ফজলুল বারী:আমি আমার বন্ধুদের মজা করে একটা কথা প্রায় বলি। তাহলো, বাংলাদেশ চালানো অনেক কঠিন। অথবা অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনকে যদি বাংলাদেশেরও প্রধানমন্ত্রী করে দেয়া হয়, দেখবেন এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি পালিয়ে চলে যাবেন। অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশের মূল ফারাক অবশ্য সম্পদ-জনসংখ্যা আর আর্থিক সঙ্গতির। অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যা আড়াই কোটি, এর অর্ধেকের বেশি মানুষ নিজেরা উদ্যোগী হয়ে আয়কর দেন বা দিতে হয়। বাংলাদেশের করদাতার সংখ্যাটি নাজুক সংখ্যার। করোনা ভাইরাস মোকাবেলার চলতি বিশ্বজনীন নানা সমস্যা মোকাবেলা করতে গিয়ে বাংলাদেশ আরও নাজুক অবস্থায় পড়তে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো একজন আন্তরিক সর্বক্ষনিক সরকার প্রধান থাকা স্বত্ত্বেও সরকার সারাক্ষন নানামুখী আক্রমনের শিকার। বলা হচ্ছে কিছুই পারেনা সরকার! সবদোষ সরকারের!
করোনা ভাইরাস সংক্রমন বাংলাদেশে প্রথম হয় ইতালি প্রবাসী দলটির কোয়ারিন্টান সময় না মেনে বেরিয়ে যাবার পর থেকে। এই দলটি যখন একাধিক এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওয়ানা হয় তখনও বাংলাদেশ তাদের আগমন সংবাদ জানতোনা। তাদের আগমন সংবাদ পাবার পর তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে কোয়ারিন্টানের উদ্দেশে তাদের অপ্রস্তুত হজক্যাম্পে নেয়া হয়। দীর্ঘ ভ্রমন ক্লান্তি, অপ্রস্তুত হজক্যাম্পের নানা অব্যবস্থাপনা সহ নানাকিছুতে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। দেশের রেমিটেন্স যোদ্ধারা মিডিয়ার সামনে দেশকে তারা নানান গালগাল দিচ্ছিলেন।
তাদের সামাল দিতে তখন সেনা মোতায়েনের কথাও ভাবা হয়। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক সরকার সব সময় একটি সামরিক সরকারের মতো আচরন করতে পারেনা। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর গোষ্ঠী তুলে ট্রলও করা হয়। আবার প্রবাসী ওই দলটিকে যখন হোম কোয়ারিন্টানে পাঠানো হলো, তাদের মাধ্যমে প্রথম সংক্রমনের ঘটনা ঘটলো তখন সমস্বরে বলা শুরু হলো এটা সরকারের দোষ! পরে জানা গেলো যাদের মাধ্যমে প্রথম সংক্রমন ঘটে তারা বিমান থেকে নামার আগে জ্বর লুকোতে বেশি করে প্যারাসিটামল খেয়ে নিয়ে ছিলেন।
এমন যারা সত্য গোপন করেন দেশের সঙ্গে, পরিজনের সঙ্গে, এটি একটা দেশের সরকার কী করে সামাল দিতে পারে? করোনা আতঙ্ক শুরুর পর অস্ট্রেলিয়া প্রথম বিদেশ ফেরত প্রথম দলকে কোয়ারিন্টান করিয়েছে দেশটির মূলভূমি বিচ্ছিন্ন ক্রিসমাস আইল্যান্ডের পরিত্যাক্ত জেলখানায়। পরের দলটিকে বন্ধ মাইনিং কোম্পানির পরিত্যক্ত গেষ্ট হাউসে নেয়া হয় কোয়ারিন্টানে। এখন যারা আসছেন তাদেরকে নিজ খরচে দু’সপ্তাহ থাকতে হচ্ছে হোটেলে। বিমান বন্দর থেকে পুলিশ তাদের নির্দিষ্ট হোটেলে নিয়ে যায়। সেখানে ১৪ দিন থাকার পরীক্ষায় পাশ করলেই তারা বাড়ি যেতে পারেন।
