসিনা বা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউ আছেন কারও সাধ্য নেই একে বিভক্ত করে। সেটা আমরা আমাদের যৌবনে দেখেছি। মিজানুর চৌধুরী, দেওয়ান ফরিদ গাজী, আবদুর রাজ্জাক আরও কতজন দল ছেড়ে নতুন আওয়ামী লীগ করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। এদের কেউ আঁস্তাকুড়ে গেছেন আর কেউ ফিরে এসে বেঁচেছেন। শেখ হাসিনা থাকতেও ড. কামাল হোসেন, কাদের সিদ্দিকী নব্য লীগার মাহমুদুর রহমান মান্নার কা- দেখেছি আমরা। কেউ ইজ্জত হারিয়েছেন আর কেউ মুখে কুলুপ। ফলে বিদেশের আওয়ামী লীগ বা তাদের বিভক্তি নিয়ে মাথা ঘামাই না। জেনে অবাক হবেন না সিডনিতে মানে অস্ট্রেলিয়ায় আওয়ামী লীগের তিন তিনটি সংগঠন। যতদিন প্রয়াত নূরুল আজাদ, গামা আবদুল কাদির বা শেখ শামীমেরা সামনে ছিলেন ততদিন অন্তর্কলহ থাকলেও কেউ দল ভাঙেননি। পরে আস্তে আস্তে ভাঙনের প্রক্রিয়া এতটাই বেগবান যে এখন জানা মুশকিল কে কোন্ দিকে। যতদূর জানি ওই সভার উদ্দেশ্য ছিল জোড়াতালি দিয়ে তড়িঘড়ি করে একটা সমঝোতায় আসা এবং কে কার আগে মঞ্চ দখল বা সেদিন স্টেজে থাকতে পারেন তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
খবরে দেখলাম ২০১৮ গ্লোবাল সামিট অব উইমেন শীর্ষক এক সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য শেখ হাসিনা অস্ট্রেলিয়া আসছেন। এ দেশের প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুলের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের কথা রয়েছে। যতদূর জানা যায়, এতে আরও থাকবেন মরিশাসের রাষ্ট্রপতি আমিনা ফেরদৌস, ভিয়েতনামের ভাইস প্রেসিডেন্ট ডাঙ্গ থি নু থিন, কসভোর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এতিফেতা জাহাগা। সম্মেলনের তৃতীয় দিনে নারী নেতৃত্বে বিশেষ অবদানের জন্য শেখ হাসিনাকে ‘গ্লোবাল উইমেন্স লিডারশিপ এ্যাডওয়ার্ড’ সম্মাননা প্রদান করা হবে। বাংলাদেশী প্রতিনিধি অবশ্য আরও এক ধাপ এগিয়ে এও লিখেছেন প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সফরসঙ্গীদের বহর নিয়ে নাকি আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সে আসন সঙ্কটের কারণে তাঁরা দুই দফায় আসবেন এমন ভাবনাও চলছে।
খবরের সত্যতা যাই হোক, প্রধানমন্ত্রী ২০১১ সালের পর আর আসেননি এই দেশে। তখন তিনি প্রথমবার সরকার প্রধান। আজকের জায়গায় ছিল না বাংলাদেশ। তার পরও সে সভায় থাকার কারণে দেখেছি কতটা নির্ভীক আর স্পষ্টভাষী তিনি। সফরের পর তিনি যখন বাংলাদেশে ফিরে যান তখন দেশে বন্যা হয়েছিল। সে বন্যা নিয়ে কিছু একটা উল্টাপাল্টা বলেছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ড। শেখ হাসিনা সাফ জবাব দিয়ে জানিয়েছিলেন, অমন দুই-আড়াই কোটি জনসংখ্যা আর বিশাল দেশ নিয়ে বড় বড় কথা বলা যায়। ওইটুকু দেশে ষোলো কোটি মানুষকে তিনি মরতে দেন না। বরং বন্যা ঝড় বা দুর্যোগ থেকে ভালভাবে বাঁচার পথ করে দিয়ে যাচ্ছেন। সেদিন অনেকে কথাগুলো পছন্দ করেননি। বিশেষত আমাদের মতো যারা পরাধীন দেশে জন্মেছি বা বড় হয়েছি আমরা ভেবেছিলাম একি কথা? এমন করে কেউ বলে? আজ আমরা নিশ্চিত তিনি ও তার ভিশন স্বচ্ছ ছিল বলেই বাংলাদেশ মর্যাদা আর ভালবাসা বড় হয়ে উঠেছে বিশ্বে। তাঁর এবারের সফর তাই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশকে আগে অস্ট্রেলিয়ায় চেনানো ছিল কঠিন। মানুষ বাংলাদেশ শুনে বলত, ওহ ইউ আর ফ্রম ইন্ডিয়া? আমি প্রতিবাদ করলে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলত, ওকে ওকে, নেক্ট টু ইন্ডিয়া। সে বাস্তবতা এখন নেই। আমাদের ক্রিকেট সাকিব আল হাসান-তামিমরা এ দেশে এখন সুপরিচিত। শুধু এরা না, বাংলাদেশের যে নতুন প্রজন্ম এখানে এসেছে পড়াশোনা