এক মায়াবী আলোর গল্প শুনাব আজ। তার দেখা পেয়েছিলাম গত হেমন্তে, Nature’s Window দেখতে গিয়ে। প্রকৃতি আমার প্রথম প্রেম, সুতরাং মনের জানালা খুলে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতে পারি প্রকৃতির রূপ দেখে। সেই প্রকৃতিরই যদি জানালা থাকে, না জানি সেটা কেমন হবে? তাই “নেচার্স উইন্ডো” দেখতে যাবার উচ্ছ্বাসটা একটু অন্যরকম ছিল বৈকি!
কালবারী ন্যাশনাল পার্কে পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল।লুক আউটে দাঁড়িয়ে এক অদ্ভূত ল্যান্ডস্কেপ দেখলাম। প্রথম দেখায় মনে হবে এ যেন হাজার বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত লালচে এক ঊষর ভূমি। কিন্তু তার বুক আবৃত করে আছে মাঝারি আকারের বুনো ঝোপ, বিবর্ণ সবুজ পাতা আর হোলদেটে বুনো ফুল! একই তুলিতে লাল-হলুদ-সবুজ সব রং মাখিয়ে যেমন ইচ্ছে যেখানে খুশি তুলির আঁচড় বসিয়েছে প্রকৃতি।
ওয়াকিং ট্রেইল ধরে হাঁটা শুরু করলাম। ৮০০/৯০০ মিটার পরেই চোখে পড়ল বড় বড় লালচে পাথরের সারি। আঁকাবাঁকা-উঁচু নীচু পাথুরে পথ, একটু বেখেয়াল হলেই সর্বনাশ! পা পিছলে গেলে খাড়ির নীচে গড়িয়ে কয়েকশ মিটার। সেখানে বয়ে চলেছে মার্চিসন নদী। উচ্চতা, গভীরতা, বিস্তৃতি – এই তিনের এক অদ্ভূত সংমিশ্রণ যেন! যাই হোক, পথ যখন বেশি দুগর্ম হয়ে এল, পাথরের গা ঘেঁষে একটু একটু করে সামনে এগুচ্ছিলাম। তখনই হঠাৎ এক আলোর ঝলক এসে অন্ধ করে দিল আমায়! বুঁজে আসা চোখ কোন রকমে খুলে বাঁক নিতেই দেখি প্রকৃতি তার জানলা খুলে বসে আছে সামনে! “নেচার্স উইন্ডো”- সে এক অদ্ভূত জানালা!
সেই জানালার কড়িকাঠ তৈরী হয়েছে লক্ষ বছরের পুরানো লাইনস্টোন দিয়ে।আর ঐ যে দুরন্ত আলো, কতই না বিচিত্র রঙের পরশ বুলিয়েছে সে এই পাথরের বুকে। জানালার আগল ধরে যখন দাঁড়ালম, সে আলোর মায়াবী পরশে তখন আমি সম্মোহিত। এ যে কনে দেখা লাজুক আলো নয়, সূর্যাস্তের বিদায়ী রক্তিম আলোও নয়। এ হল হাজার বছরের প্রতীক্ষায় থাকা এক ঋদ্ধ আলো। পাহাড়ি উপত্যকার বিরান ভূমিতে নি:সঙ্গ এক মায়াবী আলো, আদি অকৃত্রিম যার ছোঁয়া।চোখ বুঁজেও তার পরশ অনুভব করা যায়। নিজেকে মনে হয় সেই বুনো ফুল, আলোর স্পর্শে যে পাপড়ি মেলে দেয়, খুশিতে ঝলমল। আর সন্ধ্যা হলেই পাপড়ি গুটিয়ে নেয় মৃতের মতন!
সেদিনও সন্ধ্যা নেমেছিল। পাহাড়ি উপত্যকায় লম্বা লম্বা ছায়া ফেলে সে গ্রাস করে নিল ঝলমলে ঐ আলোকে। বুনোপথ ধরে ফেরার পথে প্রচন্ড অভিমান হয়েছিল আমার। এতটা অভিমান যা মন থেকে শরীরে ছড়ায় অসুখ হয়ে। আমি ভাবী জ্বর! হায়! মায়াবী আলোর স্পর্শ তো এমনই হয়!