ফজলুল বারী:সংরক্ষিত আসনের মহিলা এমপি হতে ইচ্ছুকদের নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে চলচ্চিত্র-নাটকের শিল্পীদের অনেকে আওয়ামী লীগের এমপি হবার আগ্রহে মনোনয়নপত্র কেনা নিয়ে অনেকেরতো এক রকম হৈহৈ অবস্থা! এই হৈহৈওয়ালাদের মধ্যে অনেকে আছেন আওয়ামী লীগ সহ এর নানান অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী। আমি অবশ্য এ নিয়ে বিশেষ উদ্বিগ্ন হবার মতোও কিছু দেখিনা। মনে করুন শেখ হাসিনা এমন কয়েকজনকে এবার মহিলা এমপি করলেন। তখন দেখা যাবে এই হৈহৈওয়ালারাই অন্য একসুরে হৈহৈ শুরু করেছে! তখন এরা যে শেখ হাসিনার বিরোধিতা করবে তা নয়। তখন এদের হৈহৈ’র সুর হবে, ‘নেত্রী কোন ভুল করতে পারেনা’, ‘এটাই নেত্রীর চমক’, ‘এটাই শেখ হাসিনা’, ‘লাভ ইউ জননেত্রী’ ইত্যাদি। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেলিব্রেটি তারকার আওয়ামী লীগের মহিলা এমপি হবার আগ্রহ প্রকাশকে আমি ইতিবাচক হিসাবে দেখি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারনে এক সময় শিল্পীরা এমন প্রকাশ্য রাজনৈতিক অবস্থান নিতে চাইতেননা। এখন যে অবস্থা পাল্টেছে এটি এর একটি সিম্বলিক চিত্র।
মৌসুমীর সঙ্গে তারেক রহমানের ছবি আছে বলে আপনি তাকে কুৎসা ছড়িয়ে বিদায় করতে পারেননা। কারন পেশাদার শিল্পী হিসাবে মৌসুমী তখন ছিলেন তারেকের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের পন্যের মডেল। এরজন্যে তাকে তারেকেদের অনুষ্ঠানেও যেতে হয়েছে। মৌসুমী যে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছেন তাতে তার এমন নতুন একটি ছবি সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তখন কী মৌসুমীর ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ দেখে মুগ্ধ হননি? সেই মৌসুমী এখন ইন্টারভ্যু দিয়ে বলেছেন তার রাজনীতিতে আসার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে, শেখ হাসিনাকে দেখে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এ বিষয়টাকেও ইতিবাচক হিসাবে দেখতে পারেন। আওয়ামী লীগের নানাকিছুর কঠোর সমালোচক হয়েও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে আমিও মুগ্ধ হই। একজন সৎ এবং আন্তরিক মিশন-ভিশনধারীর বডি ল্যাঙ্গুয়েজই এমন হয়।
গত নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ অনেক সেলিব্রেটিদের নিয়ে প্রচারনামূলক বিজ্ঞাপন ফিল্ম বানিয়ে প্রচার করেছে। এদের অনেকে ছিলে সিনেমা এবং নাটকের সেলিব্রেটি শিল্পী। দেশের মানুষের কাছে তাদের গ্রহনযোগ্যতা আছে বলেইতো তাদের দিয়ে এসব বিজ্ঞাপন ফিল্ম বানিয়ে প্রচার করা হয়েছিল। কিন্তু তাদের কেউ কেউ বা তাদের দেখাদেখি অনেকে যদি মহিলা এমপি হবার আগ্রহ প্রকাশ করে থাকেন তাহলে তাদের গ্রহনযোগ্যতা কমে গেলো বুঝি? পুরনো দিনের বাংলা একটি সিনেমার সংলাপের কথা মনে পড়ে গেলো। যেখানে নায়িকা বলছে, ‘আমিতো বুনো