” মাতৃভাষা চর্চায় উৎসাহী কৌশল”
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের ২০তম বার্ষিকী উপলক্ষে একুশে ফেব্রুয়ারি’২০ তারিখে অনুষ্ঠিত “মাল্টিলিঙ্গুয়াল ফেস্টিভাল” বহুভাষাভিত্তিক সমাজে মাতৃভাষা চর্চা এবং সংরক্ষণে একটি অত্যন্ত উৎসাহব্যাঞ্জক এবং ফলপ্রসূ কৌশল হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। এমএলসি মুভমেন্ট প্রণীত “মাল্টিলিঙ্গুয়াল ফেস্টিভাল” এ সমন্বিত চারটি বিষয়ে সাতটি ভাষার দশটি সংগঠনের সর্বমোট ২২৪ জন শিশুকিশোরের নিবন্ধন এবং উৎসাহী অংশগ্রহণ দিবসটির তাৎপর্যকে যথার্থভাবে সার্বজনীনতায় উপস্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি করে। কৌশলের চারটি উপাদান ছিল যথাক্রমে- (১)নিজ নিজ ভাষার বর্ণমালা প্রদর্শনী; (২)বর্ণমালা লেখা প্রতিযোগিতা; (৩)ভিন্ন ভাষাভাষীদের মাঝে নিজের মাতৃভাষার পরিচয় করিয়ে দেয়া; এবং (৪) মাতৃভাষা ভিত্তিক সংস্কৃতির অনুষ্ঠান। কাম্বারল্যান্ড কাউন্সিলের আর্থিক অনুদান এবং বিশটিরও বেশী ভাষাভাষী কমিউনিটির সহায়তায় এই দৃষ্টান্তমূলক আয়োজন মহান একুশের চেতনার বিশ্বায়নের পথে একটি মাইলফলক। মহান একুশের অপরাহ্ণে স্থানীয় রেডগাম ফাংশান সেন্টার, ওয়েন্টওয়ার্তভীলে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন ভাষাভাষী শিশুকিশোরদের উপছেপড়া সমারোহ বাংলার মহান একুশকে সকল ভাষাভাষীর মহান একুশের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার নতুন এক অধ্যায় সূচিত হয়। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেককে বাংলা ইংরেজি উভয় ভাষায় একুশে/21st ফেব্রুয়ারি ইন্টারন্যাসন্যাল মাদার ল্যাংগুয়েজ ডে’ লেখাকে অর্ধ বৃত্তাকারে ঘেরা “কন্সারভ ইউর মাদার ল্যাংগুয়েজ” বার্তা খচিত সার্টিফিকেট, মেডেল এবং ট্রফি দিয়ে অভিনন্দিত করা হয়।
বাংলা এবং ইংরেজিতে সংকলিত প্রায় ২০ মিনিটের গীতি-নৃত্য-নাট্যের মধ্য দিয়ে বাংলার মহান একুশে’র “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে ঈর্ষনীয় অধিষ্ঠানের ঐতিহাসিক তথ্যাদি ভিন্ন ভাষাভাষীদের কাছে ‘বাংলা এবং একুশ’কে তাৎপর্যপূর্ণভাবে উপস্থাপনা ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ। অনুপম দেবের গ্রন্থনা এবং পরিচালনায় ‘কিশলয় কচিকাঁচা’র ছোট্ট শিশুদের অনবদ্য উপস্থাপনায় ‘বাংলা এবং একুশ’কে অন্যান্য ভাষাভাষীদের মাঝে সহজতরভাবে পরিচিত করণের জটিল এই কাজটি সঞ্চালনা এবং করিওগ্রাফির দায়িত্বপালন করেন রোকসানা রহমান। অনুষ্ঠানের শুরুতে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালনের মধ্যদিয়ে ভাষা শহীদ এবং ভাষারক্ষার সকল কর্মী স্বেচ্ছাসেবকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। মাননীয় প্রিমিয়ারের প্রতিনিধি হিসেবে মার্ক টেইলর এমপি, বিরোধী দলীয় নেতার প্রতিনিধি হিসেবে জুলিয়া ফিন এমপি এবং কাম্বারল্যান্ড কাউন্সিলের পক্ষ্যে কাউন্সিলর লিসা লেক শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন। তাছাড়াও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মাতৃভাষা সংরক্ষণের গুরুত্ব বিষয়ে রাজ দত্ত; পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে মাতৃভাষার চর্চার গুরুত্বের বিষয়ে মুল্যবান বক্তব্য রাখেন