ফজলুল বারী:অভিনেতা আহমদ শরীফ ও তাঁর স্ত্রীর চিকিৎসার জন্যে পয়ত্রিশ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুদানের চেক সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নিজে শিল্পীর হাতে তুলে দিয়েছেন। সে অনুষ্ঠানের ছবি মিডিয়ায় আসার পর আওয়ামী লীগের অনেক অনলাইন এক্টিভিস্ট ক্ষিপ্ত হয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা প্রশ্ন রেখে লিখছেন যেখানে তৃনমূল আওয়ামী লীগের লাখ লাখ নেতাকর্মী সমর্থক রোগেশোকে অভাবে জর্জড়িত সেখানে বিএনপি তথা জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক দলের এক নেতাকে কেনো এই পরিমান অর্থ দেয়া হবে। দেশের দুঃস্থ শিল্পী সাহিত্যিক সাংবাদিককে সহায়তা দেবার জন্যে প্রধানমন্ত্রীর একটি ঐচ্ছিক তহবিল আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে তহবিল থেকে শিল্পী সাহিত্যিক সাংবাদিকদের যে পরিমান অর্থ অনুদান হিসাবে দেন তা দেখে আমার খুব ভালো লাগে। কারন এই পরিমান টাকায় তাদের খুব উপকার হয়। বাংলাদেশের এর আগের কোন সরকার প্রধান কাউকে কখনো এই পরিমানের অনুদান দেননি। প্রধানমন্ত্রীর ঐচ্ছিক তহবিলেও এত অর্থ আছে বা থাকে মনে হয়না। প্রধানমন্ত্রী হয়তো অন্য তহবিলের টাকাও কাটছাট করে এখানে নিয়ে আসেন।
প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে অর্থ সহায়তা পাবার নির্দিষ্ট কিছু বিধান আছে। এরজন্যে তাঁর কাছে আবেদন করতে হয়। শিল্পী সমিতি অথবা সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী সংগঠনের সরকার ঘরানার নেতারাও এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আবার অনেক সহায়তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে উদ্যোগী হয়ে দেন। যেমন চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনের অসুস্থতার খবর পত্রিকায় পড়ে প্রধানমন্ত্রী নিজে উদ্যোগী হয়ে তাঁর ছেলেদের গনভবনে ডেকে এনে সহায়তা দিয়েছেন। বাংলাদেশের সাহিত্য-নাটক-চলচ্চিত্রে আমজাদ হোসেনের অবদান কে না জানেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে পড়াশুনা করেন, শিল্প সমঝদার বলেই আমজাদ হোসেনকেও জানেন। তিনি বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে যে জড়িত তাও জানেন। কিন্তু তাঁর গুরুতর অবস্থা জেনে তাঁর ছেলেদের গনভবনে ডেকে এনে তাদের কাছে যখন জানতে চেয়েছেন ‘আমজাদ ভাই কেমন আছেন’, তা শুনেজেনে আবেগে কৃতজ্ঞতায় পাষান ছাড়া কার চোখে জল আসবেনা! এটিই শেখ হাসিনার উদারতা। তাঁর এ আচরনটিই রাষ্ট্র নায়কোচিত। কারন তিনি দেশের সবার প্রধানমন্ত্রী। আওয়ামী লীগের নেতাদের ব্যর্থতা দলের নেতাকর্মীকে তারা তাদের নেত্রীর মতো উদার করে গড়ে তুলতে পারেননি বলে দলনেত্রীর এসব ভূমিকা নিয়ে তারা প্রশ্ন তোলে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প এখন রুগ্ন। সঙ্গীতাঙ্গনেরও একই অবস্থা। ঢাকাই ছবির যখন রমরমা অবস্থা ছিল তখন এর জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকাদের পারিশ্রমিকের অংক শুনলে আজকের প্রজন্ম হাসবে। প্রযোজকরাও তখন এসব বাজারকাটতি নায়ক নায়কাদের পিছনে ছুটতেন। পার্শ্ব চরিত্রের অভিনেতা অভিনেত্রীদের পারিশ্রমিক যেটা ঠিক হতো সেটা খুব কম প্রযোজকই ঠিকমতো পরিশোধ করতেন। বকেয়া পাবার বা পরের ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পাবার আশায় অনেকে লজ্জায়ও এসব বকেয়া পাওনার কথা মিডিয়ায় বলতেনওনা। এর কারনে আনোয়ার হোসেন, প্রবীর মিত্রের মতো এক সময়ের দাপুটে অভিনেতাকেও শেষ বয়সে এসে দুঃস্থ শিল্পী হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর অনুদান নিতে হয়েছে। আনোয়ারার মতো এক সময়ের দাপুটে অভিনেত্রীকেও প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ডেকে এনে বুকে জড়িয়ে ধরে অনুদান দিয়েছেন দেখে ভালো লেগেছে। সেই সময়ের শাবানা-কবরী-ববিতার মতো নায়িকা, রাজ্জাক-ফারুক-আলমগীরের মতো নায়ক রমরমা অবস্থায় থাকতে নিজেদের গুছিয়ে নেয়ায় তারা এখন আর দুঃস্থ শিল্পী হিসাবে চিহ্নিত নন। কিন্তু এদের সংখ্যা হাতে গোনা।