ফুল। বনে সুন্দর দেখায়। কিন্তু তা দিয়ে ঘর সাজানো যায়না’। এমন সময় ছিল বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম দিকের ছবিগুলোর জন্যে নায়িকা আনতে হতো পতিতাপল্লী থেকে। সো-কল্ড ভদ্র পরিবারের মেয়েরা অভিনয়ে আসতে পারতেননা বলে ছেলেকে মেয়ে সাজিয়েও পাড়ার নাটক অথবা যাত্রাপালা হতো। ঘেটুপুত্র কনসেপ্টটাও তখনকার। এখনতো পরিবর্তিত সময়। আগে সিনেমার নায়িকাদের পরিচালক-প্রযোজকদের মন পেতে বিছানায়ও যেতে হয়েছে। মুখ বুঝে অনেকে সহ্য করেছেন অনেক নিগ্রহ। কিন্তু এখন কী তা সম্ভব? এখনতো মী-টু আন্দোলন আছে।
বাংলাদেশের এই সংরক্ষিত আসনের মহিলা সদস্যদের শুরুটাও আজকের মতো এমন মসৃন ছিলোনা। এরশাদ আমলে সংসদে এমন এমপি ছিলেন তিরিশ জন। এদের অনেকে এরশাদের বান্ধবী অথবা তাকে দেহদান করেছেন এমন যোগ্যতাও এমপি হয়েছেন। শফিক রেহমান তার যায়যায়দিন পত্রিকায় এদের তিরিশ সেট অলংকার লিখে মহাবিপদে পড়ে যান। তার যায়যায়দিন নিষিদ্ধ হয়। দেশত্যাগে বাধ্য হন শফিক রেহমান। আমরা বিচিন্তায় এদের মুখোশ উন্মোচনের ভিন্ন পন্থা নেই। শফিক রেহমানের মতো তাদের তিরিশ সেট অলংকার না লিখে তাদের ইন্টারভ্যু করে ছাপতে শুরু করি। আমাদের টিমের রোকেয়া বেগম নামের এক নতুন রিপোর্টারের নামে সেগুলো ছাপা হতো। রোকেয়া তাদের এপোয়েন্টমেন্ট করতেন, আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। আমাদের সঙ্গে থাকতো সনি’র পেন্সিল ব্যাটারি চালিত সেই সময়ের মাইক্রো রেকর্ডার। মহিলা এমপির সামনে বসেই রেকর্ডার অন করে শুরু হয়ে যেতো ইন্টারভ্যু। প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন আসতো। যেমন একজনকে একদিন প্রশ্ন করেছিলাম, দেশের শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ-প্রসার নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী? উত্তর আসে, অনেক পরিকল্পনা। কারন এ নিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা আমার। কারন আমিতো কুটির শিল্পেও কাজ করেছি। অনেকে ইন্টারভ্যু দিতে এমন সব পোশাক পরতেন তা আমাদেরকেও বিব্রত করতো। এমন একজন একদিন প্রসঙ্গ ছাড়াই বলেন, স্যারের জন্যে তার নিদ আসেনা। স্যার আর কবে তাকে ডাকবেন সে আশায় তার রাত পার হয়। আমরা ইন্টারভ্যুতে পোশাক সহ এর সবকিছুর বর্ননাই মজা করে লিখতাম।
বিচিন্তার সেই মহিলা এমপিদের ইন্টারভ্যুগুলো তখন খুব পাঠকপ্রিয় হয়েছিল। কিন্তু পরে জাতীয় পার্টি সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের মহিলা এমপিদের বিচিন্তাকে ইন্টারভ্যু দিতে নিষেধ করে। নতুন কাউকে ইন্টারভ্যুর জন্যে ফোন করলেই জবাব আসতো, জানি জানি সব জানি। একটা মেয়ে ফোন করে এপোয়েন্টমেন্ট নেয়। ইন্টারভ্যুর সময় সে চুপচাপ বসে থাকে। সঙ্গের ছেলেটাই বদের হাড্ডি। সেই সব উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করে। এরশাদের পতনের পর বিএনপি ক্ষমতায় এলে মহিলা এমপি নির্বাচনে কিছুটা পরিবর্তন আসে। বিএনপি-আওয়ামী লীগ সবাই যার যার দলের ত্যাগী নারী নেত্রীদের এমপি করার বিষয়ে অগ্রাধিকার দেয়। জামায়াতেরও তখন দু’জন মহিলা এমপি ছিল। বোরকা পরে তারা এমনভাবে সংসদে আসতেন যেতেন তাদের চোখ ছাড়া আর কিছু দেখা যেতোনা।