এনএসডব্লিউ স্টেট হারমনি এওয়ার্ড-২০১৯ এ সম্মানিত চন্দ্রিকা সুব্রামানিয়ান এবং ব্লাকটাউন সিটি কাউন্সিলের পক্ষে কাউন্সিলর সুসাই বেঞ্জামিন। স্বাগত বক্তব্যে নির্মল পাল প্রায় দুই মাস ব্যাপী শিশুকিশোর, শিক্ষক এবং অভিবাবকদের উৎসাহী অংশগ্রহণ “মাল্টিলিঙ্গুয়াল ফেস্টিভাল” দর্শনকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা উদযাপনের একটি বৈশ্বিক মডেল হিসেবে ইউনেস্কো বরাবরে উপস্থাপনার সুযোগ করে দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানান এবং এই ব্যতিক্রমী প্রকল্প অনুমোদনের জন্য কাম্বারল্যান্ড কাউন্সিলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
সার্বিকভাবে “মাল্টিলিঙ্গুয়াল ফেস্টিভাল” অনুষ্ঠানটি ছিল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে প্রায় দুই মাস সময় ধরে শিশুকিশোরদের নিজ নিজ মাতৃভাষা শেখা, লেখার চর্চা এবং মাতৃভাষা বিষয়ক উপস্থাপনার অনুশীলন এবং প্রশিক্ষণের উৎসবমুখর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। অভিবাবক, শিক্ষক, সামাজিক নেতৃবৃন্দ এবং বন্ধুদের সমাবেত সমাবেশে নিজ নিজ মাতৃভাষা চর্চা, বর্ণমালা প্রদর্শনী বোর্ড নির্মাণ, মাতৃভাষা লেখা প্রতিযোগিতা, বক্তৃতা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী সকল ভাষার শিশুকিশোরকে আনুষ্ঠানিকভাবে উৎসাহিত করার মাধ্যমে একুশের চেতনায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের গুরুত্বকে বৃহত্তর কমিউনিটির মাঝে তুলে ধরা। “মাল্টিলিঙ্গুয়াল ফেস্টিভাল” সারা বছরব্যাপী নিজ নিজ মাতৃভাষা শেখা এবং চর্চায় নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করে তোলার ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে অভিবাবক, শিক্ষক এবং সমাজের যৌথ প্রচেষ্টার সফলতর কৌশল হিসেবে চিত্রিত হয়েছে।
বর্ণমালা প্রদর্শনীঃ নিজ নিজ মাতৃভাষাকে অন্যান্য মাতৃভাষাভাষীদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রদর্শনের মাধ্যমে পরিচিত করার সুযোগের মধ্য দিয়ে শিশু-কিশোরদেরকে নিজনিজ মাতৃভাষা শেখা, লেখা এবং উপস্থাপনে উৎসাহী করে তোলা বর্ণমালা প্রদর্শনীর লক্ষ্। নিয়মিত বা প্রতিবছর এই প্রদর্শনীর প্রস্তুতি হিসেবে অভিবাবক, শিক্ষক সকলেই শিশু-কিশোরদের সারা বছরব্যাপী বর্ণমালা শেখা এবং লেখা তথা সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখার প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টিতে উৎসাহী করে তুলতে সাহায্য করবে। এই প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা স্থানীয় কাউন্সিল লাইব্রেরীতে প্রতিষ্ঠিত “একুশে কর্নার” এ সকল ভাষার বর্ণমালা সংরক্ষণ একটি স্থায়ী চলমান প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া হিসেবে সকল ভাষাভাষীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। ঊল্লেখ্য মাননীয় প্রিমিয়ারের প্রতিনিধি হিসেবে মার্ক টেইলর এমপি তাঁর বক্তৃতায় এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগকে নিম্নোক্ত বাক্যে উপস্থাপন করেছেন, “What I’ve learned only in 5(five) minutes from Alphabet Exhibition at the Foyer, more valuable than what I could have learnt in three hours formal discussion”.
