বিএনপির ঘুরে দাঁড়াতে একজন শেখ হাসিনা দরকার

বিএনপির ঘুরে দাঁড়াতে একজন শেখ হাসিনা দরকার

ফজলুল বারী:ভেবেছিলাম ভোট নিয়ে আপাতত আর লিখবোনা। এখন আওয়ামী লীগ জোটের নতুন সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কী কী করা উচিত আগে তা নিয়ে দৃষ্টিপাত করা উচিত। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আমার স্বস্তির বড় কারন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরপূর্তি এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী এখন মর্যাদার সঙ্গে উদযাপন হবে। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় ফিরলে এ নিয়ে কেলেংকারির ঘটনা ঘটতো। মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী পাকিস্তানপন্থী দল জামায়াতে ইসলামীর কোন প্রতিনিধিত্ব নেই এরচেয়ে বড় স্বস্তিদায়ক দ্বিতীয় কোন খবর এই মুহুর্তে বাংলাদেশের মানুষের সামনে নেই। পদ্মা সেতু, মেট্রো সহ নানা স্মরনীয় স্থাপনা উদ্বোধন আওয়ামী লীগ সরকারের হাতেই হবে।
বাংলায় একটি গুরুত্বপূর্ন প্রবাদ বাক্য আছে, ‘এতোক্ষনে অরিন্দম কহিলা বিষাদে’। ভুল স্বীকার করে সত্য প্রকাশে বাক্যটি প্রতীকি অর্থে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোটটির নির্বাচনী ভুল স্বীকারের কোন প্রবনতা এখন পর্যন্ত নেই। নির্বাচন নিয়ে অনেক অভিযোগ আসছে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ নতুন নয়। দলীয় সরকার-তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোন আমলের কোন নির্বাচন প্রশ্নের বাইরে ছিলো? বিএনপির অঙ্কুরোদগমের প্রথম নির্বাচন ছিল জেনারেল জিয়ার হ্যাঁ-না নির্বাচন তথা রেফারেন্ডাম। সামরিক জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় থাকবেন কিনা তা নিয়ে রেফারেন্ডাম তথা গনভোট। দেশের কোন মানুষ সেই নির্বাচনে ভোট দিতে যায়নি। সামরিক ফরমান তখন নির্বাচন কমিশনে যায়। ফরমান পেয়ে প্রিজাইডিং অফিসার-পোলিং এজেন্টরা নিজেরাই ব্যালটে সিল মেরে বাক্স বোঝাই করেন। আমি তখন স্কুলে পড়তাম। এক শিক্ষক আমাদের বাচ্চাদের ভোট কেন্দ্রে নিয়ে যান ভোট দেবার জন্যে। এভাবে ৯৯% এরও বেশি ভোট পড়েছে দেখানো হয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন জালিয়াতির নির্বাচন আর দ্বিতীয়টি নেই। সেই দলটিই এখন দেশের মানুষকে সারাদিন গনতন্ত্র শেখায়!
নির্বাচনে বিএনপি জোটের মোটা দাগের ভুলগুলো কোথায় কোথায় ছিল তা ওপেন সিক্রেট। সবচেয়ে বড় সত্য বিএনপি বা এর জোটের নির্বাচনী কোন প্রস্তুতিই ছিলোনা। এটি ক্ষমতায় থাকার সময় সুযোগ সুবিধার লোভে যোগ দেয়া রাজনীতিকদের দল। আওয়ামী লীগকে কত কায়দা করে তারা একুশ বছর ক্ষমতায় রেখেছিলেন তা এর নেতারা ভুলে গেছেন। মাঠেঘাটে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এসেছে। মাঝে আবার ২০০১-২০০৬ মেয়াদে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে ছুঁড়ে ফেলা দেয়া হয়। কিন্তু তখন বাংলাদেশের চিহ্নিত দুই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী নিজামী-মুজাহিদের গাড়িতে পতাকা দিয়ে, হাওয়া ভবন নামের প্যারালাল শাসন সৃষ্টি করে, গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনা সহ প্রতিপক্ষের নেতাদের হত্যার চেষ্টা, এরপর আবার জজ মিয়া নাটক সাজিয়ে তা ধামাচাপা দেবার কায়দাকানুনে দলটি বাংলাদেশ শাসন করার নৈতিক অবস্থা হারায়। কিন্তু এই ক্রটিগুলোও বিএনপি কোনদিন স্বীকার করেনি। খালেদা জিয়ার সেই হুঙ্কার মনে আছে? গোপালগঞ্জের নামই পাল্টে দেবেন! আওয়ামী লীগই এমনভাবে ক্ষমতাচ্যুত করবেন যে যাতে দলটি আর ৪২ বছরেও ক্ষমতায় আসতে না পারে! আওয়ামী লীগই কী তখন গান গাইতে গাইতে বলবে, ‘এসো এসো ক্ষমতার ঘরে এসো, আমরা ৪২ বছরের জন্যে ক্ষমতার বাইরে চলে যাই’!
