দেশের  বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এখন জঙ্গি তৈরির কারখানা

দেশের  বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এখন জঙ্গি তৈরির কারখানা

ফজলুল বারী:হলি আর্টিজান হামলার ঘটনায় সাত জঙ্গির ফাঁসির আদেশ হয়েছে বিচারিক আদলে। আদালতকক্ষে জঙ্গিরা হাসিখুশিই ছিল। আদালত কক্ষে তারা লা ইলাহা বলে শ্লোগান দিয়েছে। কারন এই ফাঁসির মাধ্যমে তারা বেহেস্তে যাবে! তাদের মাথায় আইএস টুপি নিয়ে সবাই এখন উদ্বিগ্ন-ব্যস্ত। বাংলাদেশের মিডিয়া আজ যখন এই রায়টি নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, এই সুযোগে আমরা একটু পিছনে ঘুরে আসি। বাংলাদেশে জঙ্গির ঘটনা প্রথম কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায়। তখনকার জঙ্গিগুলো অত স্মার্ট ছিলোনা। দেশের প্রথম জঙ্গি মেজর মতিউর রহমান নামের একজন রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায়। তখনকার বিডিআর অপারেশনের মাধ্যমে সেই ঘটনা সামাল দিতে হয়। এরশাদের পতনের পর খালেদা জিয়া মাত্র তখন ক্ষমতায় এসেছেন। অকুস্থলে গিয়ে দেখি দুইপক্ষের গোলাগুলিতে বিধবস্ত একটি বাড়ি। মেজর মতিউর সেই ঘটনায় নিহত হন। তার ইসলামী রাষ্ট্রের স্বপ্নও সেখানে খতম হয়।

যশোরে উদিচীর সম্মেলনে, ঢাকায় সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলা জঙ্গি সংগঠনকে আলোচনায় আনে। তবে বাংলাদেশে জঙ্গিরা নিজেদের সামর্থ্য জানাতে চায় একই দিনে পাঁচশ স্থানে বোমা হামলার মাধ্যমে। তখনও ক্ষমতায় বিএনপি। সেই জঙ্গিরা মূলত ছিল মক্তব-মাদ্রাসার  ছাত্র। একই দিনে দেশের ৫০০ স্থানে বোমার ঘটনার দিন শুধু মুন্সিগঞ্জে জেলায় কোন বোমা ফাটেনি। এর কারন জানলে আজকের অনেকে হাসবেন। সেদিন মুন্সিগঞ্জে বোমা ফাটানোর দায়িত্ব যার ছিল সে সেখানে পৌঁছতে দেরি করে। কিন্তু ততক্ষনে সারাদেশে বোমার ঘটনায় হৈহৈ অবস্থা দেখে সে তখন বোমা না ফাটিয়ে সেগুলো এক জায়গায় ফেলে রেখেই পালিয়ে যায়। ঢাকার আশেপাশের এলাকায় বোমা ফাটিয়ে সবার মিলিত হবার কথা ছিল কাকরাইল মসজিদে। সেখান থেকে সবাই যে যার মতো করে নিরাপদ স্থানে চলে যায়।

ওই ঘটনার পর শুরু হয় ফ্লাস্ক বোমা বিস্ফোরনের মাধ্যমে আত্মঘাতী ঘটনার হুজুগ। এসব ঘটনায় মক্তব-মাদ্রাসার কমবয়সী ছাত্রদের ব্যবহার করা হতো। আদালত এলাকার মতো জনবহুল এলাকায় চা বিক্রেতার সাজে ঘুরে বেড়াতো এসব আত্মঘাতী জঙ্গি বোমারুরা। একেকটি ঘটনায় বেশ কিছু হতাহতের পাশাপাশি ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত একটি শিশু আত্মঘাতীর দেহ। অবস্থা এমন দাঁড়ায়, চায়ের ফ্লাস্ক হাতে কাউকে ঘুরতে দেখলেও অনেকে ভয় পেতো। গাজীপুরের একটি ঘটনায় ফ্লাস্ক বোমা বিস্ফোরিত হলেও সেই বোমা বহনকারী ছেলেটা দৈবাৎ বেঁচে যায়। হাসপাতালে আমি ছেলেটির ইন্টারভ্যু করেছিলাম।