বর্ণমালা লেখা প্রতিযোগিতাঃ বর্ণমালা লেখা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের নিজ নিজ মাতৃভাষা শেখা এবং সঠিক ও সুন্দরভাবে লিখতে পারার পরিবেশ সৃষ্টি করবে। প্রতিযোগিতার প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থান অধিকারীদের ট্রফি, এবং চতুর্থ থেকে দশম স্থান অধিকারকারীদের মেডেল এবং অংশগ্রহণকারী সকলকে সার্টিফিকেট দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মানিত করা, সংশ্লিষ্ট সকল শিশুকিশোরকে মাতৃভাষা চর্চায় অনুপ্রাণিত করবে এবং বর্ণমালা প্রদর্শনী বোর্ড শিশুকিশোরদের হস্তাক্ষরে লিখিত প্রদর্শনে উৎসাহিত করবে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনকে বার্ষিক অনুষ্ঠান হিসেবে বিবেচনায় এই প্রক্রিয়া সারা বছর ধরে মাতৃভাষা শেখা এবং চর্চায় বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
সকলের মাঝে নিজ মাতৃভাষাকে উপস্থাপনাঃ নিজ নিজ মাতৃভাষাকে অন্যান্য ভাষাভাষীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরার মাধ্যমে একটি ভাষাকে অন্যান্য সকল ভাষার সমমর্যাদায় উপস্থাপন করে নিজের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতিতে গর্বিত মানসিকতা সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। এই উপস্থাপনার যেকোন ভাষা থেকে ভাষাভিত্তিক একটি মাত্র উপস্থাপনার সুযোগ উৎসাহী শিশুকিশোরদের মাতৃভাষা শিক্ষা এবং সংস্কৃতির ঐতিহাসিক তথ্যাদি জানায় আগ্রহী করে তুলবে।
মাতৃভাষা ভিত্তিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানঃ শিক্ষা এবং চর্চার পাশাপাশি আনুষ্ঠানিকতা এবং মনোরঞ্জন বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ভাষা এবং সংস্কৃতির নিরবিচ্ছন্নতা এবং নিবিড় যোগসূত্রতা রক্ষায় প্রতিটি ভাষা ভিত্তিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভাষার প্রাকৃতিক এবং মৌলিকতাকে অন্যান্য ভাষাভাষীর কাছে তুলে ধরা এই দর্শনের সর্বশেষ ধাপ হিসেবে চিত্রিত। মাতৃভাষা ভিত্তিক সাংস্কৃতিক এই আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে বহুজাতিক এই সমাজ ব্যাবস্থাকে আরও অলংকৃত করার প্রয়াসে সকল ভাষা ভিত্তিক বৃহত্তর কমিউনিটিকে সকলের মাঝে উপস্থাপন করার সুযোগ পক্ষান্তরে সকল ভাষা সংরক্ষণে সহায়ক হবে বলে বিবেচিত।
এমএলসি মুভমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল প্রণীত “মাল্টিলিঙ্গুয়াল ফেস্টিভাল” এর দার্শনিক বিষয়াদি “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” উদযাপনে মডেল হিসেবে বিবেচিত হলে বিশ্বব্যাপী ভয়াবহভাবে ঝুঁকিপূর্ণ মাতৃভাষা সমূহ সকলের সার্বিক সহায়তায় ঝুঁকিমুক্ত করে সংরক্ষিত করা সম্ভব।