“লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার”

“লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার”

একুশের চেতনা’র বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিক দর্শন

(৪র্থ পর্বঃ “প্রতিক্রিয়া এবং বাস্তবায়নের সম্ভাবনা”)

 

নির্মল পাল : লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার” প্রবর্তনের বৈশ্বিক দর্শন বিশ্বব্যাপী ঝুঁকিপূর্ণ মাতৃভাষা সংরক্ষণে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ’ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী গণসম্পৃক্তকরণ এবং সামাজিক পারস্পরিক যোগসূত্র সৃষ্টির স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি। লাইব্রেরী সমূহে যার উপস্থিতি কন্সারভ ইউর মাদার ল্যাংগুয়েজ আবেদনের মাধ্যমে পৃথিবীর সর্বত্র সকল ভাষাভাষীকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করে নিজ নিজ মাতৃভাষা সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় প্রায়োগিক সুযোগ এবং ব্যাবহারিক সুবিধা নিশ্চিত করবে। এই প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে সংশ্লিষ্ট ভাষাভাষীরা মহান একুশের চেতনার অনুপ্রাণিত হয়ে নিজ নিজ মাতৃভাষা রক্ষায় সাধ্যানুযায়ী সম্ভাব্য সবকিছু করার চেষ্টা করবে। পর্যায়ক্রমে বিশ্বের সর্বত্র সকল মাতৃভাষা সুরক্ষায় নিশ্চিত হবে মহান একুশের চেতনার বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জনের ধারাবাহিকতা। সকল ভাষাভাষী সারা বছরব্যাপী নিজ নিজ ভাষা সংরক্ষণে লাইব্রেরীসেবা ব্যাবস্থার সাহায্যে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উদযাপনের বস্তুনিষ্ঠ প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ পাবে। ঝুঁকিপূর্ণ মাতৃভাষা সংরক্ষণের প্রচারণা বা গণসম্পৃক্ততা অর্জনের কৌশল হিসেবে শহরে শহরে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ’ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ‘লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার’ প্রবর্তণের দর্শন একটি পারস্পরিক পরিপূরক দর্শন; যা স্মৃতিসৌধের স্থায়ী স্থাপত্য স্থাপনার সাথে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে লাইব্রেরীর যোগসূত্রে বিশ্বের সর্বত্র সকল ভাষাভাষীর মাতৃভাষা চর্চা এবং সংরক্ষণের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবে।

পৃথিবীর প্রথম ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ’ বাস্তবায়নের প্রাক্বালে এসফিল্ড কাউন্সিল কর্তৃক স্মৃতিসৌধ বাস্তবায়নের সার্বিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কাউন্সিলের প্রাক্তন জেনারেল ম্যনাজার প্রয়াত ডঃ ডেভিড নিভেন স্মৃতিসৌধের পাশাপাশি ‘লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার’ প্রবর্তণের দর্শনকে ভাষা সুরক্ষায় বিশ্বব্যাপী এক বৈপ্লবিক অধ্যায়ের সূচিত হবে বলে আশাবাদ ব্যাক্ত করে এই প্রক্রিয়ায় নিজেকে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত করেন, এবং তাঁর চাকুরী জীবনের শেষ পর্যায়ে স্মৃতিসৌধ বাস্তবায়নের মত মহত কাজটি সুসম্পন্ন করার বিষয়ে সর্বাধিক সময় ব্যয়ের পক্ষে তাঁর আগ্রহের কথা কাউন্সিল বরাবরে অবহিত করলে তা কাউন্সিল যথারীতি অনুমোদন করেন। জেনারেল ম্যানেজার প্রয়াত ডঃ ডেভিড নিভেন ২০শে জানুয়ারি ২০০৬ তারিখে অবসর গ্রহণ করার পূর্বে তাঁর নিজ উদ্যোগে এবং দায়িত্বে স্মৃতিসৌধ বাস্তবায়নের সাথে সম্পৃক্ত সরকারি বিভিন্ন (৫টি)দপ্তর থেকে আনুসাঙ্গিক প্রয়োজনীয় সকল অনুমোদনের কাজ সম্পন্ন করেন। তিনি চাকুরী জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও তাঁর ওপেন হার্ট সার্জারির মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আমাকে সাথে করে ছুটির দিনে নিজে ড্রাইভ করে সুদুর অরেঞ্জে স্মৃতিসৌধের জন্য স্লেট পাথর অনুসন্ধানে যাওয়ার ঘটনা স্মৃতিসৌধ বাস্তবায়নে তাঁর আগ্রহ এবং ঐকান্তিকতার দৃষ্টান্ত আমাকে বিস্মিত করেছে। উল্লেখ্য তাঁর অবসর জনিত কারনে স্মৃতিসৌধ উদ্বোধনীর ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে (১৯শে ফেব্রুয়ারি ২০০৬) তিনি উপস্থিত থাকতে পারেননি।

‘অস্ট্রেলিয়া লাইব্রেরী এন্ড ইনফরমেশন এসোশি য়েসন’(ALIA) ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উদযাপন এবং সকল মাতৃভাষা সংরক্ষণের জন্য এমএলসি মুভমেন্টের কার্যক্রম সকল ভাষাভাষীর কাছে পৌঁছে দেয়ার প্রচারণা হিসেবে এসোশিয়েসনের নিয়মিতভাবে প্রকাশিত “INCITE” ম্যাগাজিনে কন্সারভ ইউর মাদার ল্যাংগুয়েজ নামক একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে (সংখ্যাঃ INCITE জানু-ফেব্রু ‘১৫)। প্রবন্ধটি প্রকাশের পর ম্যাগাজিনের সম্পাদক মিসেস লি ওয়েলস একই বিষয়ে আরও একটি প্রবন্ধ প্রকাশের ইচ্ছা প্রকাশ করলে ‘লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার’ নামক প্রবন্ধটি প্রেরিত হয়। যার বিষয় বস্তুর গুরুত্বের উপর বিবেচনা করে সম্পাদক প্রবন্ধটি, One Small Book Shelf, One Giant Step Forward” নামে প্রকাশ (সংখ্যাঃ INCITE মে’ ২০১৫)করেন। উল্লেখ্য,  প্রবন্ধটি প্রকাশের পূর্বে মিসেস লি ওয়েলস তাঁর লাইব্রেরী পেশায় সম্পৃক্ত হওয়ার পর থেকে ভাষা-সংস্কৃতি সংরক্ষণে এই ধরনের গঠনমূলক সংরক্ষণশীল লেখা তাঁর নজরে না পরায় প্রবন্ধটির নামাকরনের গুরুত্ব বিবেচনায় যথার্থ অর্থবোধক নাম হিসেবে তাঁর দেয়া উল্লেখিত নামটি ব্যাবহারের পক্ষ্যে যুক্তি তুলে ধরলে আমি তাঁর সাথে ঐকমত্য পোষণ করি। লেখাটি  প্রকাশের পর লাইব্রেরী ব্যবস্থাপনায় সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে একুশে কর্নার নামটি বিশেষ গুরুত্বের সাথে মূল্যায়ন হতে থাকে।  অস্ট্রেলিয়া ন্যাশন্যাল লাইব্রেরী একুশে কর্নার স্থাপনার বিষয়টি বিবেচনাধীন রেখে এই বিষয়ে কার্যকরী প্রচারণার জন্য লাইব্রেরীর ওয়েবসাইট সহ সংশ্লিষ্ট সকল মাধ্যম ব্যাবহারের সিদ্ধান্তের  কথা অবহিত করে। এমনকি আমেরিকা লাইব্রেরী এসোশিয়েসনের নিয়মিত প্রকাশিত ম্যাগাজিনেও প্রবন্ধটি পুনঃ মুদ্রিত হয় বলে বিস্বস্থ্য সুত্রে জানা যায়। প্রকাশিত এই প্রবন্ধের সুত্র ধরে এসফিল্ড কাউন্সিলের প্রাক্তন মেয়র মিসেস লুসিয়ান মেকনেন এবং স্থানীয় স্টেট এমপি মিসেস হেলেন জো বাংলাদেশ  সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সচিব জনাব এন আই খান এবং আরটিভি’র সিইও সৈয়দ আশিক রহমানের উপস্থিতিতে ২০শে ফেব্রুয়ারি ২০১৬ এসফিল্ড কাউন্সিল লাইব্রেরীতে পৃথিবীর প্রথম “টুয়েন্টি ফার্স্ট(একুশে)কর্নার” উদ্বোধন করেন। লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার দর্শনটি অত্যন্ত যুগোপযোগী এবং সহজেই বিশ্বব্যাপী বাস্তবায়নযোগ্য বিবেচনায় সাবেক সচিব জনাব এন আই খান অনুষ্ঠান থেকে তাৎক্ষনিকভাবে বাংলাদেশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনলাইন পোর্টাল পত্রিকায় একুশে কর্নার সম্পর্কে বিশেষ প্রচারণা শুরু করেন। তাঁর বস্তুনিষ্ঠ কৌশলী প্রচারণা বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পেশাজীবীগুষ্ঠিকে ‘একুশে কর্নার’ বিষয়ে অনুপ্রাণিত করে এবং লাইব্রেরী সমূহে একুশে কর্নার প্রতিষ্ঠায় বিশেষভাবে আগ্রহী করে তোলে। এই প্রচারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান লাইব্রেরিয়ানের রিপোর্ট (একুশে কর্নার সেমিনার, ২৮-২-১৭) অনুযায়ী ২০১৬ সালে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীতে বাংলাদেশের প্রথম একুশে কর্নার প্রতিষ্ঠিত হয়।

