ফজলুল বারী:টানা তৃতীয় মেয়াদে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের মধুচন্দ্রিমা চলছিল। নতুন মেয়াদে প্রথম বিদেশ সফরে বেরিয়ে জার্মানি, সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর শেষে ফুরফুরে মেজাজে দেশে ফিরেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়। বাংলাদেশে বিনিয়োগের নতুন প্রতিশ্রুতি-চুক্তির পাশাপাশি শ্রম বাজারের জন্যেও মরুর দেশটি আমাদের জন্যে হয়ে উঠেছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ন। প্রধানমন্ত্রীর সফরের সুবাদে দেশটায় বাংলাদেশের নতুন করে জনশক্তি পাঠানোর নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। সাধারনত প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। দেশের রাজনীতির নতুন বাক পরিবর্তন অথবা প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা-নিন্দার জন্যেও এসব সংবাদ সম্মেলন গুরুত্বপূর্ন হয়। ডক্টর কামাল, মির্জা ফখরুলরাও প্রধানমন্ত্রী বডি ল্যাংগুয়েজ দেখে প্রতিক্রিয়া দেবার জন্যে এ সংবাদ সম্মেলনের অপেক্ষা করেন।
নতুন মেয়াদের সরকারের প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন নিয়ে এবার ব্যতিক্রমী প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারকে সাজানো হয়েছিল ভিন্ন সাজে। দেশের টিভি চ্যানেলগুলো একুশের প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর পুষ্পার্ঘ অর্পনের পর্বটি লাইভ সম্প্রচার করে। এবারেও সব প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু মূহুর্তে পালটে যায় সব আয়োজন। সব মনোযোগ। আগুন তখন দাউ দাউ জ্বলতে শুরু করেছে ঢাকার চকবাজারে। একুশের প্রথম প্রহর গড়িয়েছে ঠিক। কিন্তু সবার উদ্বেগের চোখ তখন চকবাজারের আগুনে। টিভির লাইভ সম্প্রচারে শহীদ মিনারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তাড়াহুড়া করতে দেখি। পত্রিকায় ছাপা হয়েছে উদ্বেগে সারারাত ঘুমাতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী। নিদ্রাহীন থেকে সারারাত পরিস্থিতি মনিটর করছিলেন, প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছিলেন। বাংলাদেশের এই প্রধানমন্ত্রী এ রকমই। সবকিছুতে সিরিয়াস। তাঁর এই ভূমিকা তাঁকে আজকের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।
একুশের সকালে যখন একেরপর এক লাশ আসতে থাকে হাসপাতালের মর্গে তখন প্রথম আমরা ঘটনার ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারনা পেতে শুরু করি। গুলশানের হলি আর্টিজেনে কমান্ডো অপারেশন সম্পন্নের পর আমরা জেনেছি ভেতরে অতজনকে জবাই করে করা হয়েছে। চকবাজারের একুশে সকালেই যখন জ্বলেপুড়ে অঙ্গার একটি ভবনের নীচতলা থেকে অনেকগুলো পুড়ে যাওয়া বীভৎস লাশ উদ্ধার করা হয় তখন আমরা জানতে শুরু করি অতিক্রান্ত রাতটি কতোটা ভয়াল ছিলো। এর আগে সারারাত ধরে যে সব টিভি সাংবাদিকরা লাইভ সম্প্রচারের সঙ্গে ছিলেন বাস্তব অবস্থার কারনে