“সকল মাতৃভাষা সংরক্ষণে ‘Cumberland Council, NSW’ বৈশ্বিক মাইলফলক” (IMLD’র গণসম্পৃক্ততা বিষয়ক বিশেষ প্রবন্ধ)
- নির্মল পাল
স্থানীয় সকল ভাষাভাষীর মাতৃভাষা চর্চা এবং সুরক্ষায় প্রাত্যহিক গণসচেতনতা গড়ে তোলার নিত্য-নৈমত্তিক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির কার্যকরী পদক্ষেপ হিসেবে প্রতিটি লাইব্রেরীতে “একুশে কর্নার” স্থাপনার মধ্য দিয়ে NSW’র Cumberland Council, UNESCO ঘোষিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনে বৈশ্বিক মাইলফলক হিসেবে ঐতিহাসিক ভিত্তি রচনা করেছে। বিশতম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (২০১৯)উদযাপন উপলক্ষে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি’১৯ বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় অপরাহ্ন ৬.৩০মিনিটে কাউন্সিলের সম্মানিত মেয়র Clr Greg Cummings স্থানীয় Auburn Library’তে Clr Suman Saha, Clr Lisa Lake, and Clr George Campbell সহ সর্বস্তরের সুধীদের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে কাউন্সিলস্থ সকল লাইব্রেরীতে “একুশে কর্নার” এর শুভউদ্বোধন ঘোষণার মাধ্যমে বিশতম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে মাতৃভাষা সংরক্ষণের ঐতিহাসিক অধ্যায়ের অংশ হিসেবে বিশেষিত করে বিশ্বের সকল মাতৃভাষা সংরক্ষণে অনুকরণীয় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছেন। কাম্বারল্যান্ড কাউন্সিল মেয়রের এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে কাউন্সিল প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সর্বমোট ৮টি লাইব্রেরীর(Auburn, Granville, Greystanes, Guldford, Lidcombe, Merrylands, Wentworthville/Toy and Regent Park) প্রত্যেকটিতে “একুশে কর্নার” দর্শনে সংকলিত লাইব্রেরী সেবা প্রদানের শুভ সূচনা হল; যা এখন বিশ্বে ইউনেস্কো কর্তৃক নীতিগতভাবে প্রশংসিত এমএলসি মুভমেন্টের প্রণীত “একুশে কর্নার” দর্শনের সর্বপ্রথম প্রশাসনিক প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত।Clr Suman Saha ঐতিহাসিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন।
প্রত্যেক লাইব্রেরীতে “একুশে কর্নার” প্রতিষ্ঠার সুফল হিসেবে, “Conserve Your Mother Language” আবেদনের মাধ্যমে লাইব্রেরী সেবা গ্রহণকারী প্রত্যেক ভাষাভাষী একদিকে যেমন লিজ নিজ মাতৃভাষা সুরক্ষার নিয়মিত তাগিদ পাবে, অন্যদিকে একুশে কর্নারে তার মাতৃভাষার বর্ণমালাসহ সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপকরনাদি লাইব্রেরীর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রক্ষানাবেক্ষনের সুযোগ পাবে। পরবর্তীতে এই সকল বর্ণমালাসহ সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপকরনাদি উৎসাহীরা প্রয়োজনে ব্যবহার অথবা ধার করাসহ, চর্চা এবং গবেষণা কাজে ব্যাবহারের সুবিধা নিশ্চিত হবে। অধিকিন্তু লাইব্রেরী প্রশাসন বছরের বিভিন্ন সময়ে উৎসাহী ভাষাভাষীদের নিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাষা বিষয়ক কর্মশালা আয়োজনের মাধ্যমে স্থানীয়দের মধ্যে “Family of Mother Languages” গড়ে তুলে মাতৃভাষা চর্চার সাধারণ আগ্রহ সৃষ্টির ব্যাবস্থা করতে পারবে, যা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের বার্ষিক উৎসব হিসেবে অর্থবহ এবং কার্যকরী ভূমিকা রাখতে বিশেষভাবে সাহায্য করবে। এখানে উল্লেখযোগ্য কাম্বারল্যান্ড কাউন্সিলে স্থানীয় এবরিজিনাল ভাষা ‘Darug Language’ চর্চা এবং শিক্ষার বিষয়টি এই প্রকল্পে বিশেষ মর্যাদায় সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যার ফলে কাউন্সিলের প্রতিটি স্কুল এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ‘Darug Language’ ভাষাটি শিখানোর বিষয়ে শিক্ষা বিভাগের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হবে।