এই ছেলেটিকে আত্মঘাতী  তৈরি করে যে অপারেশনে পাঠায় সেই লোকটি আগের তিন দিন তার সঙ্গে ছিল। একসঙ্গে থেকেছে খেয়েছে নামাজও পড়েছে। অপারেশনের দিন সকালে তাকে বিদায় দেবার সময় ওই লোকটি ছেলেটিকে বলেছিল, যাও বেহেস্তের পথে এগিয়ে যাও। পরের মিশনে আমি আসছি। বেহেস্তে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে। ওই ছেলেটি বোমা বিস্ফোরনে মারা না যাওয়ায় অন্তত জানতে পারলো ওই লোকটি কখনো অপারেশনে যাবেনা। বেহেস্তেও দেখা হবেনা। ওই ছেলেটিকে আমি বলি, তুমিতো মাদ্রাসায় পড়ো। এমনিতেইতো বেহেস্তে যাবে। এভাবে বোমায় মরে বেহেস্তে যাবার কী দরকার। ছেলেটি আমাকে জবাব দিয়ে বলে, মাদ্রাসায় পড়লেই বেহেস্তে যাবার  গ্যারান্টি নেই ভাই। তার এমন জবাবে আমি ভাবি, কী দারুন মগজ ধোলাই! পড়াশুনা করে চাকরি অথবা উন্নত জীবন নয়, এদের স্বপ্ন দেখানো হয় বেহেস্তের!

যশোরে উদিচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা বাংলাদেশে জঙ্গিদের প্রথম হৈচৈ ফেলা ঘটনা। এরপর একে একে ঘটে সিপিবির সমাবেশে এবং পহেলা বৈশাখের রমনার বটমূলে বোমা হামলা। রমনা বটমূলে সেদিন   আমার এসাইনমেন্ট ছিল। টেলিভিশনে লাইভ অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে বটমূলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ওই সময়েই বোমা বিস্ফোরনের ঘটনাটি লাইভ দেখি। বানিয়ারচরের গির্জা, নারায়নগঞ্জ আওয়ামী লীগের অফিসে বোমা হামলার ঘটনার রিপোর্ট করতে অকুস্থলে গিয়েছিলাম। সিলেটের টিলাগড় এলাকার সূর্যদীঘল বাড়ি’ নামের একটি বাড়ি ঘেরাও করে যেদিন শায়ক আব্দুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয় তখন আমি লেবানন যাবার পথে দুবাইতে। টেলিভিশনে সেই পর্বটি দেখতে হয়। বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে হত্যা করা হয় হযরত শাহ জালালের (রঃ) মাজারের পুকুরের সব গজার মাছ।

বাংলা ভাইকে যেদিন ময়মনসিংহ এলাকায় গ্রেফতার করা হয় সেই স্পটেও গিয়েছিলাম। সারা গায়ে কাদামাটি লাগানো অবস্থায় রক্তাক্ত আহত বাংলা ভাইকে গ্রেফতার করা হয়। মুফতি হান্নান থেকে শুরু করে বাংলা ভাই পর্যন্ত এসব জঙ্গির সঙ্গে আফগান যুদ্ধ, তালিবান সংস্পর্শ ছিল। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এসব জঙ্গিদের কেউ বিএনপি-জামায়াতপন্থী কাউকে টার্গেট করে হামলা চালায়নি। সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশার আনোয়ার চৌধুরীকে টার্গেট করে হামলা করা হয়। হবিগঞ্জেতো মারাই গেলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এম এস কিবরিয়া। জঙ্গিদের ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে খতম করার ঘটনা ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগষ্টের ঘটনা। বিএনপির এক নেতা চাঞ্চল্যকর তথ্যটি দিয়ে বলেন এর নেপথ্যে ছিলেন তারেক রহমান। কাহিনীটা রাজাবাদশার আমলের মতো শোনায়! রানী মারা গেলে রাজপুত্র ক্ষমতায় বসবেন এটা ঠিক ছিল। কিন্তু এই রাজপুত্র রানীর মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষায় রাজি ছিলেননা। শেখ হাসিনাকে হত্যা করে এর দায় রানীকে দিয়ে রাজপুত্র ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিলেন!-তখন জনকন্ঠে এভাবে নিউজটি করেছিলাম। বিএনপি তখন জজ মিয়া নাটক সাজিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দিতে চায়। কিন্তু ১/১১’র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ফাঁস হয় জজ মিয়া নাটক। অসততায় বিএনপি সেই যে দেশ পরিচালনার নৈতিক অবস্থান হারিয়েছে, আর পথ খুঁছে পায়নি।

