ফজলুল বারী:ফজলে হাসান আবেদ। লেট এ গ্রেট ওয়ারিওর। এই মহান মানুষটির সঙ্গে নানা সময়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পর দেশের নানা মিডিয়া তাঁকে স্যার আবেদ সম্বোধনে লিখছে-বলছে। স্যার উপাধি পাওয়াতে এইসম্বোধনটি বাংলাদেশের আর কারো নেই। কিন্তু তাঁর সহকর্মীরা তাঁকে ‘আবেদ ভাই’ বলেই ডাকতেন। আমিও যতবার ডেকেছি আবেদ ভাই নামেই ডেকেছি। ব্র্যাকে আমার ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করতেন। কিন্তু পেশাগত কাজে আমি যতোবার ব্র্যাকে গেছি প্রতিষ্ঠানটির জনসংযোগ বিভাগের মাধ্যমেই গেছি। আমার প্রিয় একজন মানুষ করতেন জনসংযোগ বিভাগে। তিনি তাজুল ইসলাম। আমরা যারা ছেলেবেলায় রেডিও-টিভির খবর শুনে বড় হয়েছি তখনকার সংবাদ পাঠকদের জনপ্রিয় একজন ছিলেন তাজুল ইসলাম ছিলেন তাদের একজন। এই তাজুল ভাই-ই আমাকে একাধিকবার আবেদ ভাইর কাছে নিয়ে যান। একবার তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, আপনার হবিগঞ্জে জন্ম এই ফজলুল বারীর।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার যখন ঢাকায় আসেন তখনও ব্র্যাকের কার্যক্রম দেখতে যান। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ন যারাই আসেন তাদের কর্মসূচির প্রায় অনিবার্য অংশ এই ব্র্যাক দেখা। আবেদ ভাই অবশ্য বিষয়টিকে হালকা করতে বলেন, আমরা সরকারের সহযোগী হিসাবে কাজ করি। সাভারের জয়পাড়া গ্রামে ব্র্যাকের কার্যক্রম দেখতে যাবার কথা ছিল বিল ক্লিনটনের। আমিও তখন প্রতিদিন লিখতাম জয়পাড়া গ্রামের নানা প্রস্তুতির খবর। সম্ভাব্য জঙ্গি হামলার আশংকায় ক্লিনটনের ঢাকার বাইরের সব কর্মসূচি বাতিল হলে জয়পাড়া গ্রামের কর্মসূচি স্থানান্তর করা হয় ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে। ক্লিনটনের জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানানো, বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম দেখার কর্মসূচিও তখন বাতিল হয়। জয়পাড়া গ্রামে ব্র্যাকের যা যা দেখার কথা ছিল-যাদের সঙ্গে কথা বলার কথা ছিল সবকিছু নিয়ে আসা হয় মার্কিন দূতাবাসের নিরাপদ দেয়ালের ভিতর। আবেদ ভাইও সেখানে ছিলেন। তাই ব্র্যাক দেখা-আবেদ ভাইকে দেখার ক্লিনটনের আগ্রহ অপূর্ন থাকেনি। আবার টনি ব্লেয়ার যখন আসেন তখন ঢাকার কাছের এক গ্রামে ব্র্যাকের সুবিধাভোগীদের সঙ্গে উঠোন বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয়। গরম আবহাওয়ার কারনে টনি ব্লেয়ার সেদিন সুতির সাদা শার্ট হাত গুটিয়ে বৈঠকি কায়দায় বসেছিলেন শীতল পাটির ওপর। আবেদ ভাই সেখানে ইন্টারপ্রেটর। গ্রামের মেয়েদের জীবন বদলানোর গল্পের নানাকিছু দেখেশুনে টনি ব্লেয়ারের চোখমুখের ঝলক আজও ভুলতে পারিনা।
আরেকটি ঘটনা। ফ্রান্সের বিশ্বকাপ তারকা জিনেদিন জিদান এসেছিলেন ঢাকায়। এটিও ছিল ব্র্যাকের দাওয়াত। সেই জিদান যিনি প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে মাথা দিয়ে পেটে গুতো মেরে লাল কার্ড পেয়ে মাঠ ছেড়েও প্রখ্যাত হয়েছিলেন। সম্ভবত শক্তি দই’র প্রচারে তখন তাকে আনা হয়। ঢাকার বাইরে তাঁর গ্রাম দেখায় আমরাও সহযাত্রী হয়ে গেলাম। শুধু একটা শর্ত ছিল। তাহলো, জিদানের মাথা দিয়ে গুতো মারার ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করে বিব্রত করা যাবেনা। সব শর্তে রাজি। এমন বহু অতিথির বাংলাদেশ দেখার কারন ছিল ব্র্যাক। বাংলাদেশের নাম দুনিয়ার সবার জানার কথা নয়। কিন্তু ব্র্যাকের সূত্রেও বিশ্বের অনেকে জানে বাংলাদেশের কথা। আবেদ ভাইকে একবার কথাটি বলেছিলাম। তিনি তখন ব্র্যাকের চেয়ে বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষগুলোকে ক্রেডিট দিতে চাইলেন। বিশেষ করে গ্রামের নারীদের। তাঁর কথা সবকাজতো তারাই করে। শুধু প্রথমদিকে কিছুদিন তাদের সঙ্গে থাকতে হয়।
