ফজলুল বারী:আজ ঐতিহাসিক ৪ ডিসেম্বর। ১৯৯০ সালের এ দিনে স্বৈরাচারী এরশাদের পদত্যাগ ঘোষনার সঙ্গে সঙ্গে দেশজুড়ে গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়ে যায়। কার্ফু উপেক্ষা করে লাখ লাখ মানুষ নেমে আসে ঢাকার রাস্তায়। তখন ক্রোধান্বিত জনতা এরশাদের দালাল-দোসরদের খুঁজতে থাকে। এরশাদ সেনানিবাসের বাড়িতে থাকায় তাকে হাতের কাছে পাওয়া সম্ভব ছিলোনা। মিন্টো রোডের মন্ত্রিপাড়ার বাড়িগুলো তখন সেনা সদস্যরা ঘিরে রাখায় সেদিকেও যাওয়া সম্ভব হচ্ছিলোনা। এর মাঝে খবর আসে রামপুরার টেলিভিশন ভবন থেকে পালিয়ে গেছেন ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ। মওদুদ তখন এরশাদের উপরাষ্ট্রপতি। দেশে তখন শুধু বিটিভিই ছিল। বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে মওদুদ তখন সংবিধান বোঝাচ্ছিলেন। কিন্তু ওই সময় যখন খবর আসে এরশাদ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং খবরটি জানার পর জনতা রাস্তায় নেমে এসে এরশাদের মন্ত্রীদের খুঁজছে, তখন সেখান থেকেই পালিয়ে যান ব্যারিষ্টার মওদুদ। কারন ছাত্রজনতা তখন এরশদের লোকজনকে হাতের কাছে পেলে শুধু মারধর করেনা কাপড়চোপড় খুলে দিগম্বরও করে দেয়। শহীদ মিনারে এমন ঘটনা ঘটেছে।
১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতে আরেকটি অভাবনীয় ঘটনা ঘটে। এরশাদের মন্ত্রীদের সঙ্গে পালিয়ে যান তার গৃহপালিত বিরোধীদলের নেতা আ স ম আব্দুর রবও। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেন রব। ১৯৯৭১ সালের ২ মার্চ তৎকালীন ডাকসু ভিপি হিসাবে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্র-গণসমাবেশে তিনি প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলেন। সেই আ স ম আব্দুর রব এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় গণবিরোধী অবস্থান নেন। ১৯৮৮ সালে দেশের সবগুলো রাজনৈতিক দল এরশাদের অধীনে নির্বাচন বর্জন করে। আর এরশাদের অর্থায়নে নাম সর্বস্ব ৭২ টি দল নিয়ে তিনি গঠন করেন সম্মিলিত বিরোধীদল কপ। এর অধীনে প্রধান সব দলের বর্জনের মুখে আ স ম আব্দুর রব হন সংসদের বিরোধীদলের নেতা। তার নাম হয় গৃহপালিত বিরোধীদলের নেতা। পৃথিবীর কোন দেশে কোন স্বৈরাচারের পতনের পর তার মন্ত্রী, দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি বিরোধীদলের নেতাও গণরোষের ভয়ে পালিয়েছেন, এমন দ্বিতীয় নজির নেই।
এরশাদের পতন ঘোষনার সেই রাতে আমরা রাজপথের তরুন সাংবাদিক। সিনিয়র সাংবাদিকদের বড় অংশ তখনও এরশাদের সুবিধাভোগী। কিন্তু এরশাদের এক ঘোষনায় তখন সব সংবাদপত্রে কর্মবিরতি শুরু হয়। এরশাদের সেই ঘোষনাটি ছিল পত্রিকায় যে কোন রাজনৈতিক সংবাদ প্রকাশের আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের যুগ্ন সচিবকে (রাজনৈতিক) তা দেখিয়ে পাশ করিয়ে নিতে হবে। এরশাদের ঘোষনাটির পর দেশের সব সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেলে আমরা রাজপথের তরুন সাংবাদিকরা টেলিগ্রাম পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেই। মোজাম্মেল বাবু’র সাপ্তাহিক পূর্বাভাসের পুরানা পল্টনের অফিস এবং নাইমুল ইসলাম খানের খবরের কাগজের জিকাতলার অফিসে এ দুটি টেলিগ্রাম পত্রিকার কাজ হয়। ৪ ডিসেম্বর এমন দুটি টেলিগ্রাম পত্রিকা বেরোয়। পরের দিনের টেলিগ্রামের কাজ চলার সময় এরশাদের পদত্যাগের খবর এলে জনতার সঙ্গে আমরাও চলে আসি রাজপথে। জনতার বিজয়োল্লাসের সেই রাতের স্মৃতি শুধুই তাদেরই আছে যারা সে রাতে রাজপথে ছিলেন। মওদুদ-রব সহ এরশাদের দোসরদের তখন শুধু জান বাঁচাতে পলায়নের স্মৃতি।
বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতির টানাপোড়েনে আজ এরশাদ ও তার দোসরদের অবস্থান কিন্তু আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই শিবিরেই। যেমন শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়ার মতো ড কামালও তখন এরশাদ বিরোধী বিজয়ী শিবিরে ছিলেন। বিএনপি জোটের জামায়াতকে ঠেকাতে এরশাদ এখন আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ মিত্র। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত পদটি এখনো এরশাদের। তখন দূর্নীতির মক্ষিরানী হিসাবে পরিচিত রওশন এরশাদ এখন বিরোধীদলের নেত্রী। এরশাদের উপ রাষ্ট্রপতি ব্যারিষ্টার মওদুদ, উপ প্রধানমন্ত্রী শাহ মোয়াজ্জেম এখন বিএনপির নেতা। রব-মান্না আজ এক শিবিরে। কিন্তু এরশাদের পতনের রাতে আ স ম আব্দুর রবকে হাতের কাছে পেলে মাহমুদুর রহমান মান্না এবং তার অনুসারীরা হয়তো মেরে ফেলতেন। সেই রব-মান্না দু’জনেই এখন বিএনপি-জামায়াত শিবিরের হরিহর আত্মা। আজকের রাজনীতির আরেক চরিত্র ডা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পক্ষেও তখন জনতার সমুদ্রে আসা সম্ভব ছিলোনা। কারন তখন স্বৈরাচারী এরশাদের দালাল হিসাবে চিহ্নিত ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত এরশাদ কিভাবে দেশের রাজনীতিতে হালাল হয়ে গেলো এর কিছু ব্যাখ্যা দেবো এ লেখায়। এরশাদের পতনের পর আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং বিএনপি নিয়ন্ত্রিত সংগ্রামী ছাত্রজোট সিদ্ধান্ত নেয় এরশাদের দালালদের কেউ আশ্রয় দেবেনা। এই সিদ্ধান্তের আলোকে এরশাদের জাদরেল দুই আমলা এম কে আনোয়ার এবং কেরামত আলী আওয়ামী লীগে যোগ দেবার জন্যে ধানমন্ডির বত্রিশ নাম্বার সড়কের বাড়িতে এলে শেখ হাসিনা তাদের দেখা দেননি। এরপর এই দু’জন সেখান থেকে বেরিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে বিএনপিতে যোগ দেন। পরবর্তিতে তারা বিএনপির এমপি এবং বিএনপি সরকারের মন্ত্রী হন। এরশাদ এভাবেই দেশের রাজনীতিতে আবার হালাল-জায়েজ হতে শুরু করে।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার বিএনপি ক্ষমতাসীন হলে মাগুরা উপনির্বাচনের অভিজ্ঞতায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে জাতীয় পার্টি-জামায়াতও এই আন্দোলনে শরীক হয়। এরশাদ তখন জেলে। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, ব্যারিষ্টার মওদুদ এরা সংসদে জাতীয় পার্টির এমপি। ১৯৯১ সালের জুলাই মাসের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু-আ স ম আব্দুর রবকে মন্ত্রী করে সরকারের নাম দেয়া হয় ঐক্যমত্যের সরকার। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু তখন সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে এরশাদের জামিনে মুক্তির ব্যবস্থা করেন। কিন্তু জেল থেকে বেরিয়ে এরশাদ মঞ্জুকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে চাপ দিলে জাতীয় পার্টি ভেঙ্গে যায়। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু জেপি নাম দিয়ে আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করেন। আর এরশাদ বিএনপির সঙ্গে গঠন করেন চারদলীয় জোট। এ অবস্থায় জনতা টাওয়ার দুর্নীতির মামলার রায় হলে আবার জেলে যান এরশাদ। রওশন এরশাদ হন জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন। এরশাদের কারামুক্তিতে খালেদা জিয়া আন্দোলনের কর্মসূচি দিতে রাজি না হওয়ায় চারদলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যায় এরশাদের জাতীয় পার্টি। খালেদা জিয়া তখন নাজিউর রহমান মঞ্জুরকে দিয়ে গঠন করান আলাদা জাতীয় পার্টি। বিজেপি নামের জাতীয় পার্টির এই ভগ্নাংশটি এখন আন্দালিব রহমান পার্থ’র নেতৃত্বে বিএনপির সঙ্গে আছে।
জনতা টাওয়ার দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় ২০০১ সালের নির্বাচনে এরশাদ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেননি। ওই নির্বাচনে জামায়াত নিয়ে ক্ষমতায় এসে বিএনপি জামায়াতের যুদ্ধাপরাধী নেতাদের মন্ত্রী করে। ২০০৬ সালের সম্ভাব্য নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই পক্ষই এরশাদের জাতীয় পার্টিকে কাছে টানার চেষ্টা করে। বিএনপির পক্ষে তারেক রহমান-লুৎফুজ্জামান বাবর তখন এরশাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। এরশাদকে খুশি করতে বিএনপি তখন তার স্ত্রী বিদিশাকে চুরির মামলায় গ্রেফতারও করে। এরশাদ অবশ্য শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের মহাজোটের পক্ষে অবস্থান নেন। উল্লেখ্য তখন ড কামাল হোসেন, অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীও তখন যোগ দেন মহাজোটে। ১/১১’র শাসনের পর এরশাদ মহাজোটে থাকলেও ড কামাল হোসেন, অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী আর মহাজোটে ফেরেননি অথবা ফিরতে পারেননি। ড কামাল হোসেন, অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী এই দু’জন অবশ্য তখন ১/১১’র সামরিক শাসনের পক্ষাবলম্বন করেছেন। ১/১১’র সামরিক শাসনের পক্ষাবলম্বন করতে গিয়ে মাহমুদুর রহমান মান্না-সুলতান মোহাম্মদ মনসুর পরবর্তিতে আওয়ামী লীগে তাদের অবস্থান হারান। এই দু’জন এখন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বিএনপি-জামায়াত জোটে যোগ দিয়েছেন। জামায়াতের মতো এরাও নির্বাচন করবেন বিএনপির ধানের শীষে।