বৈশ্বিক ছায়ায় ছোয়ায় অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের জঙ্গি ধারনাও বদলাতে শুরু করে। আগে বলা হতো মাদ্রাসা জঙ্গি উৎপাদনের কারখানা। এখন সে ধারনা এখন একতরফা প্রমানীত। শুধু মাদ্রাসা নয়, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও জঙ্গি সৃষ্টির কারখানা হয়ে উঠেছে। ২০০৫-০৬এর দিকে এক রাতে ঢাকার নিউ ইস্কাটন এলাকার বিয়াম মিলনায়তনে হিজবুত তাহরিরের একটা অনুষ্ঠানের এসাইনমেন্ট কভার করতে গিয়ে চমকে উঠি। সেখানে উপস্থিত দু’শর বেশি ছেলেমেয়ের বেশিরভাগ বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাল্টে এখানে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হচ্ছিল সেই সমাবেশে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যত জঙ্গি ধরা পড়েছে তাদের সিংহভাগ কখনও জামায়াত শিবির, কখনও জেএমবি, কখনও হিজবুত তাহরির এমন নানা নামে প্রকাশিত। কোটা সংস্কার আন্দোলন, বুয়েটের আবরার হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনের নেপথ্যে জঙ্গি সংযোগের অভিযোগ অথবা ধারনা আছে।

কিন্তু হলি আর্টিজানের ঘটনায় দেখা গেলো শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, আওয়ামী পরিবারের সদস্যও এখন জঙ্গি হচ্ছে। জঙ্গি হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধার নাতি! অনলাইন এখন অনেক জঙ্গি যোগাযোগের নতুন মাধ্যম। ভিপিএন প্রযুক্তি সহ আরও নানাকিছু ব্যবহার করে জঙ্গিদের আন্তর্জাতিক চ্যানেল তৈরি হয়ে গেছে। বাংলাদেশে বসে এটি অস্বীকার করে কোন লাভ হচ্ছে? রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যে ফুটো-ছিদ্র আছে এর প্রমান, আইএস টুপিতো তাদের হাতে চলেই গেছে। এই টুপির ছবি ছড়িয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। হলি আর্টিজানের দ্রুত বিচারের প্রশংসা খেয়ে ফেললো কালো রঙের ওই টুপি! বাংলাদেশের নতুন বিপদ বিদেশ থেকে বাংলাদেশি জঙ্গিরা বাংলাদেশে আসছে, আবার বাংলাদেশ থেকেও বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে জঙ্গিরা। বাংলাদেশের ধর্মীয় নেতারা এসব জঙ্গি তৎপরতা সম্পর্কে কেনো নীরব কবি?  এ নিয়েও তাদের জবাবদিহি করতে রাষ্ট্র কেনো নিশ্চুপ? সব কথা হোক সাফ সাফ। কোথাও কোন রাখঢাক রেখে চলা মানে জঙ্গিসমস্যার সূত্র জিইয়ে রাখা। যে দেশে একুশে ফেব্রুয়ারি হয়, পহেলা বৈশাখ আসে মুক্তিযুদ্ধের সেই দেশ কিন্তু কখনোই জঙ্গি রাষ্ট্র হবেনা।

ফজলুল বারী