ফজলুল বারী: তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশের জন্য অনভ্যস্ত একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। এর আগে কখনো কোন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে আসেননি। কাজেই মার্কিন প্রেসিডেন্টের সফর আয়োজনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের ছিলোনা। আমাদের সাংবাদিকদের নেই। কাজেই সবকিছু নিয়ে এলোমেলো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা কর্মকর্তাদের এটাসেটা জিজ্ঞেস করি। তারা সাফ কোন উত্তর দিতে পারেননা। জানলেতো দেবেন। অতএব প্রতিদিন নানা রিপোর্ট করতে ভরসা ছিল ইন্টারনেট। মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বহনকারী বিমান এয়ার ফোর্স ওয়ান কী রকম। এর খাবার কক্ষে একসঙ্গে কতো লোক বসতে পারেন। গোসলখানা কী রকম, এমন নানা রিপোর্ট। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সফর স ম্পর্কে ধারনা না থাকায় তখন তাকে বাংলাদেশে একদিন রাত্রিবাসের অনুরোধ করা হয়। মার্কিনিরা ভদ্রতা করে বলে প্রেসিডেন্ট সময় পাবেননা। সকালে দিল্লী থেকে এসে আবার বিকেলে দিল্লীতে ফেরত যাবেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট আসবেন বলে নানা অগ্রবর্তী দলের জন্যে দু’মাস আগে দিল্লীর পাঁচতারকা হোটেলগুলোর দুই হাজার রূম ভাড়া নেয়া হয়। আমাদের তখন পাঁচতারকা হোটেলগুলোয় সাকুল্যে রূম ছিল ৬৮০ টি। কাজেই মার্কিন প্রেসিডেন্টের সফর আয়োজনের অভিজ্ঞতা থাকলে আমরা কী এমন অনুরোধ করতাম?
বিমান ছিনতাইর ঘটনার পর আমার সে ঘটনাগুলো মনে পড়ছিল। কারন এর আগে বাংলাদেশের কোন বিমান কখনো ছিনতাই হয়নি। ছিনতাইর ঘটনা সামাল দেবার অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। যিনি ছিনতাই করতে চেয়েছিলেন তিনিও নবীশ। ছিনতাই করার কোন অভিজ্ঞতা বা পড়াশুনা না থাকায় তিনিও যথেষ্ট নবীশ আচরন করেছেন। বিমান ছিনতাইর ঘটনা কভার করার অভিজ্ঞতা আমাদের এই প্রজন্মের সাংবাদিকদের নেই। তাদের বসদেরও নেই। সে কারনে রিপোর্টের বাঁকে বাঁকে নানাকিছুতে নবীশ কায়কারবার ফুটে উঠেছে। আরেকটি সংকট তখন বড় হয়ে ওঠে। বিদেশে বন্যা হোক আর যুদ্ধ হোক ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট নিয়ে তাদের আলাদা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। একজন মুখপাত্র থাকেন ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টারে। তিনি ঘ ন্টায় ঘন্টায় ব্রিফ করেন। মিডিয়াও কনক্রিট তথ্যের ওপর ওই ব্রিফিং’এর ওপর নির্ভর করে। আলগা এলোপাতাড়ি রিপোর্টের চেষ্টা করেনা। কারন রিপোর্ট ভুল গেলে মামলা হয়ে যাবে।
এখানে দেখা গেলো সংঘবদ্ধ কোন মিডিয়া ব্রিফিং এর ব্যবস্থা নেই। একজন এক জায়গায় ব্রিফ করছেন। একজনের তথ্যের সঙ্গে আরেকজনের তথ্যের মিল নেই। এ পরিস্থিতিতে বিভ্রান্তিতে পড়ে মিডিয়া। নানান এলোমেলো এলোপাতাড়ি রিপোর্ট হতে থাকে। এসব বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিস্থিতির কারনে আমার প্রিয় প্রজন্ম রিপোর্টারদের কারো কারো রিপোর্টে যথেষ্ট স্বচ্ছতা মুন্সিয়ানা থাকলেও অনেকের রিপোর্ট ছিলো এলোমেলো বিশৃংখল। বিমান প্রতিমন্ত্রী, সিভিল এভিয়েশন, এদের কথাবার্তাতেও ছিল ছেলেমানুষি। কাউকে কাউকে যথেষ্ট হতভম্ভও মনে হয়েছে। একাত্তর টিভিতে বিমান প্রতিমন্ত্রী এমন কথাবার্তা বলছিলেন যাতে স্পষ্ট হয় বিমান বন্দর নিয়েও তাঁর স্বচ্ছ ধারনার অভাব। বিমান প্রতিমন্ত্রী বলেন, তিনি চলে গেলেন গনভবনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। সেখানে গিয়ে দেখে টেলিভিশনের সামনে প্রধানমন্ত্রী কত দক্ষতার সঙ্গে সবকিছু সামাল দিচ্ছেন। প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছেন। বিমান প্রতিমন্ত্রী বলেন রাত হয়ে যাওয়ায় তিনি আর নিরাপত্তা পরিস্থিতি দেখতে যাননি। রাত পোহালে বিমান বন্দরে যাবেন।