সাবেক শিক্ষা সচিব জনাব খানের প্রচারনার ফলশ্রুতিতে ‘বাংলাদেশ লাইব্রেরী এসোশিয়েসন’ লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার দর্শনটি এসোশিয়েসনের সাথে নিবন্ধনকৃত ৩৫০০ লাইব্রেরীতে প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দার্শনিক দিকগুলি সম্পর্কে সকলের স্বচ্ছধারনা অর্জনের লক্ষ্যে একুশে কর্নার বিষয়ক একটি সেমিনার আয়োজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার বিষয়ক সেমিনারকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশন, বাংলাদেশ গণ গ্রন্থাগার অধিদপ্তর এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সিটিউট এর সহযোগিতায় বাংলাদেশ লাইব্রেরী এসোশিয়েসন জনাব এন আই খানকে উপদেষ্টা করে “মাতৃভাষা সংরক্ষণ আন্দোলন” নামীয় একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এমএলসি মুভমেন্টের বাংলাদেশ চ্যাপ্টার হিসেবে নতুন জন্ম নেয়া এই সংগঠন ২৮-২-১৭ তাং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সিটিউট এর সেমিনার হলে সারা বাংলাদেশের সকল পর্যায়ের লাইব্রেরিয়ান, সংশ্লিষ্ট দেশী-বিদেশী বুদ্ধিজীবী, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/অধিদপ্তরের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে “গ্রন্থাগারসমূহে একুশে কর্নার স্থাপনা” শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনার-২০১৭ এর আয়োজন করে। ভারত, অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডা থেকে আগত আমন্ত্রিত প্রতিনিধিসহ চারশতের বেশী পেশাজীবী অতিথিদের সমন্বিত এই বিশেষ সেমিনারে লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার দর্শনের প্রবক্তা হিসেবে জানব নির্মল পাল ২২ পৃষ্ঠার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। প্রফেসর নাসিরউদ্দিন মুন্সি’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সেমিনারের প্রথম পর্বে প্রধান অতিথি হিসেবে জনাব এন আই খান এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে প্রাক্তন সচিব এবং বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জানব আরাস্তু খান; এডিশন গ্রুপের এমডি জনাব জাকারিয়া শহীদ; এবং মিসেস বুলি ইসলাম (আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উদ্যোক্তা প্রয়াত রফিকুল ইসলামের সহধর্মিণী, কানাডা অভিবাসী)। সেমিনারের দ্বিতীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত প্যানেল আলোচনায় বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশনের সচিব জনাব মনজুর হোসেন এর সঞ্চালনায় মুখ্য আলোচক হিসেবে জনাব রাশেদা কে চৌধুরী, নির্বাহী পরিচালক গণস্বাক্ষরতা অভিযান এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা; জনাব শ্যামল কান্তি ঘোষ, সাবেক সচিব কৃষি মন্ত্রণালয়; জনাব মাহমুদ সেলিম, একুশে পদক প্রাপ্ত সুধী, জনাব ডঃ আশীষ কুমার সরকার, মহাপরিচালক, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর; এবং ডঃ নাসিরুদ্দিন মুন্সী, প্রফেসর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভাপতি, বাংলাদেশ লাইব্রেরী এসোশিয়েসন মূল প্রবন্ধ উপস্থাপক জনাব  নির্মল পাল এর সাথে মুখোমুখি অলোচনায় যুক্ত হয়। বস্তুনিষ্ঠ সঞ্চালনায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠা এই প্যানেল আলোচনা এক পর্যায়ে একুশের চেতনায় আবেগাচ্ছন্ন দর্শকদের অংশগ্রহণে মুক্ত আলোচনায় উন্নীত হয়ে উঠে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা, বিশ্ববিদ্যালয়/কলেজের অভিজ্ঞ লাইব্রেরিয়ান, ভারতের কলকাতা থেকে আগত পেশাজীবী, উপস্থিত সচিব, অতিরিক্ত সচিব, উপ-সচিব, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সম্মানিত সুধীদের অংশগ্রহণে আলোচনা অত্যন্ত গঠনমূলক ও সৃজনশীল পর্যায়ে উন্নীত হয়। সুদীর্ঘ আলোচনার পরিশেষে “লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার” দর্শনটিকে বিশ্বব্যাপী ঝুঁকিপূর্ণ মাতৃভাষা রক্ষায় একটি বৈশ্বিক বিপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করার পাশাপাশি বাংলা এবং একুশের চেতনাকে বিশ্বে সকল ভাষাভাষীর কাছে চিরঞ্জীব এবং সম্মানীয় করবে বলে উপস্থিত সকলে ঐকমত্য পোষণ করেন। এই সেমিনারের পরপরই বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশন (বেনবেইজ কার্যালয়, ১ এশিয়া-পেসিপিক হাইওয়ে, পলাশী-নীলক্ষেত, ঢাকা) এর লাইব্রেরীতে ‘একুশে কর্নার’ প্রতিষ্ঠিত হয়। আরটিভি চ্যানেল “লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার” বিষয়ক সেমিনারের খবর নিয়মিত সংবাদে প্রচার করে এবং পরবর্তীতে জনাব নির্মল পাল, জনাব এন আই খান এবং জনাব এনাম হককে নিয়ে “একুশে কর্নার” নামক একটি ‘টক সো’ সম্প্রচার করলে লাইব্রেরীতে ‘একুশে কর্নার’ দর্শনটি সারাদেশের মাতৃভাষাপ্রেমী দর্শক এবং সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিজীবী পেশাজীবীদের মাঝে ব্যাপক আগ্রহের জন্ম দেয়।