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ, ২০০১ সালে বিএনপি, ২০০৮ সালে আবার আওয়ামী লীগ সংসদের কর্তৃত্ব পেয়ে দলের ত্যাগী নারী নেত্রীদের অনেককে মহিলা এমপি করেছে। এই বিবেচনায় সাংবাদিক বেবী মওদুদও মহিলা এমপি হয়েছেন। শেখ হাসিনা এবং ১৪ দলের নেতারা ২০০৮-২০১৪’র সংসদে শহীদ জায়া, শহীদ পরিবারের সদস্যাদেরও মহিলা এমপি করেন। জাসদ মহিলা এমপি করেছে কর্নেল তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহেরকে। ওয়ার্কার্স পার্টি তাদের দীর্ঘদিনের রাজপথের নেত্রী হাজেরা সুলতানাকে মহিলা এমপি করেছে। বাংলাদেশের চলতি সংসদীয় কাঠামোয় এলাকার উন্নয়নযজ্ঞে মহিলা এমপিদের অংশগ্রহনের সুযোগ কম। কিন্তু এমপি হিসাবে তারা নিয়মিত বেতন ভাতা সহ আনুষঙ্গিক অর্থনৈতিক সুবিধাদি পান। সে কারনে শহীদ পরিবারের সদস্য অথবা ত্যাগী সৎ অনেক নেত্রী বা প্রয়াত নেতার স্ত্রীকে এমপি করাতে তাদের পরিবারগুলোও উপকৃত হয়েছে। সরাসরি দলের জন্যে হয়তো তাদের অনেকের কন্ট্রিবিউশন ছিলোনা। কিন্তু তাদের পরিবারের প্রয়াত সদস্য যিনি দলের জন্যে কাজ করতে করতে জীবন দিয়েছেন, কোনদিন কিছু চাননি-পাননি, তার মৃত্যুর পর পরিবারটি সমস্যায় পড়ে যায়, এমন নেতার স্ত্রী-কন্যাকে মহিলা এমপি করা মানে এক ধরনের মরনোত্তর সম্মাননা। দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের যে তালিকাটি শেখ হাসিনার কাছে আছে।
চলচ্চিত্র তারকাদের মধ্যে তারানা হালিম শেখ হাসিনার প্রথম মনোনীত মহিলা এমপি। বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের ব্যানারে তারানা অবশ্য আগে থেকেই মাঠে-ময়দানে আওয়ামী লীগের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে চলচ্চিত্র তারকা কবরীকে মনোনয়ন দিয়ে শেখ হাসিনা তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনে জয়ী করে সংসদে আনেন। কবরী বাংলাদেশের সংসদের প্রথম এমপি যিনি চলচ্চিত্র জগত থেকে নির্বাচিত। কিন্তু কবরীতো শুধু চলচ্চিত্রের একদার লাস্যময়ী নায়িকা না। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকাও ছিলো। একাত্তরে আগরতলা পৌঁছবার পর সেখানকার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নেতারা তাকে কলকাতা পাঠিয়ে দেন। বাংলাদেশের যে সব শিল্পীরা মুক্তিযুদ্ধের নানা কাজ করেছেন কবরী ছিলেন সে টিমের সদস্য। শেখ হাসিনা এসব মনে রাখেন। যেমন এবার সংসদে আনা হয়েছে কবরী-ফারুক জুটির সবচেয়ে হিট ছবি সুজনসখী’র সুজন তথা নায়ক ফারুককে। অতএব চলচ্চিত্র তারকারা শুধু সংরক্ষিত আসনে না, মনোনয়ন দিলে নির্বাচিত হয়ে আসার যে যোগ্যতা রাখেন, কবরী-ফারুক এর দৃষ্টান্ত।