এবার বিএনপি জামায়াত জোটের প্রতিজ্ঞা ছিলো ‘শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশে কোন নির্বাচন হবেনা, হতে দেবোনা।‘ আর শেখ হাসিনার প্রতিজ্ঞা ছিল নির্বাচন তাঁর সরকারের অধীনেই হবে। দ্বিতীয় প্রতিজ্ঞা বিজয়ী হয়েছে। গত এক বছর আগে শেখ হাসিনা সিলেট থেকে নির্বাচনী প্রচারনা শুরু করেছেন। আর বিএনপিগং বলে যাচ্ছেন এমন নির্বাচন হতে দেবোনা। একটা রাজনৈতিক দল মাঠের কথাবার্তা বলে আবার নির্বাচন সহ নানাকিছুর প্রস্তুতিও নেয়। বিএনপির এর কিছুই ছিলোনা। খালেদা জিয়া জেলে যাবার পর বিএনপির নেতৃত্ব সমস্যায় পড়ে। লন্ডনে বসবাসরত তারেক রহমান হন দলটির নেতা। এ দলে অনেক সিনিয়র নেতা আছেন। কিন্তু পারিবারিক রাজনীতির কারনে তারা এমন এক নেতার ওপর নির্ভরশীল হলেন, যিনি স্কুল জীবনে ছাত্র হিসাবেও ভালো ছিলেননা। দেশের মানুষের কাছে তার ইমেজ ভালোনা। তিনি বিলাতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্যে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব-পাসপোর্ট ত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশের আইনের চোখে পলাতক হওয়াতে দেশের মিডিয়ায় তার বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নেতৃত্বের এসব নানা জটিলতা নিয়ে বিএনপি নির্বাচনে গেছে। নির্বাচনে গিয়ে সে চেয়েছে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড! অথচ দলটির নেতৃত্বেরই কোন লেবেল নেই। জোট গঠনের সময় ডক্টর কামাল বলে রেখেছিলেন, ‘তারেক রহমান সে লন্ডনে বসে কি করছে না করছে তার সঙ্গে জোটের কোন সম্পর্ক থাকবেনা’। অথচ বিএনপি জোটের বড় দল যার দেশজুড়ে নেতাকর্মী সমর্থক আছেন। ডক্টর কামালের দলের তা নেই। সেই ডক্টর কামাল যখন বিএনপির দ্বিতীয় প্রধান নেতা সম্পর্কে এই ঘোষনা দেন তাতে কী জোটের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হয়?
গত দশ বছরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় এর নানা তৎপরতায়, দেশের প্রধান সব মিডিয়ার ভূমিকায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নতুন একটি জনমত শক্তিশালী হয়েছে। বিশেষ করে নতুন ভোটার তরুনদের মধ্যে ইতিহাস বিকৃতির প্রভাব আগের মতো নেই। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ দেশের সবচেয়ে বিক্রিত গ্রন্থ। শেখ হাসিনার দৃঢ়তায় শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। বাতিল হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতের নিবন্ধন। সেই পরিস্থিতিতে জামায়াতের প্রার্থীদের নিয়ে প্রতারনামূলক ভূমিকা নেয় বিএনপি! তাদের ধানের শীষে প্রার্থী করা হয় বিএনপির পরিচয়ে! এমন কী মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ এলাকাতেও দেয়া হয় বিএনপির প্রার্থী। এ নিয়ে প্রশ্ন করলে ডক্টর কামাল ক্ষেপে গিয়ে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে হুমকি দিয়ে বলেন তাকে ‘চিনে রাখবেন, আগামীতে দেখে নেবেন, খামোশ!’ আবার নির্বাচনের আগ মূহুর্তে ভারতীয় পত্রিকায় থাকবে জানলে তিনি এই ঐক্যফ্রন্টে আসতেননা! ভোটে কিন্তু এর সবকিছুর প্রভাব পড়েছে।