চলচ্চিত্র শিল্প রুগ্ন হয়ে পড়াতে তখনকার বেশিরভাগ শিল্পী কলাকুশলীর আর্থিক অবস্থাও এখন রুগ্ন। অনেক শিল্পী বিদেশ চলে গিয়ে বেঁচে গেছেন। একটা নিউজে দেখলাম বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশের নায়িকা এখন ভিক্ষা করেন। শিল্পী সমিতি উদ্যোগী হয়ে তাকেও প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে আসতে পারেন। অনলাইনে অনেকে লিখছেন আহমদ শরীফ প্রধানমন্ত্রীর অনুদান পাবার মতো দুঃস্থ না। অনেক সাংবাদিককে অনুদান পাবার পরও এ ধরনের প্রশ্ন ওঠে। এসব দেখভালের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর দফতরের। প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছার মাধ্যমও লাগে। আহমদ শরীফ নিশ্চয় আবেদন করে বা শিল্পী সমিতির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছেছেন। অনুদান গ্রহনের মাধ্যমেও তিনিও একজন দুঃস্থ শিল্পী হিসাবে নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের তালিকাভূক্ত হয়েছেন। তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়া স্বত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে তাকে নিরাশ করেননি, এটি বঙ্গবন্ধু কন্যার উদারতা। তাঁর এই উদারতাকে যারা প্রশ্নবিদ্ধ করছেন তারা ঠিক কাজটি করছেননা।
এমনিতে বাংলাদেশের মতো দেশে কেউ রোগাক্রান্ত হলে চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে পরিবারগুলোতে কি নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হয় তা ওয়াকিফহালরা জানেন। চিকিৎসা ব্যয়ের দুশ্চিন্তায় রোগী এবং পরিবারটি অর্ধেক মরে যায়। অস্ট্রেলিয়া একটি কল্যান রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্র ক্যান্সার সহ নাগরিকদের সব ধরনের রোগের সর্বোচ্চ চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। এর কারনে এখানে নাগরিকদের চিকিৎসার চিন্তাটি রাষ্ট্রের। কাউকে চিকিৎসার জন্যে কোন অনুদান দেবার ব্যবস্থা বা চিন্তাটিও নেই। বাংলাদেশেও সরকারি হাসপাতালগুলোতে নাগরিকদের ফ্রি চিকিৎসা পাবার ঘোষনা আছে। কিন্তু তারা ফ্রি চিকিৎসা পান কিনা, কোথায় কত খরচ তাতো ওয়াকিহালরা জানেন। সেজন্য সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন একজন রোগীর চিকিৎসার দায়িত্বও প্রধানমন্ত্রী নিয়েছেন এমন ঘোষনাও অহরহ আসছে! মধ্যবিত্ত অথবা সেলিব্রেটিদের সমস্যা হলো তারা মুখ ফুটে সমস্যা বলতে বা যার তার কাছে হাত পাততেও পারেননা। আহমদ শরীফের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে তার নাকি অনেক আছে। আহমদ শরীফের আজ সামর্থ্য আছে কীনা সে তথ্যতো তিনি ভালো জানেন। সামর্থ্য থাকা স্বত্ত্বেও তিনি যদি প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিলের অনুদান গ্রহন করেন সে লজ্জাতো তার এবং বিএনপির।
