ফজলুল বারী:একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আজ ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লিখি প্রিয় প্রজন্ম। আমি এখন বিদেশে থাকি। অস্ট্রেলিয়ায়। ভাষা শিক্ষা নিয়ে আমি এখানে যে কথাগুলো লিখবো তা আমার বিদেশে থাকার একান্ত অভিজ্ঞতা-উপলদ্ধি। দেশে থাকতে আমিও কথাগুলো এভাবে ভাবিনি। মাতৃভাষার জন্যে বাঙালিরা যা করেছে তা বিশ্বে তুলনাহীন। আর মাতৃভাষার জন্যে সিলেটিরা আসামের শিলচরে যে আন্দোলন করেছিল সেটিও নজিরবিহীন! একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হওয়াতে এর ব্যাপ্তি নিয়ে এখন নতুন চিন্তার সৃষ্টি করেছে।
পাকিস্তানিরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলা চর্চার স্বাধীনতায় ওপর হস্তক্ষেপ করার অগ্নিগর্ভ প্রতিবাদে একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়। সেই দিনটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হওয়াতে আমরা এখন অন্য কারও মাতৃভাষাকেও অবজ্ঞা-অবহেলা করতে পারিনা। জগতের সব সম্পর্ক অর্থনৈতিক। অর্থনৈতিক কারনেই মানুষ দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষ এখন সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। যে যেখানে ভালো আছেন এর পিছনে সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষা দক্ষতা গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছে। তুমি যদি বিদেশের কোথাও প্রতিষ্ঠা চাও সে দেশের ভাষাটা আগে ভালো করতে শিখতে জানতে হবে প্রিয় প্রজন্ম। আর এখানে কাজ মানে শুধু চাকরি নয়, ব্যবসাও। বাংলাদেশের লোকজন এখন আফ্রিকা অথবা দক্ষিন আমেরিকার এমন অনেক দেশে চাকরিতে-ব্যবসায় ভালো থাকার কারন তাদের সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষা দক্ষতা।
কিন্তু সবার আগে শুদ্ধ করে জানতে হবে নিজের মাতৃভাষা। অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় ২০০ দেশের মানুষ বসবাস করেন। এখানে এমন কিছু দেশের ভাষা শিক্ষার ক্লাসে উপস্থিত থাকার সুযোগ আমার হয়েছে। ভাষা শিক্ষার ক্লাসে একজন শিক্ষক একটি কমন ফর্মূলা কাজে লাগান। একটি ভাষার একটি বাক্য ভালো করে হদয়ঙ্গমের জন্যে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীকে বলা হয়নি ওই বাক্যটি তার নিজের মাতৃভাষায় আগে মনে মনে ভাবার জন্যে। এভাবে ভাষা শেখালে তা একজনের পক্ষে সহজে রপ্ত করা সহজ হয়। এভাবে ভাষা শিখলে তা ভোলা কঠিন। ভাষা শিক্ষা গুরুত্বপূর্ন সাংবাদিকদের জন্যেও। রিপোর্টের কাজে আমাকে ছয়টি আরব দেশে যেতে হয়েছে। ভাষা বুঝতে অনেক সময় ভাড়া করতে হয়েছে দোভাষীও। কুড়িটি আরব দেশের ভাষা আরবি। অনেক দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে উর্ধতন সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকে সেখানে আরবি ছাড়া অন্য ভাষা জানেননা বা অন্য ভাষা না জানলে তাদের চলে। কিন্তু একটি রিপোর্ট যথাযথ শুদ্ধ করে লিখতে আমাদেরতো সেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বা সরকারি কর্মকর্তার ভাষা জানা দরকার।
কোরান পড়তে আমাদের যে আরবি শেখানো হয়েছিল তখন অর্থ শেখানো হয়নি। আমাদের শৈশবে যারা আমাদের আরবি শিখিয়েছিলেন তারা সম্ভবত নিজেরাও এর অর্থ জানতেননা। উল্টো বলার চেষ্টা করতেন আল্লাহর ভাষা আরবি ছাড়া অন্য ভাষায় শেখার চেষ্টা বেয়াদবির সামিল! বেয়াদবির ভয়ে আমরা হুজুরের বেতের নীচে বসে আরবি মুখস্ত করে গেছি, একের পর একর কোরান খতম করে গেছি, কিন্তু অর্থ না বোঝায় তা আমাদের মধ্যে কোন অনুভবের সৃষ্টি করেনা। আরব দেশগুলোতে গিয়ে দেখি সেখানকার আরবি পত্রিকাও পড়তে পারিনা। কারন আমরা আরবি শিখেছিলাম জের জবর সহ। তাদের আরবি পত্রিকা মুদ্রিত হয় জের জবর ছাড়া!