তারা ছিলেন ঘটনাস্থল থেকে বেশ দূরে। দাউদাউ আগুনের সঙ্গে আমরা থেমে থেমে বিস্ফোরনের ফুলকি দেখছিলাম। আমার এসব প্রিয় প্রজন্ম ছোট ছোট ছেলেমেয়ের পরিশ্রমী রিপোর্টসব যখন দেখি তখন গর্বে মন শুধু বড় হয়। এসব বড় ঘটনার সরেজমিন কভারে এই ছেলেমেয়েদের মতো আমাদের মিডিয়াও অনেক দক্ষতা অর্জন করেছে-করছে। কোন কোন ক্ষেত্রে বাড়াবাড়িও হয়। হাসপাতালের ভিতর হুড়মুড়িয়ে ক্যামেরা হাতে ঢুকে যাওয়া যায়না। এটি সাংবাদিকতার অধিকার না। অনাচার। শুধু হাইজিনিক ঝুঁকি নয়, রোগী-তাদের স্বজনদের প্রাইভেসিও গুরুত্বপূর্ন। তবে প্রধানমন্ত্রীর খবরের চাইতে চলমান মেজর ঘটনার গুরুত্ব যে অনেক অনেক বেশি তা এখন অনুধাবন করতে শুরু করেছে আমাদের মিডিয়াও। এরজন্যেও বাংলাদেশের গনতন্ত্র অনেক মজবুত-শক্তিশালী হবে।
চকবাজারের ভয়াল আগুন নেভাতে ফায়ার ব্রিগেডের লোকজন তাদের নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও নজিরবিহীন পরিশ্রমের নজির দেখিয়েছেন। কিন্তু যানজট আর সরু রাস্তা পেরিয়ে ফায়ার ব্রিগেড যখন সেখানে পৌঁছলো সেখানে কোন পানির ব্যবস্থা নেই। পুরো পুরনো ঢাকার বেশিরভাগ অলিগলি যে বিপদজ্জনক দাহ্য পদার্থ ক্যামিকেলের গুদাম-আড়ত ভর্তি তা সবাই জানেন। কিন্তু ফায়ার ব্রিগেডের লোকজন এমন একটি গন্তব্যে যখন পৌঁছলো তাদের সঙ্গে রাসায়নিকের আগুন নেভানোর কোন ব্যবস্থা ছিলো কী? রাসায়নিকের আগুনতো পানি ছিটিয়ে নেভানো সহজ-সম্ভব নয়। বাংলাদেশের প্রতিটি ঘটনার পর যা শুরু হয় ভয়াবহ এই ঘটনার পরও এর ব্যাত্যয় ঘটেনি। শুরু হয়ে গেল তদন্ত কমিটি গঠনের হিড়িক। বাংলাদেশের এসব তদন্ত কমিটির ওপর মানুষের আস্থা নেই। প্রকৃত ঘটনা আড়াল করতে দায় এড়াতে এগুলো কাজ করে। আগুন সেখানে সরকার লাগায়নি। সরকারি দলের কেউ লাগায়নি। কিন্তু দায়তো সরকারের। বিদেশে রাস্তায় গুরুত্বপূর্ন ভবন নির্মানের সময়ও অগ্নি নির্বাচনের ব্যবস্থাগুলো নিশ্চিত করা হয়। কলকাতার মতো শহরেও এসব নিশ্চিত করা হয়েছে ব্রিটিশ আমলে। বাংলাদেশে নেই। কেনো এসব নিয়ে উদাসীনতা এর জবাব সংশ্লিষ্টদের দিতে হবে।
করুন ওই পরিস্থিতিতে নতুন শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ হুমায়ুনের ভূমিকাটি আমাকে হতাশ করেছে। হুমায়ুন ভাই পোড়খাওয়া রাজনীতিক। তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক। যুবলীগের চেয়ারম্যানও ছিলেন। শেখ হাসিনা তাকে সম্মান দিয়েছেন। কিন্তু এবার তিনি তড়িঘড়ি যা করলেন বললেন, তা যেন বাংলাদেশের গড়পড়তা একজন মন্ত্রীর মতো! না বাংলাদেশের কাঠামোটাই এমন যে একজন মন্ত্রী হয়ে গেলেই যেন অপ্রয়োজনীয় এলোমেলো কথাবার্তায় তিনি দক্ষতা অর্জন করেন কীনা! তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করতে পারলোনা। আর তিনি বলে দিলেন ওখানে রাসায়নিকের কোন গুদাম নেই! রাসায়নিকের কারনে আগুন লাগেনি। ওখান থেকে রাসায়নিকের কোন ব্যবসায়ীকে উচ্ছেদ করা হবেনা, এটা পুরনো ঢাকার ঐতিহ্য ইত্যাদি ইত্যাদি!