বাংলাদেশের ব্র্যাক অতঃপর ছড়িয়ে পড়েছে দুনিয়ার নানা দেশে। প্রথম ব্র্যাক যায় আফগানিস্তানে। পরে তাঞ্জানিয়া সহ নানা দেশে। এভাবে বাংলাদেশের ব্র্যাক এখন পৃথিবীর বৃহত্তর এনজিও। ব্র্যাক আফগানিস্তানের মজার একটা গল্প আছে। বাংলাদেশের দূতাবাস মনে করে লোকজন ভিসার জন্যে সেখানে যেত। একবার তালেবান জঙ্গিরা ব্র্যাকের এক সদস্যকে জিম্মি করে নিয়ে গেলো। দুনিয়া জুড়ে ঘটনাটি নিয়ে হৈচৈ হয়। অনেকে বলার চেষ্টা করেন ওখানে ব্র্যাকের কাজ করতে যাবার দরকার কী ছিল। আবেদ ভাই ঠান্ডামাথায় জবাব দেন। এমন দেশে এ ধরনের ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। আমরা জেনেশুনেইতো সেখানে কাজ করতে গেছি। জিম্মি উদ্ধারের কাজ চলছে। যারা জিম্মি করে তারা যখন জানতে পারে ব্র্যাক আফগানিস্তানের মানুষের উন্নতির জন্যে কাজ করছে তখন সসম্মানে মুক্তি দেয় বাংলাদেশি জিম্মিকে।
মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে আবেদ ভাই একদিন তাঁর অফিস কক্ষের জানালায় আমাকে নিয়ে দাঁড়ালেন। আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখালেন ঢাকার চারপাশের দিগন্ত রেখা। ঢাকার চারপাশ ঘিরে স্বল্প আয়ের মানুষজনের জন্যে আবাসন প্রকল্পের কথা বললেন তিনি। এই মানুষেরা সেখানেই কাজ করবে। সেখানেই থাকবে। এতে করে ঢাকার ওপর চাপ কমবে। এমন নানা প্ল্যান গিজগিজ করতো তাঁর মাথায়। আমি নানা সময়ে ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গেও কাজ করেছি। ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুস নিজের প্রচার পছন্দ করেন। আর ফজলে হাসান আবেদ ছিলেন প্রচার বিমুখ। আমাকে নানা সময়ে বলতেন যেখানে যারা কাজ করছে তাদের প্রচার দাও। তারা উৎসাহিত বোধ করবে। আমার প্রচার দিয়ে কী হবে। কাজতো করে তারাই।
ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুসের গ্রামীণ ব্যাংকের পদ ধরে রাখা নিয়ে সংঘাত দেখা দিয়েছিল। আবেদ ভাই পদ আঁকড়ে থাকা পছন্দ করতেননা। ব্র্যাকের যে যে শাখার প্রধান তিনিই ছিলেন সে শাখার বস। এই যে তাদের দেয়া সম্মান-স্বাধীনতার কারনে তারা নিজেরা নিজেদের ভাবতেন তারাই ব্র্যাক। এরজন্যে আবেদ ভাইর পরে ব্র্যাকের নেতৃত্ব নিয়ে কোন সংকট-শূন্যতা দেখা দেয়নি। জীবিতাবস্থাতেই তিনি তাঁর উত্তরসূরী সৃষ্টি করে যান। ব্র্যাকের প্রতিটি কর্মীই এভাবে ফজলে হাসান আবেদের উত্তরসূরী। আমরা যারা বিদেশে থাকি তারাও এখন ব্র্যাকের কার্যক্রমের সঙ্গে থাকি প্রতিদিন। কিভাবে? আবেদ ভাইর উদ্ভাবন বিকাশ আমাদের দেশে টাকা পাঠানো সহজ করে দিয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে টাকা পেয়ে যাচ্ছে প্রাপক। আমি আবার টাকাটা এমনভাবে পাঠাই যাতে প্রাপককে কোন ফী দিতে না হয়। ব্র্যাকের বিকাশের দেখাদেখি বাংলাদেশ সরকারের ডাক বিভাগের নগদ’ কাজ শুরু করেছে। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানতো। নগদ এখনও বিদেশে যাওয়ার সৌজন্য টিকেট খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর বিকাশ সব জায়গায় বিকশিত উড়ছেই। এভাবে দেশ-বিদেশের সব জায়গাতেই একটি নাম-একটি বিশ্বাস, আবেদ ভাই। স্যার ফজলে হাসান আবেদ।
মৃত্যু আবেদ ভাইকে বাংলাদেশের অনেক মানুষের কাছে নতুন করে চিনিয়েছে। একটি কফিনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে গোটা বাংলাদেশ। বৃহত্তর সিলেট কী তার এই কৃতি সন্তানকে সম্মান জানানো নিয়ে বিশেষ করে ভাববে? আর দেখা হলোনা প্রিয় আবেদ ভাই। আবার যখন বাংলাদেশে যাবো, অনেকের সঙ্গে দেখা হবে। আমার আবেদ ভাইর সঙ্গে দেখা হবেনা। নতুন অনেক কিছু জানা-শেখা হবেনা। নীলিমা ইব্রাহিমের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করেঃ অনন্তকালের তরে/গৌড়মন মধু করে/পান করি করিবেক/যশস্বী তোমারে।