কাজেই এবার চলচ্চিত্র আর নাটকের তারকারা যখন মহিলা এমপি হবার ইচ্ছায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ নিয়ে আওয়ামী লীগেরই অনেকে হৈহৈ করে উঠেছেন তা দেখে খুব দৃষ্টিকটু লেগেছে। বলা হচ্ছে ত্যাগী নেত্রীদের অগ্রাধিকারের কথা। সেটিতো শেখ হাসিনা দেখবেন। আর জাতীয় সংসদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বা রাজনৈতিক দলগুলো কী দেখে দেখে শুধু ত্যাগী নেতাদের মনোনয়ন দেয়? শেখ হাসিনারতো ঘোষনাই আছে নির্বাচনে জয়ের জন্যে অনেক সময় প্লেয়ার হায়ার করেও আনতে হয়। মাশরাফি বিন মোর্তজা নিশ্চয় আওয়ামী লীগের কোন ত্যাগী নেতা-কর্মী না। তাকে হায়ার করে আওয়ামী লীগ যে কোন ভুল করেনি তাতো নির্বাচনেই প্রমান হয়েছে। সারা বাংলাদেশের আর কোথায় কোন প্রার্থীর পিছনে দেশের মানুষ হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো পিছনে পিছনে ছুটেছে? আওয়ামী লীগের চিহ্নিত অনেক নেতাকর্মীর চাইতে আবেদনময়ী বলেইতো চলচ্চিত্র-নাটকের শিল্পীদের নিয়ে বিজ্ঞাপন ফিল্ম বানানো হয়েছে। ফেরদৌস-রিয়াজকে প্রচারটিমে সঙ্গে রেখেছিলেন শেখ হাসিনা। চলচ্চিত্র-নাটকের অনেক শিল্পী বিভিন্ন শহরে গিয়ে ট্রাকে ঘুরে বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালিয়েছেন। তাদের কাজে লাগালেন আর তাদের কেউ যদি এমপি হতে চাইলো তখন শুরু হলো হৈহৈ! এতো সেই বুনো ফুলের গল্প!
আমারতো ধারনা শেখ হাসিনা এবার সেলিব্রেটি শিল্পীদের নতুন তালিকার মধ্য থেকে দুই বা তিনজনকে মহিলা এমপি করতে পারেন। পুরনোদের মধ্যে আবার এমপি হতে পারেন তারানা হালিম। নতুনদের মধ্যে আসতে পারেন শমী কায়সার, রোকেয়া প্রাচী। আনোয়ারার মতো শিল্পী যার এখন জীবন চলে শেখ হাসিনার দেয়া ভাতার টাকায় তাকে অথবা এমন কাউকে যদি মহিলা এমপি করা হয় তা কী কোন দোষের হবে? আমারতো মনে হয়না। এমন ত্যাগী নারীদের মূল্যায়ন হলে ভালো লাগবে। দৃষ্টান্ত হবে। সুপ্রিয়া দেবীর কথা মনে পড়ে গেলো। জহির রায়হানের স্ত্রী। বেঁচে থাকলে তাকেও এমপি করতে বলতাম। শিল্পীদের মাঝে যারা এমপি হবার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, যারা করেননি, অথচ নির্বাচনের কাজ করেছেন, আওয়ামী লীগ তাদেরকে নিয়ে একটি কালচারাল পুলের কাঠামো গড়ে তুলতে পারে। এতে দলের ভালো হবে। শিল্পীদের ভালো হবে।
আরেকটা বিষয়ের জন্যে অপেক্ষা করছি। তৃতীয় লিঙ্গের কাউকে যদি মহিলা এমপি করা হয় তা হবে একটি বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত। এমন সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনার পক্ষেই নেয়া সম্ভব। যদিও আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতাকর্মী এখনও এ ব্যাপারে প্রস্তুত নয়। মুখে প্রকাশ্যে নেত্রী নেত্রী জপমালা গাইলেও ভিতরে ভিতরে এদের সিংহভাগ পুরুষতন্ত্রের পুজারী।