ফজলুল বারী:ভারতের সাংবাদিক রনেন মুখার্জি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কৃত্তিবাস ওঝা ছদ্মনামে কলকাতার পত্রপত্রিকায় লিখতেন। বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরা নিয়ে তাঁর মুখে শোনা গল্পটা আমার কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ন মনে হয়। রনেন মূখার্জি ভারতীয় সাংবাদিক হলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ছদ্মনামে লিখতেন কেনো? কারনটা সেখানেই। যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতে প্রায় তিনি ঝুঁকি নিয়ে ছদ্মবেশে বাংলাদেশের ভেতর ঢুকে পড়তেন। নিরাপত্তার কারনেই তখন তিনি কৃত্তিবাস ওঝা ছদ্মনাম নেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সারাদেশ তখনও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। পাকিস্তানিদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সেতু উড়িয়ে দেয়। অনেক সেতু ধংস করে পাকিস্তানিরাও।
ওই অবস্থায় হেঁটে, নৌকায়, গাড়িতে ঢাকা এসে পৌঁছেন মুক্তিযুদ্ধের সাংবাদিক রনেন মুখার্জি। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে যখন তাঁর ঢাকার বাড়িতে ফোন করে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন তখন তিনি সেই বাড়িতে। তাঁর সামনেই ফোন রিসিভ করেন কাঁদেন শেখ হাসিনা-শেখ রেহানা দুই বোন। কারন তখন সেই ফোন কল পেয়ে প্রথম তারা জানেন-নিশ্চিত হন তাদের প্রান প্রিয় পিতা, বাঙালির প্রানের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে আছেন। এরপর ফোন হাতে নিয়ে বেগম মুজিব যা বলেন তাতে চমকে যান রনেন মুখার্জি।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংগ্রহ-গ্রন্থনা করতে গিয়ে লেখা একাত্তরের কলকাতা, একাত্তরের আগরতলা নামের আমার দুটি বই আছে। বই দুটির কাজে বিভিন্ন সময়ে ভারতীয় শহর দুটিতে মাসের পর মাস কাটিয়েছি। আমার কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক রাজধানী কলকাতা। প্রবাসী সরকারের সদর দরবার সেখানেই ছিল। আর সামরিক রাজধানী ছিল আগরতলা। মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশ নিয়েছেন তাদের বড় অংশ আগরতলা দিয়েই প্রথম ভারতে ঢুকেছেন। আগরতলা সার্কিট হাউসে এমএনএ, এমপিএ’দের বৈঠকেই প্রবাসী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
নব্বুইয়ের দশকের শুরুতে আমি কলকাতার সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকায় টুকটাক কাজ করি। কলকাতা গেলেই সেই অফিসে আড্ডা মারতে যাই। সে পত্রিকার জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় নামের একজনকেই ভালো চিনি জানি। মূলত স্পোর্টস রিপোর্টার হলেও তখন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ই পত্রিকাটির পরিচালনার অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। একাত্তরের কলকাতায় যারা বাংলাদেশের জন্যে কাজ করেছেন এমন ব্যক্তিদের তালিকা চাইলে জয়ন্ত দা এই রনেন মুখার্জির নাম দেন সবার আগে। আমার উদ্দেশ্য শুনে ট্রেনে করে আমাকে নৈহাটির বাড়ি নিয়ে যান রনেন মুখার্জি। তাঁর ঘরে ঢুকেতো আমি চমকে যাই। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত শুধু বই, পত্রপত্রিকা। এর প্রায় সবগুলোই বাংলাদেশ সংক্রান্ত। এরজন্যে একাত্তরের বাংলাদেশের বই, পত্রপত্রিকার তথ্য নিতে আমাকে বেশ কিছুদিন নৈহাটির সেই বাড়িটায় যাতায়াত করতে হয়েছে।