“একুশে কর্নার” দর্শন বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত লাইব্রেরী সেবাপ্রথার সাথে স্থানীয়ভাবে সংশ্লিষ্ট সকল ভাষার বর্ণমালা সংগ্রহ নিশ্চিতকরন, এবং লাইব্রেরী সেবার সাথে সংযুক্তকরণের লক্ষ্যে এমএলসি মুভমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক উদ্ভাবিত ভাষা সংরক্ষণভিত্তিক একটি নতুন বৈশ্বিক দর্শন। যে দর্শন প্রচলিত লাইব্রেরী প্রথার সাথে স্থানীয় মাতৃভাষাগুলি সংরক্ষণের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ভাষাভাষীকে উৎসাহিত করে সম্পৃক্ত করার সুযোগ নিশ্চিত করবে। বিশ্বের সর্বত্র ভয়াবহ গতিতে মাতৃভাষা অবক্ষয়রোধে ইউনেস্কো ঘোষিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনে বিশ্বের সর্বত্র সাধারণ গণসচেতনতা গড়ে তোলা, এবং সকল ভাষাভাষীকে প্রাত্যহিকভাবে এই চেতনায় উদ্ভুদ্ধকরার প্রচারণার সহজতর কৌশল হিসেবে, “একুশে কর্নার”-এ উদৃত “Conserve Your Mother Language” আবেদনটি সর্বসাধারণের মাঝে ভাষা রক্ষার বিষয়ে বিশেষভাবে অনুপ্রেরণা জোগাবে। বৈশ্বিক এই সাধারণ আবেদনটি একজন ভাষাভাষীকে নিজ ভাষা সুরক্ষার তাগিদ জানানোর পাশাপাশি অন্য ভাষাভাষীকে তার নিজস্ব ভাষা চর্চা/সুরক্ষায় অনুপ্রেরণা জোগাতে উৎসাহিত করবে। “একুশে কর্নার” দর্শনটি নিয়ে এই লেখকের লেখা প্রবন্ধটি Australia Library and Information Association (ALIA)’র মাসিক ম্যাগাজিন, “INCITE” মে ২০১৫ সংখ্যায়, “One Small Shelf, One Giant Step Forward” নামে প্রকাশিত হওয়ার পর অধুনালুপ্ত এসফিল্ড কাউন্সিলের সম্মানিত মেয়র Clr Lucille McKenna OAM ২০শে ফেব্রুয়ারি ‘১৬ এসফিল্ড লাইব্রেরীতে, “Twenty-first(Ekushey)Corner” নামে পৃথিবীর প্রথম “একুশে কর্নার” এর উদ্বোধন করেন। এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন সচিব জনাব এন আই খান এবং আরটিভি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব আশিক রহমানের উপস্থিতির জের ধরে ২৮-২-১৭ তারিখে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সিটিটিউট, ঢাকায় “লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার স্থাপনা” শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় এবং আরটিভি “একুশে কর্নার” নামক “টক সো” প্রচার করে। বাংলাদেশ লাইব্রেরী এসোসিয়েশন এর নিবন্ধনকৃত ৩,৫০০ লাইব্রেরীতে “একুশে কর্নার” প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ইতিমধ্যেই কুষ্টিয়া ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরী, বাংলাদেশ ন্যাসন্যাল কমিশন ফর ইউনেস্কো’র লাইব্রেরী এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সিটিটিউট, রমনা ঢাকা’র লাইব্রেরীতে “একুশে কর্নার” প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ACT Legislative Council’র আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের সর্বসম্মতিক্রমে পাশকৃত মোশনে এসিটি সরকারের অধীনস্থ সকল লাইব্রেরীতে “একুশে কর্নার” প্রতিষ্ঠার কথা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। এমএলসি মুভমেন্টের সাথে ইউনেস্কো’র ০৭-০৭-১৭ তারিখে অনুষ্ঠিত স্কাইপ মিটিংএ “একুশে কর্নার” দর্শনকে বিশ্বব্যাপী মাতৃভাষা সংরক্ষনে নাম মাত্র ব্যয়ে সারাবিশ্বের লাইব্রেরীসমূহে বাস্তবায়নযোগ্য একটি অত্যন্ত বাস্তবভিত্তিক কার্যকরী প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে, এবং ইউনেস্কো মিটিং’র কার্যবিবরণীতে ইউনেস্কোর দ্বিতীয় ক্যাটাগরি সংস্থা’ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সিটিটিউটের সাথে এমএলসি মুভমেন্টের পার্টনারশিপে কাজ করা প্রয়োজন বলে সুনির্দিষ্টভাবে সুপারিশ করা হয়েছে।
“Twenty-first(Ekushey) Corner” বা “একুশে কর্নার” দর্শন অনুযায়ী একুশে কর্নার বাস্তব অর্থে একটি ‘কর্নার’ নয়, এটি লাইব্রেরীর অনেকগুলি বুক শেল্ফের মতই “Conserve Your Mother Language” আবেদন লেখা নির্ধারিত নকশায় চিত্রিত পোষ্টার দ্বারা চিহ্নিত ছোট আকারের একটি ‘বুকশেল্ফ’ মাত্র; যেখানে বই নয়, বরং বই লেখার মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত বর্ণমালা(সকল স্থানীয় ভাষার)সংরক্ষণ সহ ‘মহান একুশ’ তথা ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ সংক্রান্ত ঐতিহাসিক তথ্যাদি সংগৃহীত থাকবে।