আমাদের বিভক্ত সমাজ। শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিকরাও রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের কোন সাংবাদিক যদি কোন ভালো তথ্য নির্ভর অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেন, তা কী আমি-আমরা পড়বোনা? শিল্পী সাহিত্যিকদের অনেকে আবার একটু নরম ভীতু টাইপেরও হন। পরিস্থিতির কারনেও অনেকে অনেক দল করেন। কবি শামসুর রাহমান মুক্তিযুদ্ধে যাননি। কিন্তু তিনিইতো লিখেছেন ‘স্বাধীনতা তুমি’র মতো অবিস্মরনীয় কবিতা। শামসুর রহমান এ নিয়ে ইন্টারভ্যু দিয়ে বলেছেন, তিনি একজন ভীতু প্রকৃতির মানুষ। এরকারনে সাহস করে ভারতে যাননি। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশে থাকা ৫৫ জন বুদ্ধিজীবীকে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে একটি বিবৃতি দেয়ানো হয়। এই বিবৃতিদাতাদের তালিকায় সাবিনা ইয়াসমীনের নামও ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের কালজয়ী দেশাত্ববোধক গানগুলোর বেশিরভাগইতো সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া। শাহনাজ রহমতউল্লাহ’র মৃত্যুর পরও এসব কথা উঠেছে। জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক আনিসুল হককে ঢাকার মেয়র করার সময় কী শেখ হাসিনা ভেবেছিলেন তিনি আওয়ামী লীগ করেন কী না! বা তাঁর স্ত্রী রুবানা হক যে এখন আওয়ামী লীগারদের সমর্থনে বিজিএমইএ’র প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, তিনি কী কখনো ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ করতেন? এরশাদ আমলে ফজলে লোহানীর ‘যদি কিছু মনে না করেন’ অনুষ্ঠানে এরশাদ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে ঘৃনা ছড়ানো হতো। রুবানা হক তখন সেই অনুষ্ঠানে সক্রিয় কাজ করতেন। তখন একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে সাধারন ছাত্রছাত্রীদের বক্তব্য ধারন করতে গিয়ে ছাত্রদের ধাওয়ার শিকার হন।
রুবানা হক এরপর আর এরশাদ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কোনদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গিয়েছেন কীনা আমার জানা নেই। আনিসুল হক বা রুবানা হককে নেতৃত্বে বাছাই করার সময় এসব কী কেউ ভেবেছে? না দেখেছে তাদের মেধা-কে? বিএনপি আমলে মুক্তিযুদ্ধের ছবি বলে সরকারি অনুদানে কলমিলতা’ নামের একটি ছবি বানানো হয়। সে ছবিতে সোহেল রানার চরিত্রটিতে ছিল জিয়ার ছায়া। সেই সোহেল রানা তথা মাসুদ পারভেজ কিন্তু আজকের জাপা তথা মহাজোট নেতা। কিন্তু আমজাদ হোসেন বা চাষী নজরুলের ছবিতেও মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাসের রাজনীতির ছিটেফোটা পাবেননা। গোলাপী এখন ট্রেনে, সুন্দরী, ভাত দে এসব ছবির কিছু চরিত্র সংলাপ যেন সমাজতন্ত্রের স্বপ্নের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেবার। খান আতার হাতে ছবিতে তৈরি হয়েছেন আজকের এমপি-নায়ক ফারুক। ববিতাকে বিএনপি ঘরানার শিল্পী মনে করা হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী কালজয়ী ছবি ‘অরুনোদয়ের অগ্নিস্বাক্ষী’, ‘আলোর মিছিল’ এসব ছবির নায়িকা ববিতা। ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবির নায়িকা সুচন্দা। শিল্পীদের খন্ডিত রাজনীতির চোখে দেখতে গেলে এমন অনেক বিপদ। তাই আসুন যতোটা সম্ভব আমরা তাদেরকে তাদের সৃষ্টি-ব্যক্তিত্ব দিয়ে দেখি। মেধা-ব্যক্তিত্ব-নিষ্ঠা ছাড়া কেউ দেশবরেন্য শিল্পী হতে পারেনা। দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শেখ হাসিনা রাজনৈতিক বিবেচনার উর্ধে উঠে শিল্পীকে শিল্পী হিসাবে দেখছেন বলে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা। বাংলাদেশ একটি উন্নত মানবিক দেশ হবার স্বপ্ন দেখে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা চান দেশটি উন্নত হবে শেখ হাসিনার নেতৃ্ত্বে। এরজন্যে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের মন-মানসিকতাকেও উন্নত করতে হবে।