বিএনপির মতো একটি দল ক্ষমতায় যেতে চায়, অথচ এই দলটির দ্বিতীয় প্রধান নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল মনোনয়ন বানিজ্যের! এ নিয়ে গুলশানে যে সব তান্ডব ঘটলো তাতো কূটনৈতিক এলাকার বাসিন্দা যাদের কৃপা চায় বিএনপি তারা চাক্ষুষ দেখেছে। তারেকের মনোনয়ন বানিজ্য নিয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অসন্তোষের ফোনকলের অডিও ফাঁস হলো। লোকবলহীন মান্নাদের আসন ক্ষুধা নিয়ে ফাঁস হয় এমাজউদ্দিনের ক্ষোভের টেলি অডিও! ভোটের বাজারে এসবের প্রভাবতো আছেই। ভোটাররা দেখেছে বিএনপি জোটের চাইতে আওয়ামী জোটের মনোনয়ন ভালো হয়েছে। মাশরাফি, তন্ময় বা নায়ক ফারুকের মতো কী বিএনপি জোটের একজন প্রার্থী ছিলেন যারা প্রচারে বেরুলে পিছনে মানুষের ঢল নামতো? বিএনপির কী তারকা শিল্পী কম আছেন যাদের কাউকে তারা প্রচারে নামাতে পারলোনা! সব মিলিয়ে বিএনপির পুরো টিমটাইতো ছিল অগোছালো অপ্রস্তুত এবং অভিযোগ মাষ্টার। সারাক্ষন তারা অভিযোগ করেই গেছে।
নির্বাচনী প্রচারনার প্রথম দিন থেকে একটা সংশয় ছিল বিএনপি জোট কখন নির্বাচন থেকে বেরিয়ে যায়! ডক্টর কামাল, মির্জা ফখরুল বিভিন্ন সময় ঘোষনা দিয়েছেন তারা মাঠ ছেড়ে যাবেননা। কিন্তু তা আস্থার সৃষ্টি করতে পারেনি। ভোটাররা দেখছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা সারাক্ষন মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন আর নানা অভিযোগ তুলে বিএনপির লোকজন মাঠে নেই। এসব নানা কারনে ভোটের আগেই একটি ধারনা তৈরি হয়ে যায় আবার ক্ষমতায় যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। এর কারনে ভোটের আগেই হেরে বসে যায় বিএনপি। তাদের ঘোষনা ছিল ভোটকেন্দ্র পাহারায় রাখা হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা পোলিং এজেন্টই দেয়নি অথবা দিতে পারেনি। যে সব কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট ছিল তাদেরকেও দুপুরের দিকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। যারা মাঠে ছেড়ে চলে যায় তাদের জন্যে ভোটাররা নিজের ভোটটি আর নষ্ট করেনি।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে অবিশ্বাস্য ম্যান্ডেট শুধু বিএনপি না আওয়ামী লীগকেও হতভম্ভ করেছে। যে বিদেশিদের প্রতি বিএনপির এত আস্থা তারা প্রতিযোগিতা করে এখন শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। এখন ফলাফল মেনে না নিয়ে বিএনপি উল্টো গেল মুখরক্ষার হাস্যকর পথে। যে নির্বাচন কমিশনের ওপর তাদের আস্থা নেই সেই কমিশনে স্মারকলিপি দিয়ে যারা ভোট বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন চেয়েছে! নির্বাচন কমিশন গঠন করবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার! এখন সব প্রার্থীরা মামলা করবেন নির্বাচনী ট্রাইবুন্যালে! এই সময়ে সব কাজকর্ম বাদ দিয়ে বসে থাকবে নতুন সরকার! দেশের লোক হাসানোরতো একটি সীমা আছে। বিএনপির ঘাড়ে এতোদিন ছিল জামায়াত আপদ। এখন ডক্টর কামাল, আ স ম আব্দুর রব, কাদের সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্না এমন যারা সওয়ার হয়েছেন তারা দেশের অনেকের কাছে অনেক মান্যিগন্যি ব্যক্তি। কিন্তু রাজনৈতিক নেতা হিসাবে তারা এদেশে চিহ্নিত ব্যর্থ। সে কারনে তাদের দলগুলোকে অনুবীক্ষন যন্ত্র দিয়ে দেখতে হয়। প্রতিষ্ঠার ২৯ বছর পর বিএনপির ঘাড়ে সওয়ার হয়ে চান্সে ইলিয়াস আলীর আসনে সূর্য মার্কায় একজন এমপি পেয়েছে গনফোরাম! এই জোটে এসে এটিই একমাত্র সাফল্য ডক্টর কামালের। বিএনপির কোন সাফল্য নেই। কিন্তু নিজেদের ভুলক্রটি চিহ্নিত-স্বীকার না করলে বিএনপিতে আগামীতে আরও অনেক ভুগতে হবে। জামায়াতের সঙ্গে গাটছড়া অটুট রেখে মনোনয়ন বানিজ্যের ব্যবসায়ী তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর কোন সুযোগ নেই। ঘুরে দাঁড়াতে চাইলে তাদের শেখ হাসিনার সমকক্ষ একজন নেতার খোঁজ বের করতে হবে।