ফজলুল বারী:নারায়নগঞ্জের টানবাজার পতিতালয় উচ্ছেদের সময় সেই পতিতা পল্লীর বাসিন্দাদের ইন্টারভ্যু করতে গিয়ে একটি অনুভবে মানসিকভাবে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশে যারা পতিতাবৃত্তি গ্রহনে বাধ্য হয়েছেন তাদের প্রত্যেকের পিছনে রয়েছে সংশ্লিষ্ট একজন পুরুষের অপরাধ। আরেকভাবে বলতে গেলে অন্ধকারের জীবন নিতে বাধ্য হওয়া এদের সবাই কোন না কোন পুরুষের লালসা-প্রতারনার শিকার। সখ করে কেউ পতিতা হয়না। সেই সব দূর্ঘটনার পর এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল যে ভন্ড প্রতারক পুরুষটি সমাজে ভালো মানুষের বেশে মিশে গেলেও পরিবার-সমাজ মেয়েটিকে আর গ্রহন করেনি। সৌদি আরবের বাসা বাড়িতে কাজের মেয়ে হিসাবে কাজ করতে যাওয়া নিপীড়নের শিকার নারীদের নিয়ে যে হৈচৈ হয় এর আরেক দিক আছে। দাস যুগের আধুনিক সময়ের নাম গৃহকর্মী। বাসা বাড়িতে যে সব গৃহকর্মী যারা রাখেন তাদের সিংহভাগের মনোজগতে দাসযুগের মনিব মনোবৃত্তি কাজ করে। এমন মনিব মনোবৃত্তির নিপীড়ক লোকজন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে আছে। এর শিকার হবার জন্যে সৌদি আরব যাওয়া লাগেনা। ঘন্টায় কমপক্ষে ১৫ ডলার খরচ করে অস্ট্রেলিয়ার কারও গৃহকর্মী রাখার সামর্থ্য নেই। এদেশ থেকে গৃহকর্মী লাঞ্ছনার সংবাদও সৃষ্টি হয়না।
সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে মেয়েটি ধর্ষনের শিকার হয়েছে তাঁর প্রতিবাদী মনোবৃত্তির জন্যে তাঁর পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমত সংগঠিত হয়েছে। যেমন ঘটেছিল ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাতের প্রতিবাদের কারনেও। বাংলাদেশের যৌন নির্যাতনের সিংহভাগ ঘটনার প্রতিবাদ হয়না, অথবা প্রতিবাদ ভাইরাল হয়না। ধর্ষনের শিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাপ্তি ছদ্মনামের মেয়েটি ওই আঘাতে আলুথালু অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ব্যস্ততম রাস্তা পেরিয়ে বান্ধবীর বাসায় গিয়ে পৌঁছেছে। সেখান থেকে ঘটনা জানিয়েছে তাঁর স্বজনদের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। এরপর গিয়ে ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে। রাতেই ঘটনাটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। ছাত্রলীগ রাতেই ঘটনার প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে মিছিল করে। পরদিন থেকে এই প্রতিবাদ ছড়িয়ে যায় সবখানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং আইনশৃংখলা বাহিনীর সক্রিয়তায় ধর্ষিতা মেয়েটি সাহস পায়। ঘটনাটি ক্লুলেস হলেও আইনশৃংখলা বাহিনী সমূহের পেশাদারিত্ব-সুস্থ একটি প্রতিযোগিতার কারনে র্যাব দ্রুত ধরতে পারে একমাত্র ধর্ষক মজনুকে। কিন্তু এরপর থেকে যা যা ঘটেছে এর একটি দিক মনে করিয়ে দিয়েছে তাহলো, আপাতত হাসপাতাল ছাড়লেও লাঞ্ছনার সমাপ্তি নেই ধর্ষিতা সমাপ্তির।
ধর্ষিতার কাছ থেকে পাওয়া বর্ননার সূত্র ধরে র্যাব মজনুকে খুঁজে বের করেছে। তার ছবি দেখে তাকেই ধর্ষক বলে চিহ্নিত করেছে ধর্ষিতা। কিন্তু এই মজনুই ধর্ষক কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ডাকসুর ভিপি নুরুর মতো কিছু লোকজন! সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু নারীর ফেসবুক স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট ভাসছে যেগুলোয় এই ভাঙ্গাচোরা চেহারার মজনুর ধর্ষন করার শারীরিক সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে! যে কোন বিষয়ে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা বা না করার অধিকার সবার আছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়ার ভাষা এবং দৃষ্টিভঙ্গি। একজন ডাকসুর ভিপি হয়েছেন বলে এই নয় যে তিনি সকল শাস্ত্রের পন্ডিত হয়ে গেছেন। প্রত্যেকের যার যার পদের ওজন মর্যাদা রেখে কথা বলা বা আচরন করা উচিত। সমাপ্তি ছদ্মনামের মেয়েটিকে ঘুরে দাঁড়ানোর মতো যথেষ্ট সাহসী বলে উল্লেখ করেছেন তাঁর এক শিক্ষিকা। কাজেও কারও এমন কিছু করা বা বলা উচিত নয় যা সমাপ্তি ছদ্মনামের মেয়েটিকেও বিব্রত করবে।
বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে ধর্ষিতাকে পদে পদে কিভাবে নিগৃহিত হতে হয় তা এখানে লিখবো। একজন যে ধর্ষিতা হয়েছে প্রমান রাখতে ধর্ষিতাকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্যে যেতে হয় হাসপাতালে। পুলিশ-চিকিৎসক যদি প্রভাবিত হয় তাহলে এই ডাক্তারি পরীক্ষা নিয়ে চলে নানান টালবাহানা। বিচার পেতে এই সমাপ্তিকে ডাক্তারি পরীক্ষায় পাশ করতে হয়েছে। সিআইডির বিশেষজ্ঞরা ঘটনাস্থলের নানান আলামত সংগ্রহ করেছে। মজনুকে চিহ্নিত করার পর তার ছবি দেখিয়ে ধর্ষক হিসাবে নিশ্চিত করেছে র্যাব। কিন্তু সিআইডি যে সব আলামত সংগ্রহ করেছে সেগুলোর আঙ্গুলের ছাপ সহ নানাকিছুর সঙ্গে ধর্ষক মজনুকে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা হয়েছে কী? মজনুর ডিএনএ পরীক্ষায় তাকে ধর্ষক হিসাবে চূড়ান্ত করা গেলে তা কী আরও অকাট্য হতোনা? নইলে ঘটনাস্থলের আলামতের রাসায়নিক পরীক্ষার কাজ কী। ধর্ষক মজনু এত দ্রুত ধরা না পড়লে তদন্ত হয়তো সে পথেই হাঁটতো, এখনও মজনুকে নিয়ে হয়তো সে পরীক্ষাগুলোই মেলানো হবে, র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়গুলোও বলা যেতো। এখন বলা হচ্ছে টিআই প্যারেড করে ধর্ষক চিহ্নিত করা! যে মেয়েটি সব হারিয়েছে তাকে যে কোনভাবে ছবির আয়োজনে নিয়ে আসার মতলব নাকি!
মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল লম্পট সিরাজউদ্দৌলার হাতে নুসরাতের নিগ্রহের পর ওসি মোয়াজ্জেম তাকে থানায় ডেকে নিয়ে আরও নিগ্রহের জন্যে ভিডিও ধারন করে অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়া হয়! এরপরও ওসি মিজানকে গ্রেফতার করতে পুলিশকে নানা ভনিতা করতে হয়েছে। নুসরাত যখন ঢাকায় বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে তখনও যৌন নিপীড়ক লম্পট সিরাজউদ্দৌলার পক্ষে একদল ভাড়াটে মাঠে নেমে গিয়েছিল। এরসঙ্গে আওয়ামী লীগাররাও ছিলেন! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হস্তক্ষেপ না করলে নুসরাতের সাহসী প্রতিবাদীর মৃত্যুর কী গতি হতো ভাবতে পারেন? নুসরাততো মরে বেঁচেছে, কিন্তু বিচার চলাকালে আদালতে আসামীপক্ষের আইনজীবীরা নুসরাতের মাকে কি সব বাক্যে জর্জরিত করেছেন তা কি মনে করতে পারেন?
ঢাকা বিদ্যালয়ের ধর্ষিতা ছাত্রীর মামলাটি যখন বিচারের জন্যে আদালতে উঠবে তখনও কিন্তু একই অবস্থার সৃষ্টি হবে। আদালতে সশরীরে উপস্থিত থেকে তাকে আবার প্রমান করতে হবে সে কিভাবে ধর্ষিতা হয়েছে ওই ঝোপের ভিতর! বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মূল্যবোধ-আইন এরসবই কিন্তু এভাবে ধর্ষক পুরুষ নয় ধর্ষিতা নারীর আরও নিগ্রহের উপযোগী। এমন বাস্তবতায় কিভাবে এই দেশে এই সমাজে মাথা তুলে হাঁটতে পারবে ভগ্নি সাহসিকা সমাপ্তি? বিএনপির আমলের আলোচিতা ধর্ষিতা পূর্নিমাকে একটি চাকরি দিয়েছিলেন তৎকালীন মন্ত্রী তারানা হালিম। বিএনপির এই প্রজন্মের শব্দ ধর্ষকরাও কিন্তু এরজন্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় হয়ে ওঠে! কটুক্তিপূর্ন উক্তিতে তারা পূর্নিমাকে শব্দ ধর্ষন করে যাচ্ছিল! এভাবে দুই যুগেও ধর্ষিতা পূর্নিমার ভোগান্তির সমাপ্তি ঘটেনি।