ফজলুল বারী:বিএনপি প্রথম সুযোগেই ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ গ্রহন করে আওয়ামী লীগেরও আগে তরুন দু’জনকে মেয়র প্রার্থী হিসাবে ঘোষনা করেছে এটি একটি ইতিবাচক দিক। কিন্তু প্রথম কথা থেকেই নেতিবাচক কিছু কথামালা ভোটারদের উদ্দেশে ভুল বার্তা দিয়ে যে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা কী তারা জানে? ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হলে বিএনপির প্রার্থীরাই জিতবেন’! ভোটের আগেই জয়ের ব্যাপারে এত নিশ্চিত হয়ে গেলে ভোটারদের আর ভোটকেন্দ্রে যাবার কী দরকার! আমি জিতলে সুষ্ঠু, না জিতলে কারচুপি’ এই শিরোনামের রাজনীতি মানুষকে বিরক্ত করে। আরেকটি কথা, এই নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করবেনা, এই সরকারের আমলে কোন নির্বাচন সুষ্ঠু হবেনা, তাহলে তারা নির্বাচনে কেনো এলেন? যে নির্বাচন সুষ্ঠু হবেনা সে নির্বাচনে ভোটারদেরই বা ভোট কেন্দ্রে কষ্ট করে যেতে বলবেন কেনো তারা? মূলত বিএনপির এসব মুখস্ত প্রাক কথাবার্তার কারনে পরে দেখা যায় প্রার্থীরাই সেভাবে প্রচারে থাকেনা এবং ভোটের দিন কেন্দ্রগুলো ভোটার বিহীন খা খা করে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন এই নির্বাচন কমিশন নিয়ে কথা বলতে তাঁর রূচিতে বাঁধে! ভদ্রলোকদের ‘বিচারপতি আজিজ নামের একজন রূচিকর সিইসি’ ছিলো তা কী তারা ভুলে গেছেন?
রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগ-বিএনপি কেউ রামকৃষ্ণ মিশন না। সবাই ক্ষমতায় যেতে চায় অথবা থাকতে চায়। কিন্তু এই দুটি দল ভাবে তাদের চেয়ে জনপ্রিয় আর কেউ নয়! প্রতিপক্ষেরও যে জনপ্রিয়তা আছে, থাকতে পারে এটি কেউ মানতেই চাননা। বিএনপির কথা কাজকর্ম দেখে আমার মনে হয় বিরোধীদল কিভাবে করতে হয় বিরোধীদল থেকে কিভাবে ক্ষমতায় যেতে হয় এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের কাছে তাদের কোচিং করা উচিত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়া মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া আওয়ামী লীগ দলটিকে কিভাবে নিষিদ্ধ করে রেখেছিলেন তা কী তাদের মনে আছে? কেনো বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার তারা আটকে রেখেছিলেন? তবে কী এর মাধ্যমে মানছেন তারা এই খুনের সঙ্গে জড়িত? শুধু জিয়া নয়, খালেদা জিয়াও আটকে রেখেছিলেন এই হত্যার বিচার। গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা এই দুটি দলের মধ্যে স্থায়ী বৈরিতা তৈরি করে। শেখ হাসিনাতো খালেদা জিয়াকে গৃহপরিচারিকা সহ দেশের সবচেয়ে ভালো হাসপাতালের ভিআইপি কেবিনস্যুটে রেখেছেন।
রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপির বড় ঘাটতি এ দলটি তৈরি হয়েছিল সামরিক ক্ষমতার কাঠামোয় বসে, সামরিক ক্ষমতার কাঠামোর সহায়তায়। মূলত দলহীন অথবা আওয়ামী বিরোধী রাজনীতিকরা এই দলে যোগ দেয়। জেনারেল জিয়া শর্ত দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ তার ঘোষনাপত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করতে পারবেনা। কোন মৃত ব্যক্তির নাম ব্যবহার করে কোন রাজনৈতিক দল করা যাবেনা। এসব সামরিক ফরমানের জনককে ‘বিএনপি গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ বলে পরিচয় দেয়! জিয়ার মৃত্যুর পর বিএনপি কী মৃত ব্যক্তি জিয়ার নাম ব্যবহার করে রাজনীতি করছে? না করছেনা? একুশ বছর বৈরি পরিবেশে জেলজুলুম মোকাবেলা করে টিকে থেকে এরপরতো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরেছে। না ‘এসো এসো আমার ঘরে এসো’ গাইতে গাইতে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বরন করেছে বিএনপি! মানুষ সঙ্গে থাকলে, মানুষকে সঙ্গে রেখে চলতে পারলে কেউ কাউকে দাবায়া রাখতে পারেনা।