বাংলাদেশের বিমান ছিনতাই পরিস্থিতি সামাল দেবার ঘটনা ঘটেছিল জিয়ার আমলে। সেই আমলের কর্মকর্তাদেরও কেউ এখন আর চাকরিতে নেই। অনেকে এরমাঝে মারা গেছেন। জাপানি রেড আর্মির কমান্ডোরা জাপান এয়ারলাইন্সের একটি যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করে ঢাকায় নিয়ে এসেছিল। সে পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর নেতৃত্বে এখানে একটি অভ্যুত্থান হয়ে যাচ্ছিল। জিয়ার আমলে এমন একেরপর এক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা হয়। একেকটি পর্ব ব্যর্থ হবার পর জিয়া সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট অফিসারদের ফাঁসিতে হত্যা করতেন। বিমান ছিনতাই পরিস্থিতির সুযোগে সেই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার পর বিমান বাহিনীর অনেক অফিসার সদস্যকেও তখন ফাঁসিতে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের বড় অংশ এভাবে তখন জিয়ার হাতে প্রান হারান। জাপানি বিমান ছিনতাইর সেই ঘটনায় অবশ্য রেড আর্মির কমান্ডোরা সফল হয়েছিল। তাদের দাবিমতো রেড আর্মির বন্দীদের মুক্তি ও মুক্তিপনের ১০ লাখ ডলার নিয়ে আসে জাপান সরকারের প্রতিনিধিদল। ছিনতাকারীদের নিরাপদে ঢাকা থেকে চলে যাবার পৃথক বিমানেরও ব্যবস্থা করা হয়।
আমরা যারা বিদেশে থাকি তাদের মূলত দেশের সঙ্গে সর্বক্ষনিক যোগাযোগের মাধ্যম ইন্টারনেট, দেশের প্রধান মিডিয়াগুলোর অনলাইন নিউজ পোর্টাল, নিউজ টিভি চ্যানেল সমূহ। দেশের একটি বিমান ছিনতাইর শিকার হয়েছে। উদ্বেগের সঙ্গে সর্বক্ষনিক চোখ রাখছিলাম অনলাইনে। দেশে অনেকগুলো নিউজ টিভি চ্যানেল এখন। নতুন প্রজন্মের চমৎকার অনেকে ছেলেমেয়ে এগুলোয় কাজ করেন। কিন্তু কিছু কিছু খবর থেকে নানান বিভ্রান্তি সৃষ্টিও করছিল। সিভিল এভিয়েশন সহ নানা সংস্থার লোকজনের বিভ্রান্তির তথ্য সমগ্রও এসব বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্যে দায়ী। বিমানে ছিনতাইকারীর আসন, বোডিং কার্ড ধরেই তাৎক্ষনিক তার নাম জানানো যেত। এরজন্য সবাইকে দীর্ঘসময় অপেক্ষায় রাখার দরকার ছিলোনা। প্রথমে বলা হয় বিমানের মধ্যে সে গুলি ছুঁড়েছিল। পরে বলা হয় তার সঙ্গে ছিল খেলনা পিস্তল। খেলনা পিস্তল দিয়ে কী গুলিও করা যায়? গুলির কথাতো বিমানের ভিতর থেকেই জানা গিয়েছিল। গুলিবিদ্ধ ছিনতাইকারীকে দ্রুত হাসপাতালে না নিয়ে রানওয়েতে ফেলে রাখা হয়েছিল কেনো? রক্তক্ষরনে তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে? না আগেই জানা হয়েছে ছিনতাইকারীর মৃত্যু হয়েছে সে জন্যে? মৃত্যু নিশ্চিত হলেও তার লাশটি রানওয়েতে ফেলে রাখা কী নির্দেশ করে? সবাই হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিলেন? না সংশ্লিষ্টদের অমানবিক মন-মানসিকতা? এ ছবি বিদেশে গেছে। এতে দেশের ক্ষতি হবে।