কিন্তু এখনতো লাগোয়া রেষ্টুরেন্টের ফুটেজ থেকে জানা গেলো আগুনের উৎপত্তিস্থল ছিল রাসায়নিকের ভবনে। প্রথম আগুন পড়েছে ভবন থেকে। এরপর মূহুর্তে রাস্তায় এবং পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে আগুন। নীচে চার রাস্তার মোড়ে সেখানে যানজটে অনেক গাড়ি-রিকশা-ভ্যান সহ নানাকিছু ছিল সেখানে। সে সব গাড়িতে-ভ্যানে গ্যাস সিলিন্ডারও ছিলো। মুহুর্তে সব আগুনের শিকার হয়। আর গ্রেনেড-ডিনামাইটের মতো একেরপর এক ফুটেছে রাসায়নিকের নানান সরঞ্জাম। আগুন শুধু আকাশ ছুঁতে চেষ্টা করেছে। সারা পুরনো-নতুন ঢাকার নানা অংশের মতো সেখানেও মাথার ওপর ছিলো জালের মতো বিদ্যুতের তার। যানজটে আটকা মানুষ এভাবে রাস্তার ওপর, আশেপাশের ভবনের বারান্দায় পুড়ে অঙ্গার হয় এটি জনবহুল বাংলাদেশের ভয়ের নতুন দৃষ্টান্ত। রাসায়নিকের উপস্থিতির কারনে সেটির ধংসযজ্ঞ কতোটা ভয়াবহ হয়েছে এটা বলেছেন ফায়ার ব্রিগেডের লোকজন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি ও বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন প্রথমদিনই বলেছেন পোড়া রোগীদের জখম দেখে তাঁর ধারনা হয়েছে এসব রাসায়নিকের আঘাত। ঘটনার পরও পুড়ে যাওয়া ভবনের বেসমেন্টে পাওয়া গেলো বিপদজ্জনক দাহ্য ক্যামিকেলসের বিশাল মজুদ! আর আগবাড়িয়ে তড়িঘড়ি মন্ত্রী সাফাই গেয়ে রায় দিয়ে দিলেন এ ঘটনা রাসায়নিকের নয়! প্রিয় মন্ত্রীকে সাবধান করছি। একজন মন্ত্রীর এমন কথাবার্তায় জনগন ক্ষুদ্ধ হয়। বিব্রত হয় সরকার। সবকিছুর দায়-ঝাঁঝ গিয়ে পড়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর।
কাজেই তাঁর এমন কিছু বলা উচিত নয় যা তাঁকে সুযোগ দেয়া প্রধানমন্ত্রীকে বিব্রত করে। এমন বিব্রত যারা করেন তাদের প্রধানমন্ত্রী এক পর্যায়ে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেন। এবার কাদের কাদের বাদ দিয়ে নুরুল মজিদ হুমায়ুনদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভায় নিয়েছেন তা তাঁরা যাতে ভুলে না যান। এই বয়সে এভাবে বাদ পড়লে রাজনীতিক হিসাবে অপমান বুঝতে পারবেন হুমায়ুন ভাই। লতিফ সিদ্দিকী, শাহজাহান খানও বাদ পড়েছেন। শাহজাহান খানকে একটি কমিটিতে নেয়াও দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় চলছে। অতএব সাবধান। মন্ত্রিত্ব ক্ষণস্থায়ী। অপমান দীর্ঘস্থায়ী। ঘটনার চব্বিশ ঘটনার মধ্যে অবশ্য মন্ত্রী তাঁর বক্তব্য পরিবর্তন করেছেন। শুক্রবার রাতে একাত্তর টিভিকে তিনি বলেছেন তদন্ত কমিটির রিপোর্ট হাতে আসার পর বলা যাবে অগ্নি ধংসযজ্ঞের আসল কথা। কিন্তু ক্ষতি যা করার তাতো তিনি এরমাঝে করে ফেলেছেন।