এই বৈশ্বিক দর্শনের বিষয়টি অপ্রত্যাশিতভাবে সর্বত্র তড়িৎ সম্প্রসারিত হলেও প্রশাসনিকভাবে কাম্বারল্যান্ড কাউন্সিল কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত এবং প্রশাসনিক পর্যায়ে বাস্তবায়ন, এই দর্শনের বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জনে প্রশাসনিকভিত্তি রচনায় ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে বিশ্ব পরিমণ্ডলে স্থান করে নিয়েছে। যার প্রাথমিক এবং গর্বিত উদ্যোক্তা বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত কাউন্সিলর ইতিমধ্যেই স্থানীয় সকল ভাষাভাষীর প্রিয় কাউন্সিলর হিসেবে পরিচিতি পাওয়া কাউন্সিলর সুমন সাহা। গতবছর (২০১৮) এর একুশে ফেব্রুয়ারি’র দিনেই অনুষ্ঠিত কাউন্সিলের নিয়মিত সভায় তাঁর উত্থাপিত প্রতিবছর ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উদযাপন এবং প্রত্যেকটি লাইব্রেরিতে ‘একুশে কর্নার’ প্রতিষ্ঠা বিষয়ে উত্থাপিত মোশন Clr Kun Huang’র সমর্থনে সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন লাভ করে। এই সিদ্ধান্তের আলোকে এমএলসি মুভমেন্টের সাথে কাউন্সিলের মেয়রসহ প্রশাসন/লাইব্রেরী সার্ভিস ম্যানাজারের কয়েক দফা বৈঠকের ব্যাবস্থা এবং বিভিন্ন পর্যায়ের পরামর্শ বিষয়ে তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং নিরলস পরিশ্রম এই ঐতিহাসিক অর্জনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এই প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নে কাউন্সিলের লাইব্রেরী সার্ভিসেস ম্যানাজার Ms Nicole Byrn বিশেষভাবে পেশাদারী ভুমিকার স্বাক্ষর রাখেন। উল্লেখ্য, কাউন্সিলর সুমন সাহা কমিউনিটির স্বেচ্চাসেবক হিসেবে শুরু থেকেই এমএলসি মুভমেন্টের সার্বিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত। তন্মধ্যে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” এর দশম বছরপূর্তিতে অনুষ্ঠিত সেমিনারে Hon Michelle Rowland MP’র পাঠানো বানী উপস্থাপনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, “Blacktown Council, NSW” প্রশাসনিকভাবে প্রতিবছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম কাউন্সিল হিসেবে গৌরবের স্থান দখল করেছে। কাউন্সিলের সম্মানিত “Clr Susai Benjamin“ এর উদ্যোগে কাউন্সিল বিগত ২০১৭ থেকে কাউন্সিলের সকল ভাষাভাষীদের সমন্বয়ে এই দিবসটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পালন করে আসছে, এবং এরই ফলশ্রুতিতে বিগত ২রা মার্চ ’১৯ বাংলাভাষা এবং ১১ই মার্চ’১৯ ম্যান্ডারিন ভাষার বুকশেল্ফ উদ্বোধন করা হয়েছে। কাউন্সিলের প্রত্যেকটি লাইব্রেরিতে “একুশে কর্নার” বাস্তবায়নের বিষয়টি নিয়ে এমএলসি মুভমেন্টের পক্ষ থেকে কাউন্সিল এবং লাইব্রেরী কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা অব্যাহত আছে। একইভাবে “Campbeltown Council’ এবং “Canterbury-Bankstown Council” এর সকল লাইব্রেরিতে “একুশে কর্নার” বাস্তবায়ন এবং ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ’ নির্মাণের বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত গর্বিত কাউন্সিলর Clr Massod Chowdhury, Clr Muhammad Zaman Titu and Clr Muhammad Huda Babu’র সাথে এমএলসি মুভমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল নিয়মিত যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। কাম্বারল্যান্ড কাউন্সিলের এই ঐতিহাসিক মাইলফলক সৃষ্টির পাশাপাশি Clr Massod Chowdhury উদ্যোগে Campbeltown Council কর্তৃক এবছর(২০১৯) থেকে প্রশাসনিকভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্তগ্রহন এবং উদযাপন সকল মাতৃভাষা/একুশ প্রেমীদের মধ্যে বিশেষভাবে পরিলক্ষিত উৎসাহ-উদ্দীপনা এমএলসি মুভমেন্টের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অগ্রগতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে।