ফজলুল বারী:গত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশের নির্বাচন কেন্দ্রিক খবরাখবরের মূল থিমটি হচ্ছে কোন প্রার্থীর মনোনয়ন পত্র বৈধ হিসাবে গ্রহন করা হয়েছে, বাতিল হয়েছে কার মনোনয়নপত্র। অথবা আপিলে কে বৈধ্যতা ফেরত পেয়েছেন কে পাননি। কাগজ ঠিক দেখে প্রার্থীর বৈধ-অবৈধ স্বরূপ অবশ্য বিশ্বজোড়াই দেখা হয়। বাংলাদেশের মতো দেশে দুর্নীতিবাজরা কাগজপত্র কিভাবে ঠিকঠাক করেন তা অবশ্য দেশের ওয়াকিফহালরা জানেন। তাদের পক্ষে তৈরি থাকেন মোটা টাকার উকিলরাও । কাগজ ঠিক কিনা এটি অবশ্য বাংলাদেশে শুধু নির্বাচনে না দৈনন্দিন নানা কাজেও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। প্রতিদিন রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে পুলিশ চালকের-গাড়ির কাগজপত্র ঠিক আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়ও বাচ্চারা এমন কাগজ পরীক্ষা করে দেখেছে। কাগজটি ভূয়া কিনা তা দেখার জ্ঞান খুব কম লোকজনের আছে। কিন্তু এসব কাগজের সিংহভাগ যে ভূয়া তা দেশের আমজনতা জানে। ভূয়া কাগজপত্রের অদক্ষ চালকদের কাছে দেশের পরিবহন ব্যবস্থা জিম্মি থাকায় দেশটির পথ নিরাপদ না। পথে প্রতিদিন নামছে লাশের মিছিল।
নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্যতা-অযোগ্যতা নিরূপনের একটি গাইড লাইন নির্বাচন কমিশন রিটার্নিং অফিসারদের দিয়েছে। আমাদের দেশের যারা এমপি হতে চান এমন অনেক লোকজন সারাদিন বক্তৃতায়, টকশোতে এমন স্মার্ট কথাবার্তা বললেও আদতে যে আনস্মার্ট তা মনোনয়নপর্বে আবার স্পষ্ট জানা গেছে। যেমন ধরুন অস্ট্রেলিয়ায় আমি প্ল্যানে একটা ফোন নেবো। ফোন কোম্পানির অফিসে সবার আগে আমার ক্রেডিট হিস্ট্রি চেক করা হয়। ফোন বা কোন অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে আমার কোন সমস্যা আছে কিনা তা নিশ্চিত হয়ে আমাকে তারা ফোন দেবে। এরপর তাদের টার্মস অব কন্ডিশন দেখে পড়ে তাতে রাজি এই মর্মে আমাকে স্বাক্ষর করতে হবে। স্বাক্ষর না করলে ফোন দেবেনা। ছোট একটা উদাহরন এখানে দিলাম। কিন্তু আমাদের বিজ্ঞ প্রার্থীদের অনেকে মনোনয়নপত্রে স্বাক্ষর করেননি অথবা স্বাক্ষর করতে ভুলে গেছেন! সংসদ নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার অন্যতম যোগ্যতা দুই বছরের বেশি ফৌজদারী দন্ডে দন্ডিত হলে প্রার্থী হতে পারবেননা। ঋনখেলাপিরা নির্বাচন করতে পারবেননা। আমাদের দেশের চতুর প্রার্থীরা নির্বাচনের আগে এসব কাগজপত্র সাফসুতরো করেন। কাদের সিদ্দিকীর মতো লোকজন করেননা। এ নিয়ে রাজনীতি করেন! জাতীয় পার্টির রুহুল আমিন হাওলাদারের মতো সরকারি জোটের প্রভাবশালী নেতা কেনো গত পাঁচবছরেও তা করলেননা তা অবাক বিষয় বৈকি। জাতীয় পার্টির এই দুর্নীতিবাজ নেতার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী আইনজীবী নেতা আব্দুল বাসেত মজুমদার! আমাদের এসব আইনজীবীদের টাকা দেখলে আর হিতাহিত জ্ঞান থাকেনা! তা ড কামাল হোক অথবা আব্দুল বাসেত মজুমদার হোক।
আমাদের রিটার্নিং অফিসাররা নির্বাচন কমিশনের দেখা গাইডলাইন অনুসরন করেই এসব বিষয় পরীক্ষা করে অনেকের মনোনয়ন গ্রহন করেননি। এসব গাইডলাইন হঠাৎ এই নির্বাচন উপলক্ষে তৈরি করাও নয়। অতীতের সব নির্বাচনেই এই গাইডলাইন অনুসরন করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কিন্তু এবারে এসব সিদ্ধান্ত দেখে একদল হৈ হৈ করে উঠলেন! বলা হলো এতো ছোটখাটো বিষয়ে মনোনয়নপত্র বাতিল করা হলো কেনো? আরে ভাইজানেরা সারা দুনিয়াতেই জনপ্রতিনিধিদের সবকিছুতেই সাফসুতরো দেখার নিয়ম। আমাদের দেশেই শুধু নিরীহ কলিমউদ্দিন ছলিমউদ্দিনের ছোটখাটো অপরাধে সাজা দেয়া হয়। মোটাউদ্দিনদের কোন অপরাধ নেই!