এই ধংসযজ্ঞের পর পুরনো ঢাকা যে বারুদের স্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে সে তথ্যও চলে এসেছে সামনে। বিস্ফোরক অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেছেন পুরনো ঢাকার এসব রাসায়নিকের ব্যবসায়ীরা তাদের কাছ থেকে লাইসেন্স নেননি। এই বক্তব্যটি দেশের মানুষের সঙ্গে প্রতারনামূলক। কারন এসব রাসায়নিক বিদেশ থেকে আমদানি হয়ে আসে। যাদের এ ব্যবসার লাইসেন্স নেই তারা বিদেশ থেকে তা আমদানি করে কী করে? তা কী মন্ত্রণালয়ের লোকজনের সঙ্গে দুর্নীতি করে? অথচ এ ব্যবসার লাইসেন্সতো তাদের বিস্ফোরক অধিদফতরের কাছ থেকেই নেবার কথা। এই কর্মকর্তা এও বলেছেন লাইসেন্সবিহীন এসব অবৈধ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অধিদফতর গত এক বছরের বেশি সময় ধরে কোন অভিযান চালায়নি! একেতো লাইসেন্স নেই, এর ওপর আবার পুরনো ঢাকার মতো একটি গিঞ্জি জনবহুল এলাকায় কোন পরিবেশে রাসায়নিকের কারখানা-আড়ত এর কোনটাই বিস্ফোরক অধিদফতরের জবাবদিহির মধ্যে নেই! এখন চকবাজার ট্র্যাজেডির পর ওবায়দুল কাদের বলছেন এসব ব্যবসা পুরনো ঢাকা থেকে সরিয়ে নেয়া হবে। এর আগে মেয়র সাঈদ খোকন বারবার ঘোষনা দিয়েও এদের সরাতে পারেনি। এর আগে রাসায়নিক ব্যবসায়ীদের বাধার মুখে মেয়রের উদ্যোগ পন্ড হয়। এখন নতুন ট্র্যাজেডির পর রাসায়নিকের ব্যবসায়ীরা বলছেন সরকার জায়গা দিলে তারা এখনই চলে যাবেন। বাংলাদেশ অবাক এক দেশ। এখানে লোকজন নিজের উদ্যোগে ব্যবসা করেন মুনাফা করেন। আর তাদের দিয়ে কোন ক্ষতির ঘটনা ঘটলে বলা শুরু করেন, জায়গা দেন জমি দেন চলে যাবো!
নিমতলী ট্র্যাজেডির পর পুরনো ঢাকার রাসায়নিকের ব্যবসা কেরানী গঞ্জে সরিয়ে নেবার কথা হয়। তখন বলা হয় ২০২২ সালের মতো এদের সেখানে সরিয়ে নেবার কাজ শেষ হবে। এরজন্যে জমিটি যখন দেখা হয় সেটি পানির নীচে ছিল। এখনো সেটি পানির নীচে। তাহলে গত ৯-১০ বছর এ নিয়ে শিল্প মন্ত্রনালয় কী করেছে এর কোন উত্তর নেই। সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুকে এ নিয়ে কী জবাবদিহির উদ্যোগ নেয়া হবে? এখন আবার ৭০ জন মরার পর আবাসিক এলাকা থেকে ঘাতক এই ব্যবসায়ীদের সরিয়ে নেবার কথা বলা হচ্ছে। এখন কোথায় নেয়া হবে এর কোন সাফ বক্তব্য নেই। তবে কী চকবাজার ট্র্যাজেডি ভুলতে শুরু করলেই সবকিছু চলতে থাকবে আগের মতো করে? সব এলোমেলো কথাবার্তা। নিমতলী ট্র্যাজেডি পুরনো হবার সব প্রতিশ্রুতি চাপা পড়ে গিয়েছিল। চকবাজার ট্র্যাজেডির পর বেরিয়ে এসেছে চাপা দেয়া সব কফিন। চকবাজার ট্র্যাজেডিও চাপা পড়ে যাওয়ার সমূহ দূর্ভাবনা। কারন বিস্ফোরক অধিদফতর হয় অথর্ব নয়তো দুর্নীতিবাজ। বাংলাদেশের আর সব মন্ত্রনালয়ের মতো শিল্প মন্ত্রনালয়ও দুর্নীতির আখড়া।