করছে বা মেধা ও পরিশ্রমে দেশের মুখ উজ্জ্বল করা অভিবাসীরাও বাংলাদেশের নাম পোক্ত করে দিয়েছে এতদিনে। মনে আছে সিডনি শহরের ব্যস্ত রাস্তায় একবার কয়েক বারের প্রিমিয়ার বব কারকে দেখেছিলাম একা হেঁটে রাস্তা পেরুচ্ছিলেন। দাঁড়িয়েছিলেন ট্রাফিক বাতিতে। এগিয়ে গিয়ে কথা বললে তিনি বাংলাদেশ শুনে একটা কথাই বলেছিলেন, ইউর লিডার শেখ হাসিনা ইজ রিয়েলি ব্রেভ। সে কথাটা কত সত্য তার প্রমাণ আমরা রোজই নানাভাবে দেখি। আজ শেখ হাসিনা অনেক বেশি শক্তিশালী। এতটাই যে, জার্মানির নির্বাচনে এ্যাঞ্জেলার প্রচারে তাঁর সঙ্গে শেখ হাসিনার ছবিও ছিল ব্যানারে। এটা অনেক বড় অর্জন। পুতিন থেকে মোদি বা বিশ্বের নানা দেশে শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। মনে পড়ছে আন্তর্জাতিকভাবে তাঁর ভূমিকা প্রচারে মাঠে নামা জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবুল বারাকতদের একটি দল এসেছিল এই দেশে। সে বিষয়টা তখনও ম্যাচিওড হয়নি বলেই সভার প্রয়োজন ছিল। আজ আর তার দরকার নেই। এখন শেখ হাসিনা সারাবিশ্বে এক উজ্জ্বল নাম।
সে কারণে আমরা চাই তাঁর নাগরিক সংবর্ধনা হোক কলহমুক্ত। তাঁর সভায় যেন বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ ভালবাসার স্বদেশীরা প্রায় অগ্রাধিকার। এ জাতীয় লেখার একটা বড় অসুবিধা হলো সংশ্লিষ্টজনরা ধরে নেন লেখক নিজেকে যুক্ত করার জন্য এমন কথা বলছেন। যুক্ত হতে কে না চায়? কিন্তু তার চেয়েও বড় বিষয় মানুষের পালস বা নাড়ি বোঝা। হাইকমিশনারের ভূমিকা কিংবা হাইকমিশনের ভূমিকা এখানে অনেক বেশি। তাঁরা যে যখন আসেন সব সময় সরকারী দলের স্থানীয় নেতাদের কাছে হার মানেন। এটা কাম্য না। তাঁদের উচিত বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা। ব্যক্তিগতভাবে শেখ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত শেখ শামীম আওয়ামী লীগ না করলেও তিনি ফ্রন্টলাইনে থাকলে আমরা খুশি হব। এতে দলীয় কোন্দলে যেমন ভাটা পড়বে তেমনি আমি না তুমি সে বিবাদও ম্লান হয়ে আসবে।
যেভাবেই হলো এই সংবর্ধনা বা মিলনমেলা যেন হয় সার্বজনীন। আওয়ামী লীগের সমস্যা তার বিশালত্ব। দল ও ইতিহাস এত বড় আর ব্যাপক সবাইকে একসঙ্গে রাখা অসম্ভব। কিন্তু এখন সিডনিতে গড়ে উঠেছে নতুন তারুণ্যে ভরপুর এক নয়া শক্তি। এদের হাতে আওয়ামী লীগের ভার বা দায়িত্ব না গেলে বিদেশে চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্র বন্ধ করা যাবে না। তারা সামনে থাকুক। মনে রাখা দরকার শেখ হাসিনাকে তোষামোদ বা স্তাবকতায় তুষ্ট করার সময় নেই। তিনি এসবে বিরক্ত হন। তরচেয়ে জরুরী জামায়াত-বিএনপির যে অশুভ নেটওয়ার্ক তার বিষয়ে সত্য বলা। বিএনপি তার রাজনীতি করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যারা দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে বিশেষত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তাদের ব্যাপারে সজাগ থাকাই হবে কাজের কাজ।
প্রশান্তপাড়ের বাঙালী জানে বঙ্গবন্ধু এ দেশে না আসলেও এই দেশ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে সমর্থন করা দেশ যারা যে কোন পাশ্চাত্যের দেশের চেয়ে এগিয়েছিল একাত্তরে। এই দেশের সাংবাদিক ব্রুস ইউলসন মেলবোর্ন থেকে গিয়ে নয় মাস যুদ্ধ কভার করার পাশাপাশি বিজয় দিনে সশরীরে হাজির ছিলেন রেসকোর্সে। এ দেশের মাটিতে শুয়ে আছেন বীরপ্রতীক, একমাত্র বিদেশী বীরপ্রতীক ওডারল্যান্ড। বঙ্গবন্ধুকন্যা সময়ের সাহসী নেতা বাংলাদেশের জয়রথের চালিকা শেখ হাসিনাকে জানাই আগাম স্বাগতম। এখানকার নেতারা যাই করুক যার ইচ্ছা মঞ্চে উঠুক নামুক কিছু যায় আসে না। আপনি আমাদের ভরসার শীর্ষে আছেন, থাকবেন। (সূত্রঃ দৈনিক জনকণ্ঠ )