আমার দেখা প্রথম আরব দেশ মিশর। ঘর থেকে বেরুলে ট্যাক্সিওয়ালাদের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয় এমন কিছু আরবি শব্দ তখন শিখে নিয়েছিলাম। যেমন ‘আলাতুল’ মানে ‘সোজা’, ‘সীমাল’ মানে ডানে, ‘ইয়েমিন’ মানে ‘বামে’, ‘আহলান ওয়াস সাহলান’ মানে ‘শুভেচ্ছা স্বাগতম’, ‘শুকরান’ মানে ‘ধন্যবাদ’, ‘খালাস’ মানে ‘শেষ’। তাকি’ নামের একটি কারখানার পাশে আমি থাকতাম। সেখানে যেতে ট্যাক্সিওয়ালাকে বলতাম ‘আমামা তাকি’। আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসের কাছে এক ফ্যাক্সের দোকানে রিপোর্ট ফ্যাক্স করতে যেতাম। সেখানে যেতে বলতে হতো, ‘হাদিকাতুত দৌলিয়া’। ফ্যাক্সে রিপোর্ট পাঠানোর কথা পড়ে এই প্রজন্মের রিপোর্টাররা চমকে যেতে পারে। আমাদের সাংবাদিকতার শুরুটা ছিল এনালগ সময়। রিপোর্ট পাঠাতে এক হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ইরাকের বাগদাদ থেকে জর্দানের আম্মানেও আসতে হয়েছে। রিপোর্ট পাঠিয়ে আবার ফিরে যেতে হয়েছে বাগদাদে। কারন সাদ্দাম হোসেনকে কাবু করতে মার্কিনিরা ইরাকের বিদ্যুৎ-ইন্টারনেট সব ব্যবস্থাই ধংস করে দিয়েছিল।
বাংলাদেশ কোথায় তা তখন মিশরের অনেক লোক জানতোনা। তাদের বলতে হতো ‘গাম্বল হিন্দ’ মানে ‘ভারতের পাশে’। কায়রোর সিনেমা হলে তখন হিন্দি ছবি চলতো। সে কারনে ভারত দেশটিকে তারা চিনতো-জানতো। বাংলাদেশ চেনার পর বলতো সে সৌদি আরবে থাকতে অনেক বাংলাদেশি তার সঙ্গে কাজ করতো। তারা খুব গরিব। তাই খুব নিম্ন মজুরির কাজ করে। বিদেশে বাংলাদেশিদের কাজ না পাওয়া, ভালো কাজ না পাবার মূল কারন ভাষায় অদক্ষতা। ভাষায় দক্ষতা হবার পর এরাই একদিন ভালো কাজ পান। বাংলাদেশের গৃহকর্মীদের সৌদি আরবে নির্যাতনের যে সব রিপোর্ট দেশের মিডিয়ায় হয় এর বেশিরভাগ অর্ধ সত্য, একপেশে। বাংলাদেশের মতো যে সব দেশে শ্রম শোষন সম্ভব সে সব দেশেই গৃহকর্মী রাখা হয়।
অস্ট্রেলিয়ায় কারও বাড়িতে গৃহকর্মী নেই। কারন ঘন্টায় ১৫-৩০ ডলার ব্যয়ে গৃহকর্মী রাখার সামর্থ্য মানুষজনের নেই। আর আরবরা ঐতিহ্যগতভাবে বর্বর বলেইতো সে সব দেশ থেকে ধর্ম প্রচার শুরু হয়েছিল। সৌদি আরবে গৃহকর্মী নির্যাতনের সূচনা ভাষা সমস্যা থেকে। এক কথা বললে বোঝে আরেক কথা। সিলেটি কোন পরিবারে যখন অন্য জেলার গৃহকর্মী নেয়া হয় তখন কী অবস্থার সৃষ্টি হয়। এভাবে প্রথম দিনেই নতুন গৃহকর্মী সম্পর্কে সৃষ্টি হয় একটি নেতিবাচক ধারনার। সেটি আর ইতিবাচক হয়না। করিমনের মা গেছেন একজনের বাসায় কাজ করতে। আর করিমনের বাপ কাজের সময় যখন তখন ফোন করেন! আর আপনি গেছেন আরব দেশে কাজ করতে আর আপনি তিন বেলা ভাত খেতে চান! সবই সম্ভব ছিল, যদি শুরু থেকে ভাষা আর কাজ দিয়ে নতুন একটি পরিবেশ জয় করা সম্ভব হয়। আর গৃহকর্মীর যৌন নিপীড়নের অভিজ্ঞতা নিতে সৌদি আরব যাওয়া লাগেনা। গৃহকর্মীদের বাংলাদেশের সব মানুষ ফেরেস্তা না।
প্রিয় প্রজন্মদের বলি, কাজ-ব্যবসার জন্যে বিদেশ না গিয়ে দেশে কিছু করার চেষ্টা উত্তম। কেউ যদি বিদেশ যেতেই চাও, ভাষাটা ভালো করে জানতে শিখতে লিখতে পড়তে পারতে হবে। বাংলাদেশে এখন অনেক ভারতীয় কাজ করেন। কারন ভারতের সঙ্গে যাদের ব্যবসা তারা হিন্দি লিখতে পড়তে পারে এমন ছেলেমেয়েকে যেচে কাজ দিয়ে নিয়ে আসেন। আর ভারতীয় ছেলেমেয়েগুলো ইংরেজিতেও দক্ষ। এখন বাংলাদেশে যে দশ হাজারের বেশি চীনা নাগরিক কাজ করেন তা সাম্প্রতিক করোনা ভাইরাস সংকটের আগে অনেকে জানতেনইনা। গার্মেন্টস-টেক্সটাইল সেক্টরে কাজ করেন বিস্তর পাকিস্তানি। কিন্তু চোখ-ক্ষোভ-রোগ বেশিরভাগের ভারতীয়তে। অথচ অর্থনীতির প্রয়োজনে দরকার হলে ইংরেজিতো বটেই হিন্দি-চীনা-আরবি যা যেখানে দরকার তা আমাদের লিখতে পড়তে শিখতে জানতে হবে প্রিয় প্রজন্ম। এখন বাংলাদেশে যারা কাজ করতে আসেন তাদের অনেকে বাংলাভাষা শিখে আসেন। বাংলাদেশ যখন উন্নত দেশ হবে তখন এদেশে কাজ করতে আসার জন্যেও বাধ্যতামূলক বাংলাভাষা শিখে আসতে হবে। বাংলাদেশে মাঝে মধ্যে ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ডের বিরুদ্ধে অভিযান দেখলেও হাসিও পায়। অথচ আমরাই অচেনা বিদেশের পথ-ঘাট-এলাকা চিনতে খুঁজি ইংরেজিতে লেখা কোন সাইনবোর্ড।