এবার কিছু কড়া কথা বলি। অতিরিক্ত জনসংখ্যায় ন্বুজ বাংলাদেশে, বিশেষ করে পুরান ঢাকায় প্রতিদিন এক বা একাধিক চকবাজারের ঘটনা ঘটার মতো পরিবেশ আছে। প্রতিদিন যে এমন ঘটেনা সেটিই বড় খবর। বুড়িগঙ্গার তীরে যখন ঢাকা শহর গড়ে ওঠে তখন ঘোড়াগাড়ি চলাচলের মাপে পুরনো ঢাকার রাস্তাঘাট নির্মান করা হয়েছিল। রাস্তার গা ঘেঁষে গড়ে ওঠে দোকানপাট-বাড়িঘর। সেই পুরনো ঢাকার জনসংখ্যা বেড়েছে কয়েকশগুন। কিন্তু রাস্তাগুলো সেই ঘোড়াগাড়ির মাপেই রয়ে গেছে। এই পুরনো ঢাকার জ্যাম ঠেলেই মানুষ যায় কোর্টে। সদরঘাট-সোয়ারিঘাটে। এই পরিস্থিতির কারনে জীবন এখন অনেক কঠিন পুরনো ঢাকার মানুষেরও। কিন্তু রাস্তা বড় করতে কেউ তাদের একফুট জায়গাও ছাড়তে রাজি হবেনা। ভোটের কারনে সরকারও জমি হুকুম দখল করে রাস্তা বড় করার উদ্যোগ নেয়না। নেবেনা। কিন্তু এর মাশুল কি করে দেয় পুরনো ঢাকার মানুষ, এর নিমতলীর দৃষ্টান্ত আছে। নতুন দৃষ্টান্ত চকবাজার ট্র্যাজেডি। এমন ঘটনার পর ওই সব এলাকায় ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি ঢুকতে পারেনা। গাড়ি ঢোকার পর দেখা গেলো আগুন নেভানোর মতো কোন পানির উৎসও সেখানে নেই। এমন চকবাজার কিন্তু সারাদেশে। তাই এমন ঘটনা যে প্রতিদিন ঘটেনা সেটিইতো সৌভাগ্য।
নতুন সরকার ক্ষমতা নেবার পর নতুন মন্ত্রীরা যখন এই করবো সেই করবো বক্তৃতা দিচ্ছিলেন প্রতিদিন তাদের সংকল্প দেখে ভালো লাগার পাশাপাশি হাসিও পায়। কারন কাজ তারা যে সব কর্মকর্তাদের দিয়ে করাবেন তাতো সব পরিচিত মুখ। এরা কী কাজ করেন কীভাবে কাজ করেন, কোথায় কী পরিমান গুনেন তাতো ওয়াকিফহালদের মোটামুটি মুখস্ত। কাজেই কাঁঠাল গাছে আম আশা করার স্বপ্ন বাতুলতা মাত্র। মন্ত্রী সৎ হতে পারেন, সৎ থাকতে চাইতে পারেন। কিন্তু তাঁর অধীনস্ত সবাই যে ধোয়া তুলশিপাতা না, এটা মাথায় না রাখলে কিন্তু বিপদ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডাক্তারদের কাজে স্বচ্ছতা-পেশাদারিত্ব চেয়েছিলেন। এটা জিম্মি জনগনের পছন্দের দাবি। কিন্তু আওয়ামী লীগের চিকিৎসক সংগঠন, যারা দল ক্ষমতায় থাকার কারনে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা নেন-নিচ্ছেন, সারাক্ষন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী-জননেত্রী বলে মুখে ফেনা তোলেন, এই চিকিৎসক নেতারাও প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাঁড়ালেননা কেনো? সারাক্ষনতো বলেন, শেখ হাসিনা ভুল করতে পারেননা। তবে কী ডাক্তারদের পথে আনার চেষ্টা করতে গিয়ে তাদের ধারনা শেখ হাসিনা ভুল করেছেন? এর উত্তর কে দেবে? ওয়াকিফহালরা জানেন এরমাঝে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। সিংহভাগ ডাক্তাররা প্রধানমন্ত্রীর কথা শোনেননি-শুনছেননা। যেখানে একটি পেশার লোকজন দেশের প্রধানমন্ত্রীর কথা শোনেনা সেখানে অন্যরা একজন মন্ত্রীর কথা শুনবে, এমন ভাবা হাস্যকর। মন্ত্রী সিরিয়াস হলে তার কথা অধীনস্তদের শুনতে বাধ্য করতে হবে। মন্ত্রী এটা পারবেন তা জনগন বিশ্বাস করেনা। জনগনের বিশ্বাস সৃষ্টি করতে চাইলে মন্ত্রীকে তার অধীনস্ত দুর্নীতিবাজদের শায়েস্তা করতে হবে।