অস্ট্রেলিয়ায় সামাজিক দূরত্ব না মানলে হাজার ডলারের বেশি জরিমানা করা হয়। আর বাংলাদেশে ডাব খেতে পিজা খেতে মন চায়, বাড়িতে থাকতে ভালো লাগেনা বলে সবাই আড্ডায় বসেন। এখানে লম্বা ছুটি পেয়ে লোকজন ঈদ যাত্রার মতো ভিড় করে বাড়ি গেছেন। বেতন আর চাকরি হারানোর শংকায় এরচেয়েও ঝুঁকিপূর্ন পন্থায় ঢাকা ফিরে এসেছেন গার্মেন্টস কর্মীরা! গ্রামের হাটের ভিড়-আড্ডা এখনও আগের মতোই আছে। সৌদি আরবও মসজিদ বন্ধ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ মসজিদ বন্ধ এ কথাটিও উচ্চারন করতে ভয় পায়! মসজিদে যেতে নিষেধ করার পর বাড়ির ছাদে জমায়েত করে নামাজ পড়ছেন পাড়ার মুসল্লিরা। মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধুর খুনি আব্দুল মাজেদকে কারাগারে পাঠিয়ে টেলিভিশনে মুখ দেখাতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা যেভাবে গাদাগাদি দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলেন যা দেখে যে কারও ভয় করবে। বাংলাদেশ চালানো আসলেই কঠিন।
করোনা ভাইরাস চীনের বাইরে যে দেশগুলোতে বেশি দ্রুত ছড়িয়েছে সেগুলোর একটি বহুজাতিক সমাজ আছে। তাদের বড়সড় বয়স্ক জনগোষ্ঠী, বৃদ্ধনিবাস, নানান দেশের পর্যটক, ক্রুজসহ নানান সূত্র তাদের ভাইরাস সংক্রমনের। বাংলাদেশের শুরুতে প্রবাসী জনগোষ্ঠী ছাড়া দ্বিতীয় উৎস ছিলোনা। অনেক দেশের মতো করোনা পরীক্ষার মতো পর্যাপ্ত কিটসও ছিলোনা বাংলাদেশের। তখন সরকারের দোষ হলো বেশি রোগী পাওয়া যাচ্ছেনা কেনো। সরকার অনেক মৃত্যু, লাশ লুকোচ্ছে এমন অভিযোগও তখন বলা হয়। একজন বলেন তার ধারনা বাংলাদেশে কমসে কম পয়ত্রিশ হাজার করোনা রোগী আছে!
কিন্তু পর্যাপ্ত রোগী তথা পয়ত্রিশ হাজার রোগী পাবার মতো বহুমুখী সোর্স যে বাংলাদেশের নেই, তা লোকজনকে বোঝানো গেলোনা। কোথাও কেউ একজন মারা গেলে তার আত্মীয় পরিজন থাকেন। আজকের যুগে কোথাও কোন কিছু চেপে চাওয়া কঠিন। কিন্তু সরকার পরিস্থিতি সামাল কি দেবে। জবাব দিতে দিতে অস্থির। বেশি রোগী-লাশ দিতে না পারায় আইইডিসিআর এর মুখপাত্র ভদ্রমহিলার শাড়ির সংখ্যায় নিয়ে ট্রল করে শান্তির সন্ধান করে করোনায় মানসিক আক্রান্তরা!
বাংলাদেশের চিকিৎসা সামর্থ্য নিয়ে আমার অনেক আস্থা। বাংলাদেশের কেউ যখন চিকিৎসায় সহায়তা চান তিনি চিকিৎসা বাংলাদেশে করাতে রাজি হলেই আমি এগিয়ে আসি। দেশে থাকতে অনেক চমৎকার চিকিৎসকের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল। আর অস্ট্রেলিয়া আসার পর রোগী হিসাবে নিজের অধিকার যা জানি দেশে থাকতে সেভাবে জানতামনা বা এসব বাংলাদেশের মানুষ খুব কম জানে। এখানে একজন চিকিৎসক রোগীকে যেভাবে সময় দেন, রোগ আর চিকিৎসা নিয়ে যেভাবে গল্প করেন রোগ তাতেই যেন অর্ধেক কমে যায়। করোনা পরিস্থিতির কারনে লোকজন এখন ঘর থেকে কম বেরুতে চাইছে বলে অনেক রোগী এখন চিকিৎসকের সঙ্গে ফোনে, ভিডিও কল, ফেসটাইমেও পরামর্শ নিচ্ছে।
কিন্তু বাংলাদেশে এই পরিস্থিতিতে রোগীদের মূল অভিযোগ হলো তারা কোথাও চিকিৎসা পাচ্ছেনা। জ্বর-সর্দি শুনলেই তাদের ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। ঋতু পরিবর্তনজনিত এই সময়ে এজমা-হাঁপানির ক্রনিক সমস্যাওয়ালাদের ডাক্তার দেখানো জরুরি। অনেকের এখন আবার জ্বর-সর্দি-গলা ব্যথা করলেই করোনা বলে সন্দেহ হয়। বনের বাঘে খাবার আগেই তাদের মনের বাঘে খায়। শুরুতে বলা হলো ডাক্তার স্বাস্থ্যকর্মীদের পর্যাপ্ত পিপিই বাংলাদেশে নেই। এই করোনায় পিপিই সহ নানাকিছু বেশিরভাগ দেশের ছিলোনা। এখনও নেই। কিন্তু কোথাও চিকিৎসা থেমে নেই। কারন দিন শেষে চিকিৎসাতো চিকিৎসকরাই দেন। তাদেরকেই দিতে হয়। অন্য কেউ নয়। কলকাতায় এখনও পিপিইর অভাবে রেইনকোট-হেলমেট পরে চিকিৎসা দিচ্ছেন। মালয়েশিয়া সহ নানাদেশের এমন চিকিৎসা গল্প উঠে আসছে বিশ্ব মিডিয়ায়। করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে দেশে দেশে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের আত্মাহুতির গল্পগুলোও বিশ্ব মিডিয়ার বীরের গল্প।
মূলত চীন পরিস্থিতি সামাল দেবার পর নানাকিছুর যোগান দিতে শুরু করেছে। আর বাংলাদেশ পিপিই-মাস্ক সহ নানাকিছুর যোগান পেয়েছে নিজস্ব গার্মেন্টস শিল্প থেকে। কিন্তু এমন মড়ার দেশে কোন রোগীর স্বজন যদি অভিযোগ করেন রোগী নিয়ে তারা কোন চিকিৎসা কেন্দ্রেই ঢুকতেই পারেননি, কয়েক জায়গা ঘুরে চিকিৎসা ছাড়াই তাদের রোগীর মৃত্যু হয়েছে, একটি দুটি নয়, এমন এন্তার অভিযোগ শুনে শুনে নিশ্চয় চিকিৎসকদের মনও বেদনার্ত হয়। কারন চিকিৎসাইতো তাদের ব্রত। রোগীর কাছে তারাইতো দেবতা। কিন্তু এই মৃত্যুগুলো নিয়ে কেউ কোন ব্যাখ্যা দেবারও প্রয়োজন মনে করলেননা!
মঙ্গলবার জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা বীর চিকিৎসক-চিকিৎসাকর্মীদের বীমা সহ নানান মূল্যায়নের কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে এই রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে যেসব সরকারি চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী যারা এই চিকিৎসা সেবা দিতে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছেন তাদের তিনি পুরস্কৃত করবেন। তাদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। এ পর্যায়ে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরনকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের কথা বলতে গিয়ে বিস্ফোরিত হন মা প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে সে চিকিৎসা পায়নি। এটি খুবই কষ্টকর। দুঃখজনক। কোথায় কোথায় গিয়ে ওই ছাত্র চিকিৎসা পায়নি, সেখানে কোন চিকিৎসক দায়িত্ব পালন করেননি সেটা জানতে চান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন এই সময়ে যারা মানবিকতা হারায় তাদের এই পেশায় থাকার কোন প্রয়োজন নেই। ভবিষ্যতে তারা ডাক্তারি করতে পারবেন কিনা সেটাও দেখা হবে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীরা সাধারনত কোন পেশার লোকজন নিয়ে এভাবে কথা বলার ঝুঁকি নেননা। কোন পেশার কিছু লোকের দায় সেই পেশার সবার নয়। বাংলাদেশের চিকিৎসকরা সাধারনত এ ধরনের বক্তব্যের জবাব কর্মবিরতির মাধ্যমে দেন। দেশে এখন সে পরিস্থিতি নেই। শেখ হাসিনাও সে পরোয়া করেননা। তবে তাঁর জেলায় তাঁর দাদির নামে প্রতিষ্ঠিত মেডিক্যাল কলেজের শেষ বর্ষের একছাত্রী কানিজ ফারজানা নামের এক ছাত্রী ‘বাইচা থাকলে এই দেশে সরকারি ডাক্তার হমুনা, জীবন বর্গা দিয়া দ্যাশের ‘স্যাবা’ করার মতো এততো মহান হই নাই’ বলে প্রতিক্রিয়া দেখান! এমন দেশ চালানো আসলেই অনেক কঠিন। এমন দেশে করোনার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ জয়েও মানবিক ডাক্তারদের সার্ভিসই লাগবে সবার আগে।