রনেন মুখার্জির বর্ননামতে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত স্বামীর ফোন ধরে বেগম মুজিব ঠান্ডা মাথায় বলেন, ‘এই শোন তুমি কিন্তু দেশে আইবার সময় প্রথম ইন্ডিয়া যাইবা না। ইন্ডিয়া যদি যাও তাহলে এর আগে আরেক দেশে যাইবা। এরপর যাইবা ইন্ডিয়া। তুমি যদি ডাইরেক্ট ইন্ডিয়া যাও তা হইলে তারা তুমারে ইন্ডিয়ান লোক কইতে শুরু করবো’। এরপর মিঃ মুখার্জি বলেন, বেগম মুজিবকে আমি মনে করেছিলাম সাদামাটা এক গৃহবধূ। তাঁর পরনের কাপড়, কাপড় পরার ধরনে তাকে খুব সাদামাটাই মনে হয়েছে। কিন্তু ফোনের ওই কথাবার্তা শুনে আমি চমকে যাই। আমার ধারনা পাল্টে যায়।
আমি তখন থেকে ভাবতে শুরু করি বেগম মুজিব একজন তীক্ষ্ম কূটনৈতিক বুদ্ধি-মেধা সম্পন্ন একজন নারীও। সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর খুনিরাও তা জানতো বলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাকেও সপরিবারে হত্যা করেছিল। কারন তাদের ভয় ছিল বেগম মুজিব বেঁচে থাকলে তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে চলে আসতে পারেন।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে অতঃপর বঙ্গবন্ধু প্রথম যান লন্ডনে। তখনও তিনি কোন অফিসিয়েল সরকার প্রধান নন। কিন্তু তাকে সরকার প্রধানের চেয়েও বড় সম্মান দেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে নামার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে তাঁকে সেই সময়ের সবচেয়ে দামী ক্ল্যারিজেস হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ তাঁকে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের বাড়িতে অভ্যর্থনা করেন। বিজয়ী বাংলাদেশের নেতা হিসাবে বঙ্গবন্ধু তখন আন্তর্জাতিক তারকা ব্যক্তিত্ব। বঙ্গবন্ধুকে সম্মান দিয়ে এভাবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীও আন্তর্জাতিক সম্মান পেয়েছেন।
লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধু এসে পৌঁছেন দিল্লী, পালাম বিমান বন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা করেন তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। বাংলাদেশ যুগ যুগ ধরে চেষ্টা করলেও এই ইন্দিরা গান্ধীর ঋন কোনদিন শোধ করতে পারবেনা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শুধু সর্বাত্মক সহায়তা নয়, লাখ লাখ শরণার্থীর জীবন বাঁচিয়েছেন এই ইন্দিরা। তাঁর প্রসঙ্গ এ লেখায় টেনে আনার প্রসঙ্গ ভিন্ন। ভারতে সর্বশেষ যখন কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে তখন এনডিটিভি সোনিয়া গান্ধী। তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা উল্লেখ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কথা বলেন সোনিয়া। তিনি বলেন, আমি তখন শুধুই গৃহবধূ। ওই সময়ে শেখ মুজিব আমাদের বাড়িতে আসেন। তাঁর আসার খবরে, তাঁকে দেখে আমি আলোড়িত হয়েছি। কারন তিনি সেই নেতা যার নামে একটি দেশের মানুষজন যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে।
বঙ্গবন্ধু যেদিন দেশে ফিরে আসেন তাঁর ফিরে আসার রিপোর্ট করেছেন সাংবাদিক আহমদ নূরে আলম। তিনি বলেন দেশ স্বাধীন হলেও বঙ্গবন্ধু না থাকাতে দেশের মানুষ খুশি হতে পারছিলোনা। তিনি আদৌ বেঁচে আছেন কিনা এ নিয়েও অনেক সংশয় ছিল। কিন্তু যেদিন জানা গেলো বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন, তিনি দেশে আসছেন তখন সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। তখন বিমান বন্দর ছিল তেজগাঁওতে। সেখানেই বঙ্গবন্ধুর বিমান এসে অবতরন করেন। লাখ লাখ মানুষের ভিড় ঠেলে সেদিন বঙ্গবন্ধুকে বিমান বন্দর থেকে থেকে নিয়ে আসে অনেক সময় লেগেছে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর বারবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিলো। বঙ্গবন্ধুর কান্না দেখে জনতাও হাউমাউ করে কাঁদছিল। প্রানের নেতাকে বরনে বাংলাদেশের ইতিহাসে এত মানুষের সমাবেশ আর ঘটেনি। ঘটবেওনা আর।