বুড়িগঙ্গা-তুরাগ সহ ঢাকার নদীগুলোকে দখল মুক্ত করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী অঙ্গিকার। ঢাকায় বুড়িগঙ্গা, চট্টগ্রামে কর্নফুলি দখল মুক্ত করার উদ্যোগ মানুষকে আশাবাদী করেছে। কিন্তু সবাই দেখলো উদ্ধার কার্যক্রম থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হলো সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তাকে! কারন আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ সহ তিন দখলদার রিয়েল এস্টেট কোম্পানির অবৈধ স্থাপনা তারা ভাঙ্গছিলেন। দেশের মানুষ কী কোনদিন জানতে পারবেন দেশে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে ক্ষমতাধর কে-কারা? যারা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়ন ব্যাহত করতে একজন কর্মকর্তাকে ঘটনাস্থল থেকে ডেকে নিয়ে যায়? প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলছি, প্লিজ এমন ধৃষ্ট ব্যক্তিদের শুধু বরখাস্ত না, গ্রেফতার করিয়ে জনগনকে জানান। নতুবা এরা আপনাকে হত্যার ষড়যন্ত্রও করতে পারেন। কারন আপনি তাদের নিয়মিত বাড়তি অবৈধ রোজগারে হাত দিয়েছেন।
বুড়িগঙ্গা-তুরাগ সহ নানা নদী দখলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে ফুটে উঠেছে পরিকল্পনার আরেক অভাব! দখল উচ্ছেদের পর যে বর্জ্যের সৃষ্টি হয়েছে তা কোথায় নিয়ে ফেলা হবে তা এখনো কেউ জানেনা! না এসব বর্জ্যও ধীরে ধীরে গড়িয়ে যাবে নদীতে! মরা নদী আরও মরে যাবে! এরমাঝে জানা যাচ্ছে বুড়িগঙ্গাসহ সব নদীর তলদেশে কয়েকফুট পুরু পলিথিনের স্তর সৃষ্টি হয়েছে। এরজন্যেও দূষন বাড়ছে সব নদীতে। একদার নদীমাতৃক দেশের সব নদী মরে যাচ্ছে। পদ্মা সেতুর দৃশ্যমান ছবি দেখেও আমার ভয় করে। এতো স্বপ্নের পদ্মা সেতু। কিন্তু নদীটি দিন দিন হয়ে যাচ্ছে শীর্নকায়!
সরকারি দলের লোকজন সুযোগ পেলেই অহোরাত্রি উন্নত দেশ উন্নত দেশ বলে চিল্লায়। কিন্তু এই দেশটির রাজধানী ঢাকা শহর পৃথিবীর বাস অযোগ্য শহরে স্থান নিয়েছে। ঢাকাকে এই বাস অযোগ্য শহরের তালিকায় রেখে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হবেনা। উন্নত দেশ করতে চাইলে ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে হবে। এর গতি বাড়াতে হবে। এমন একটি একচ্ছত্র ক্ষমতাধর সরকার ক্ষমতায় থাকা স্বত্ত্বেও এরাও ঢাকা শহরে চলমান রিকশা-ঠেলাগাড়ি-সিএনজি সহ ধীরগতির-বিপদজ্জনক যানবাহন উচ্ছেদে ভয় পায়! ফুটপাথ দখল করে অথবা পুলিশ সহ দুর্নীতিবাজরা ফুটপাথ ভাড়া দিয়ে মানুষ পথ আটকায়, সরকার তাদের গায়ে হাত দিতে ভয় পায়! একটা ভিশনারী সরকারের এমন কিছুতে ভয় পেলে চলবেনা। মানুষকে আয়ের পথ বেছে নিতে হবে আইনানুগ। একটা খেয়াঘাটে যেখানে দশটি নৌকা ছিল, একটি ইঞ্জিন নৌকা সেখানে আসার পর বাকি নয়জন নৌকা মাঝি না খেয়ে মারা যায়নি। তারা হয় নৌকা নিয়ে অন্য ঘাটে চলে গেছে অথবা চলে গেছে অন্য পেশায়। যে কোন মূল্যে ঢাকা শহরকে এর বাসিন্দাদের জন্যে নিরাপদ বাসযোগ্য করতে হবে।