ইউনেস্কোর দ্বিতীয় ক্যাটাগরি প্রতিষ্ঠান হিসেবে উন্নীত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সিটিউট ঢাকা’র সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত “গ্রন্থাগারসমূহে একুশে কর্নার স্থাপনা” শীর্ষক সেমিনারের(ইংরেজিতে উপস্থাপিত)মূল প্রবন্ধটি মহাপরিচালক, ইউনেস্কো বরাবরে প্রেরিত হলে মহাপরিচালকের পক্ষে সহকারী মহাপরিচালক জনাব কিয়ান টাং বিশ্বব্যাপী ঝুঁকিপূর্ণ মাতৃভাষাসমূহ সংরক্ষণে মূল প্রবন্ধে উপস্থাপিত চিহ্নিত কৌশল এবং সুপারিশমালা প্রেরণের জন্য ধন্যবাদ এবং অভিনন্দন জানিয়ে এমএলসি মুভমেন্টের  ব্যতিক্রমী কাজের ভূয়সী প্রশংসাপত্রে লিখেন, MLC Movement International Inc has done impressive work to promote and cultural diversity as well as multiculturism, and your mission very much contributes to UNESCO’s endeavour to preserve languages.” (Ref:ED/IPS/ESG/17/2470 dated 28 Mar 2017). উল্লেখ্য তারপরই ইউনেস্কোর শিক্ষা বিষয়ক প্রধানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার এবং ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ’ স্থাপনা বিষয়ক সুনির্দিষ্ট দর্শনগুলির বিভিন্ন মৌলিক বিষয় নিয়ে সরাসরি আলোচনার জন্য ৭-৭-১৭ তারিখে স্কাইপে আলোচনার আয়োজন করে। এই আলোচনার ফলাফল হিসেবে এমএলসি মুভমেন্ট এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সিটিউট একযোগে কাজ করার উপর বিশেষ গুরুত্ব পোষণ করে প্রবন্ধে উপস্থাপিত কৌশলাদি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে ইউনেস্কো সাধারণ পরিষদের বার্ষিক সভায় উপস্থাপনের পরামর্শ দেন।