ক্রেডিটকার্ডের কোন কিছু বকেয়া থাকলে বিদেশে কি সমস্যা হয় তা অর্থনীতিবিদ রেজা কিবরিয়া ভালো জানেন। কিন্তু এখানে তিনি নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় তা ভুলে যাবেন তা কি করে হয়! মনোনয়ন বাতিলের পর বললেন বকেয়া শোধ করেছেন। এটি মনে মনে থাকলেতো হবেনা। বকেয়া শোধের রসিদও জমা দিতে হবে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী থাকতে ম্যালকম টার্নবুলের একটি ছবি ছাপা হয়েছিল পত্রিকায়। ব্যক্তিগত স্পিডবোটে বসে আছেন টার্নবুল। তার পরনে দৃশ্যমান ভেস্ট নেই। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার আইন হচ্ছে স্পিডবোটে দৃশ্যমান ভেস্ট পরে চড়তে হবে। তার ওই ছবি দেখে তাকে জরিমানার চিঠি পাঠায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। টার্নবুল এ নিয়ে কোন বাহাসে না গিয়ে দ্রুত ওই জরিমানা শোধ করেন। কারন এই জরিমানা শোধ না করলে ভবিষ্যতে কি সমস্যা হবে তা টার্নবুল জানতেন।
গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তিদের যে কোন অপরাধ বিদেশে এমন গুরুত্ব দিয়ে দেখার নিয়ম। সংশ্লিষ্টরা অপরাধ স্বীকার করে দ্রুত সেখান থেকে খালাস পাবার উদ্যোগ নেন। বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন। প্রভাবশালীরা এখানে নিজদের আইনের উর্ধে মনে করেন। তাদের খাদেমরাও হৈহৈ করে ওঠে বলেন, এমন ছোটখাটো কারনে তার মতো লোকের সঙ্গে এই আচরন! তাহলে দেশের আমজনতার অবস্থা কী বুঝতে পারেন! অথবা এটি সরকারি ষড়যন্ত্র ইত্যাদি! রিটার্নিং অফিসারদের মনোনয়ন বাতিলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের আপিলের আচরনটি ভালো লাগেনি। নির্বাচন কমিশনের ঠিক করে দেয়া গাইড লাইন অনুসরন করে রিটার্নিং অফিসাররা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর তা ৫-৬ মিনিটের শুনানিতে পালটে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন! তাহলে রিটার্নিং অফিসারদের কাছে গাইড লাইন দেয়া কেনো? আর কমিশন যাদের বৈধতা দিয়েছে তাদের সিংহভাগ যে সাফসুতরো ফুলের মতো পবিত্র না তা নির্বাচন কমিশনও জানে দেশের আমজনতাও জানে। এদের বেশিরভাগ বিআরটিএ’তে টাকা দিয়ে লাইসেন্স বের করার মতো অদক্ষ চালক। দুর্নীতির উপহার এসব চালকদের কারনে দেশের মানুষ অসহায়ের মতো রাস্তায় মরেন। আর কাগজ ঠিক করা অনেক অসৎ রাজনীতিকের কাছে জিম্মি দেশ। দেশের সিংহভাগ মানুষ আবার দুর্নীতিবাজ টাকাওয়ালা রাজনীতিকদেরই পছন্দ করে। এক গরিব আরেক গরিবকে দেখতে পারেনা অথবা মন থেকে ভালোবাসেনা।
বাংলাদেশের এই নির্বাচনে আরেকটি উক্তি বিএনপি-জামায়াত, তাদের নতুন ফোরাম ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বেশি বেশি বলছেন! ‘ যদি মানুষ ভোট দিতে পারে’! ‘যদি ভোট দেবার সুযোগ পায়’! গত নির্বাচনে এরা ভোট দিতে যায়নি কেনো? টকশোতে যে বিশিষ্ট এসব কথা বলেন তিনি ভোট দিতে যাননি কেনো? ড কামালগং ভোট দিতে যাননি কেনো? ভোট নিয়ে তখন কারা ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করেছিলো? অস্ট্রেলিয়ার বড় অংশের মানুষজন দেশটির রাজনীতি এবং ভোট নিয়ে আগ্রহী না। কারন কাজের বাইরে ওতো সময় তাদের নেই। কিন্তু এরপরও তারা ভোট দেয় অথবা ভোট দিতে এরা বাধ্য হয়। কারন এদেশে ভোট না দিলে জরিমানা হয়। বাংলাদেশে গত নির্বাচন বিএনপি-জামায়াত জোট বর্জন করেছিল। শুধু বর্জন নয়, ভোট প্রতিরোধের ঘোষনা দিয়েছিল। দেশজুড়ে তখন ধংসাত্মক ভয়ের একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়। আপনি ভোট বর্জন করতে পারেন। কিন্তু যারা ভোট দিতে চায় তাদের বিরুদ্ধে হিংসার কর্মসূচি কেনো দেবেন? গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোটারদের অনেকে হিংসাত্মক পরিস্থিতির কারনে ভয়ে ভোট দিতে যায়নি। আর বিএনপি-জামায়াতের সমর্থকরা ভোট দিতে যায়নি কারন তাদের এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তখন যারা পেট্রোল বোমা হাতে ভোটের বিরুদ্ধে ছুটে বেড়িয়েছে নিরীহ মানুষজন পুড়িয়ে মেরেছে তারাই এখন নানাভাবে বলছে যদি মানুষ ভোট দিতে যায়, যদি নির্ভয়ে ভোট দেবার সুযোগ পায়! ড কামালগংও এখন সেই সত্য বলছেননা। ভোটের পরিবেশ অনুকূল থাকলে ভোটতো সবদলের লোকজনই দিতে যাবে। বাংলাদেশে আবার ভোটে যে দল জয়ী হয়না নির্বাচন তাদের কাছে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ মনে হয়না। বিজিত দল ভোট নিয়ে প্রশ্ন তুলে তারা মূলত ভোটারদেরই অপমান করে।