এবার ইভিএম প্রসঙ্গে আসি। ইভিএম বিরোধিতা যখন দেখি তখন একটা ঘটনা মনে পড়ে যা এই প্রজন্ম জানেনা। বাংলাদেশে রঙ্গিন টিভি চালুর সময়ও অনেক বিরোধিতা এসেছিল! বলা হয়েছিল রঙ্গিন টেলিভিশন ব্যয়বহুল হবে। বাংলাদেশের গরিব জনগন এতো দামে টিভি কিনতে পারবেনা। অনেক কষ্টে বোঝানো গেছে যে একসময় রঙ্গিন টেলিভিশন হবে সস্তা। এতে সবুজ পাতা সবুজ দেখাবে। লালফুল দেখাবে লাল। সাদাকালো টেলিভিশন চলে যাবে জাদুঘরে। বাংলাদেশে তখন আংশিক রঙ্গিন ছবি বানানো হতো। মূলত নায়ক-নায়িকার নাচগানের দৃশ্যগুলোর চিত্রায়ন হতো সাদাকালোয়। সিনেমার বিজ্ঞাপনে লেখা হতো নাচেগানে ভরপুর আংশিক রঙ্গিন ছবি। এরপর সিনেমা রঙ্গিন হতে শুরু করলে লেখা হতো সম্পূর্ন রঙ্গিন! আর ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশের তথ্য বিদেশে পাচার হতে পারে এই আশংকায় বিএনপিতো ফ্রি পেয়েও সাবমেরিন সংযোগ নিতে রাজি হয়নি! এরপর বাংলাদেশ অনেক ব্যয়ে সাবমেরিনের সাবলেট সংযোগ নিতে বাধ্য হয়। বিএনপি নেতারা কী এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করেন? আমি এক সময় এক পত্রিকায় কাজ করতাম। একবার এক নির্বাচনের সময় রিপোর্টাররা যাতে স্পট থেকে রিপোর্ট পাঠাতে পারে এরজন্যে রিপোর্টিং বিভাগের জন্যে দুটি লেপটপ কেনার আলোচনা হয়। চীপ রিপোর্টার তা কিনতে দিলেননা। বললেন লেপটপ ছিনতাইকারীদের হাতে রিপোর্টারের জীবন যেতে পারে। আসলে সেই চীফ রিপোর্টার তখন কম্পিউটার চালাতেই জানতেননা।
ইভিএম ভারতে ব্যবহার শুরু হয়েছে অনেক আগে। জনসংখ্যা, ভোটার যে সব দেশে বেশি, সে সব দেশে ইভিএম কার্যকর। এতে নির্বাচনের খরচেরও সাশ্রয় হয়। প্রতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কত কোটি কোটি টাকার কাগজ-কালি কেনা হয়, মুদ্রন এবং পরিবহন ব্যয় বাবদ কত খরচ হয় সে সম্পর্কে ধারনা আছে? নিউটনের সূত্র অনুসারে প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। যেমন আপনি যে ব্যাংক কার্ড বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন সেটিও হ্যাক হবার আশংকা আছে। ভারতে দেখেছি এটিএম বুথের কাছে লেখা হ্যাক এড়াতে যেন এই এটিএম ব্যবহারের পর পিন নাম্বার বদলে নেয়া নিরাপদ। এরজন্যে কী আমরা ব্যাংক কার্ড বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করিনা? এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের যত নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হয়েছে আমজনতা কিন্তু এভাবে যন্ত্রে ভোট দেয়া নিয়ে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। ভোটকেন্দ্রের লোকজনের প্রযুক্তিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারনে কোথাও কোথাও হয়তো এটির ব্যবহার ধীরগতির হয়েছে।
কিন্তু ইভিএম নিয়ে কেউ কোথাও কী কারচুপির অভিযোগ করেছে? বরঞ্চ এরমাধ্যমে কেন্দ্র ভিত্তিক ভোটের ফলাফল দেয়া যায় দ্রুতগতিতে। প্রযুক্তির ব্যবহার চলতে চলতেইতো অভিজ্ঞতা বাড়বে। আপনি যদি তা চলতেই না দেন তাহলে এটির পরিপক্ষতা আসবে কী শুধু রেজিয়া ভিলার ব্রিফিংএর শব্দচয়নে? আমিতো বাংলাদেশে নতুন বছরে যে বই দেয়া হয় এরও বিরোধী। এর টেন্ডারসহ নানান ব্যবসার মধু কেউ জানেনা। বাচ্চারা নতুন বই পেলে খুশি হয়। কিন্তু বইয়ের বোঝা যে তার ক্ষতিরও কারন হয় আজকের যুগের গবেষনা তাই বলে। সে জন্যে উন্নত বিশ্বের পড়াশুনায় আজকাল এমন বইয়ের কোন অংশগ্রহনই নেই। বছরের শুরুতে খাতাপেন্সিল কেনার ফর্দ দেয়া হয় বা তা স্কুলেই কিনতে পাওয়া যায়। ক্লাস চলে ডিজিটাল স্ক্রিনে ছবি দেখিয়ে অথবা স্কুলের সরবরাহ করা ফটোকপিতে। যেমন আমাদের এখানে এখন অতিরিক্ত ব্যয় এড়াতে কেউ কোন বিলের প্রিন্ট কপি ডাকযোগে নিতে চায় না। বিল চলে আসে ই-মেইলে। ব্যাংক ডিটেইলসে দেয়া থাকলে ডাইরেক্ট ডেভিড পদ্ধতিতে তা ব্যাংক থেকে কেটে নিয়ে যায়। আমাদের এই নেতারা বিদেশ গেলে তাদের ছেলেমেয়েরাই তাদের সব কাজ করে বলে এরা আজও প্রযুক্তিমুখী হয়ে ওঠেননি। কিন্তু দেশের পোলাপান যে কত প্রযুক্তি বান্ধব হয়ে উঠেছে তা তারা জানেনওনা।
রঙ্গিন টেলিভিশনের বিরোধিতা, সাবমেরিনের সংযোগ না নেয়ার মতো বিএনপির এই বিএনপির ইভিএমাতংকও একদিন হাস্যরসের গল্পের উপকরন হবে। অথচ বিএনপি কি চমৎকার নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি দুই তরুনকে প্রার্থী করেছে যাদের দিনেরাতের বেশিরভাগ সময় কাটে প্রযুক্তির সঙ্গে। মানুষ সঙ্গে থাকলে কে কাকে কোথায় ঠকাতে পেরেছে?