অস্ট্রেলিয়া ক্যাপিটাল টেরিটোরি’র লেজিসলেটিভ এসেম্বলিতে ১৩-৯-১৭ তারিখে উত্থাপিত এবং সর্বসম্মতভাবে পাশকৃত প্রতিবছর ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উদযাপন বিষয়ক মোশনে প্রত্যেক লাইব্রেরীতে ‘একুশে কর্নার’ প্রতিষ্ঠার কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকায় সাবেক হাই কমিশনার মান্যবর কাজী ইমতিয়াজ হোসেন বিষয়টিকে বাংলা এবং বাঙালিদের জন্য বিশ্বসমাজে একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে মুল্যায়ন করেন, এবং ব্যাক্তিগতভাবে লেজিসলেটিভ এসেম্বলি থেকে এই মোশনের কপি সংগ্রহ করে ক্যানবেরা হাই কমিশনারের অফিসকক্ষে সযত্নে সংরক্ষণ করেন। পরবর্তীতে তিনি তাঁর বিদায়ের আগে লিখিত অভিনন্দন জানানোর মাধ্যমে এবিষয়ে অন্যান্য স্টেট এবং টেরিটোরিতে নিবিড়ভাবে কাজ করার জন্য জনাব নির্মল পালকে উৎসাহব্যাঞ্জক পরামর্শ প্রাদান করেন।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০১৮ তারিখে নিউ সাউথ ওয়েলসের স্থানীয় কাম্বারল্যান্ড কাউন্সিলের সভায় কাউন্সিলর জানব সুমন সাহা’র প্রস্তাবে কাউন্সিলের অধীনস্থ সকল(৮টি) লাইব্রেরীতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০১৯ এর মধ্যেই ‘একুশে কর্নার’ বাস্তবায়নের সিধান্ত গৃহীত হয়। এই সিধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এমএলসি মুভমেন্টের সাথে কাউন্সিলের কয়েকদফা আনুষ্ঠানিক আলোচনায় ‘একুশে কর্নার’ বাস্তবায়নের পাশাপাশি স্থানীয় সকল ভাষাভাষীদের সমন্বয়ে গণসংযোগ ভিত্তিক মতবিনিময় সভা আয়োজনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যা পর্যায়ক্রমে কাউন্সিল এলাকায় একটি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ’ বিনির্মাণে সহায়ক ভুমিকা রাখার কৌশল হিসেবে জনমত সৃষ্টিতে সাহায্য করবে বলে বিশ্বাস। কাউন্সিলের গৃহীত এই সিধান্তের ফলে এমএলসি মুভমেন্টের উদ্ভাবিত বৈশ্বিক কৌশলে চিহ্নিত সব কয়টি ধাপ তৃনমূল পর্যায়ের স্থানীয় প্রশাসন এলাকায় বসবাসকারী সমুদয় জনগুষ্টির জন্য মাতৃভাষা সংরক্ষণ কর্মকাণ্ডের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হল। ইউনেস্কোর সুনির্দিষ্ট পরামর্শ, অস্ট্রেলিয়া ক্যাপিটাল টেরিটোরি’র লেজিসলেটিভ এসেম্বলির পাশকৃত মোশন এবং অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় প্রশাসনে একুশে কর্নার বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তের মধ্যদিয়ে বিষয়টি এখন প্রমাণিত সত্য যে, এমএলসি মুভমেন্টের উদ্ভাবিত বৈশ্বিক কৌশলাদি বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে ইউনেস্কো সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত হলে তা সহজেই অনুমোদন লাভ করবে এবং সারা পৃথিবীর সকল লাইব্রেরীতেই “একুশে কর্নার” প্রতিষ্ঠা পাবে, বিশ্বব্যাপ্ত ঝুঁকিপূর্ণ মাতৃভাষাসমূহ রক্ষায় সংশ্লিষ্ট ভাষাভাষী এবং লাইব্রেরী সেবাদানকারী নিবেদিত কর্মীগণ উৎসাহিত হবে, একুশে চেতনা সারা পৃথিবী জুড়ে সকল মাতৃভাষা রক্ষায় নতুন প্রেরনা বিশেষ উদ্দীপনা হিসেবে সকল ভাষাভাষীকে অনুপ্রাণিত করবে, বাংলা এবং বাঙালি হবে বিশ্বের সকল ভাষাভাষীর কাছেই সম্মানিত। পাশাপাশি, বিশ্বের সর্বত্র আমাদের আগামী প্রজন্মই হবে সকল অবলুপ্তমুখী মাতৃভাষা সুরক্ষার দীপ্ত প্রতীক, একুশের চেতনার দিশারী।

(চলবে)

(শেষ পর্বঃ বাঙালির করনীয় এবং প্রাপ্তিঃ উপসংহার)

লেখক পরিচিতিঃ নির্মল পালইমেইলঃ nirmalpaul@optusnet.com.au

প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারপারশনঃ      এমএলসি মুভমেন্ট ইনটারন্যাশন্যাল ইনক

প্রাথমিক নকশা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নকারী দলনেতাঃ      পৃথিবীর প্রথম “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ”

প্রকাশিত গ্রন্থঃ                           “বিশ্বায়নে শহীদ মিনার”

বৈশ্বিক দর্শনঃ                            “লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার”, (স্থানীয় বর্ণমালা সংরক্ষণ কেন্দ্র)