ওই যে শুরুতেই বলছিলাম, কারো কোন অভিজ্ঞতা নেই। না সিভিল এভিয়েশনের, না সাংবাদিকদের। বিমান বন্দরের এতোসব নিরাপত্তাবলয় পেরিয়ে ছিনতাইকারী বিমানে চড়েছে! খেলনা পিস্তল হলে সেটি নিরাপত্তা বেস্টনির আর্চওয়েতে যদি ধরা না পড়ে তাহলে যারা বডি চেক করে তারা কী অদক্ষ অথবা অমনোযোগী ছিলো? ছিনতাইকারীর শরীরে তার মোড়ানো বোমা সদস্য একটি বস্তু অথবা একটি ভূয়া বোমা বাঁধা ছিলো। হাতে যারা বডি সার্চ করেন তাদের হাতেও তা বাঁধলোনা? দেশের প্রধান বিমান বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ফাঁকতাল নিয়ে কী প্রশ্ন ওঠার নয়? এখন পর্যন্ত যতোটা জানা গেছে পাইলট দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। ছিনতাই চেষ্টাকারী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চাইছিল। পাইলট তাকে আশ্বস্ত করে বলেন অবশ্যই তাকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়া হবে। একটু সময় লাগবে। কারন প্রধানমন্ত্রী খুব ব্যস্ত থাকেন। এটাই নিয়ম। বিদেশে আমাদের শেখানো হয় মাতাল ম্যানেজ করতে সব সময় মাতালের পক্ষে থাকতে হবে। তাতে সে আশ্বস্ত হয়। কোন আচরনে যদি মাতাল মনে করে লোকটি তার বিপক্ষে তখন সে ভায়োলেন্ট হয়। পাইলটও এভাবে তাকে আশ্বস্ত করে শান্ত ও আস্থায় রাখার চেষ্টা করেন। ককপিটে গিয়ে তিনি ঘটনা চট্টগ্রামের বিমান বাহিনীর কমান্ডার ও চট্টগ্রাম বিমান বন্দরকে জানান।
এক পর্যায়ে বিমানটি নিরাপদে অবতরন করান চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে। যাত্রীদের বিমান থেকে নেমে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর বিমানে কমান্ডোদের প্রবেশ ও তাকে পরাস্ত করা হয় ছিনতাইকারীকে। তবে নানান খবরে শুরু থেকে বোঝা যাচ্ছিল ছিনতাইকারী আদতে নবীশ একজন । অপরিকল্পিত। অপক্ক। মানসিক ভারসাম্যহীন। কিন্তু তাকে নিয়ে শুরু থেকেই চলে নানা তথ্য বিভ্রান্তি। ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি প্রথম ছিনতাইকারী নিহত হবার খবর দেয়। কিন্তু অভিযান সংশ্লিষ্টরা তখনও মৃত্যুর খবর স্বীকার করছিলেননা। ওই অবস্থায় সে রাতে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির নিয়মিত টকশো শুরু হয়। বিষয়বস্তু ছিল খালেদা জিয়াকে কাশিমপুর কারাগারে স্থানান্তর প্রসঙ্গ। সঞ্চালকের ভূমিকায় টিভি চ্যানেলটির প্রধান চরিত্র খালেদ মুহিউদ্দিন। খালেদ এই প্রজন্মের মেধাবী সাংবাদিকদের অন্যতম। ওই পরিস্থিতিতে টকশো সঞ্চালনের সময় তাঁর চোখমুখে উদ্বেগ লুকোছাপা ছিলোনা। কারন তাদের প্রচারিত স্ক্রল অনুসারে ছিনতাইকারী নিহত হবার খবর সত্য কিনা।
চট্টগ্রাম থেকে মামুন আব্দুল্লাহ রিপোর্টটি করেন। মামুন শুধু চট্টগ্রাম না, দেশের অন্যতম মেধাবী রিপোর্টার। চট্টগ্রামের চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের ঘটনা যা আজ পর্যন্ত ক্ষমতাহারা বিএনপির রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর অন্যতম কারন সেই রিপোর্টেও মামুনের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা ছিল। ওই ঘটনার ফলোআপ করতে অস্ত্র ক্রয়ের উৎপত্তিস্থল ব্যাংকক পর্যন্ত তিনি গিয়েছিলেন। টকশো থামিয়ে সেই মামুনকে আবার সংযুক্ত করা হলে তিনি তখনো জোরের সঙ্গে বলেন, ছিনতাইকারী নিহত হয়েছে। তার লাশ পড়ে আছে রানওয়েতে। পরে সেটাই সত্য হয়। এতে করে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি, আমার প্রিয় মামুন আব্দুল্লাহ, খালেদ মুহিউদ্দিন সবার মুখ উজ্জ্বল হয়। বিমান ছিনতাই প্রচেষ্টা রিপোর্টিং’এর তখন পর্যন্ত এটিই প্রথম এক্সক্লুসিভ। নিহত ছিনতাইকারী পলাশ আহমদের প্রায় সব খবর এখন সবার জানা। তার উৎস বৃত্তান্তের নানা তথ্য জেনে তার ব্যাপারে আমার মাঝে একটি বিশেষ ধারনার সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়টি আগামীতে লিখবো।