মানুষকে ঘরে ঢোকাতে পারলে বাংলাদেশ নিরাপদ হবে

মানুষকে ঘরে ঢোকাতে পারলে বাংলাদেশ নিরাপদ হবে

ফজলুল বারী:এক যুদ্ধ এখন সারা দুনিয়া জুড়ে। করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এক মহামারী থেকে বাঁচার যুদ্ধ। এমনিতে নানা রোগে দূর্ঘটনায় প্রতিদিন পৃথিবীর বিস্তর মানুষ মারা যায়। কিন্তু করোনা জীবানু ভীতি এখন সর্বব্যাপী। সর্বগ্রাসী। আমেরিকা বা চীন এখানে কোন বিশ্বশক্তি নয়। সবাই এখন আক্রান্ত। সবাই এই রোগের বিরুদ্ধে ভীতসন্ত্রস্ত, থরথরে কাঁপছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও এখন করোনা রোগী হিসাবে হাসপাতালে। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ-বিএনপির সব প্রবীন নেতা ভীতসন্ত্রস্ত হিসাবে ঘরে ঢুকে গেছেন। কিন্তু দেশের খামখেয়ালিপনার মানুষজনকে ঘরে ঢোকানো যাচ্ছেনা। নানান অজুহাতে মানুষ ঘরের বাইরে আসছে। বিপদজ্জনকভাবে ১০ টাকা কেজির চাল বিক্রি-ত্রান বিলি করা হচ্ছে। মক্কা-মদিনার সব মসজিদ এখন বন্ধ। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার দেশের মসজিদ বন্ধ করতে পারছেনা! এই শুক্রবারেও জুম্মার নামাজে মসজিদে মসজিদে মানুষ ঢুকে গিয়েছিলেন! এটা এই পরিস্থিতিতে আত্মঘাতী। বিপদজ্জনক।

কিন্তু এই রোগ প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী সব দেশে সব জায়গায় এখন একটাই অস্ত্র, এক আওয়াজ স্টে হোম, ঘরে থাকুন। কবগুরুর ভাষায়, ‘ওরে আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে’। কারন এই রোগের এখনও প্রত্যক্ষ চিকিৎসা নেই। রোগ যাতে না হয় সেটিই প্রতিরোধ মাধ্যম। এ ব্যাপারে বিশ্বজুড়ে সতর্কতার কারন হচ্ছে একজন লোক যদি ঘরের মধ্যে থাকে  তাহলে সে রোগাক্রান্ত কারও সংস্পর্শে আসবেনা। জীবানু জড়ানো স্পর্শ করবেনা কিছু। এরজন্যে বলা হচ্ছে জরুরি প্রয়োজনে যদি বাইরে যেতেই হয়, মুখে মাস্ক ব্যবহার করুন। আরেকজনের সঙ্গে দূরত্ব রাখুন কমপক্ষে দেড় মিটার। ঘনঘন সাবানে হাত ধোয়া অথবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে দু’হাত জীবানু মুক্ত রাখুন। বাড়িতে ফিরে আবার সাবানে ধুয়ে নিন দুই হাত। নিজেকে ধুয়ে সাফসুতরো করে নিন। এক কথায় ঘরে থাকার পর শক্তিশালী নিরাপদ অস্ত্র আর বিশ্বব্যাপী কিছু নেই।

এই শুক্রবার সারা দুনিয়া জুড়ে শুরু হয়েছে ইস্টারের ছুটি। অস্ট্রেলিয়ায় এই ইস্টারের ছুটি চলবে সোমবার পর্যন্ত। লং উইকঅ্যান্ড। সাধারনত এমন লংউইকঅ্যান্ড পেলে অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর লোকজন ছেলেমেয়েকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যায়। কিন্তু এবার এ নিয়ে পুলিশ পাহারা বাড়ানো হয়েছে কোথাও যাতে কেউ বেড়াতে না যায়! মানুষের ছুটি কাটানোর সব হলিডে সেন্টার সমূহও বন্ধ করে দেয়া দেয়া হয়েছে। রেষ্টুরেন্ট বন্ধ। সমুদ্র সৈকত বন্ধ। আপনি যাবেন কোথায়। এখন অস্ট্রেলিয়ায় দু’জনের বেশি মানুষের সমাবেশও নিষিদ্ধ। এই দু’জনকেও সামাজিক দূরত্ব মেনে দাঁড়াতে হয়। নতুবা স্পট ফাইন ১০০০ ডলার। আইন না মানায় অস্ট্রেলিয়ার নিউসাউথ ওয়েলস রাজ্যে একজন মন্ত্রীকেও জরিমানা করা হয়েছে। এরপর পদত্যাগ করেছেন ওই মন্ত্রী।

অস্ট্রেলিয়ার পাব্লিক হেলথ এক্ট ২০১০ অনুসারে এই আইনভঙ্গের জন্যে ১১ হাজার ডলার পর্যন্ত জরিমানা বা ৬ মাসের জেল বা উভয় দন্ডই দেয়া যায়। এক হাজার ডলার মানে বাংলাদেশের ৬০ হাজার টাকা। সিডনির বাংলাদেশি এলাকা লাকেম্বার লাগোয়া ব্যাংকসটাউন এলাকায় গত কয়েকদিনে যত পুলিশ ফাইন হয়েছে এর সবক’টি ১৬ শ’ ডলারের বেশি জরিমানা করা হয়েছে। লেবানিজ আরব বংশোদ্ভূত এলাকা ব্যাংকসটাউন। এরা সাধারনত আইন মানতে চায় না এমন বদনাম আছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে  সব এখন সোজা। কারন জরিমানা।

বাংলাদেশের জরিমানার হার কম বলে কেউ তা পরোয়া করেনা বা ভয় পায় না। মানুষ যেহেতু মারনব্যাধির বিরুদ্ধে সতর্কতাকে আমলে নিচ্ছেনা সেখানে জরিমানার পরিমান বাড়াতে হবে। কারন দুনিয়ার যে সব দেশে মানুষ জরিমানা ভয় পায় সে দেশের আইনানুগ পরিবেশও বিরাজ করে। এসব জরিমানা নিয়ে কোন অজুহাত চলেনা। আইন ভাঙ্গলে জরিমানার টাকা দিতেই হবে।  আমরা জরিমানা ভয় পাই কারন আমরা জানি এক হাজার ডলার কামাই করা কত কষ্টের। এক জরিমানায় যে কারও সাপ্তাহিক-মাসিক বাজেট গড়বড় হয়ে যায়। আর আমরা রোগকেও ভয় পাই। এসব মহামারীতে মরার জন্য দেশ ছেড়ে আমরা এই দূরের দেশে আসিনি।

এন্থনী আলবানি অস্ট্রেলিয়ার বিরোধী লেবার পার্টির নেতা। ইস্টার উপলক্ষে শুক্রবার জনগনকে দেয়া এক বানীতে তিনি আবেদন জানিয়ে বলেছেন স্টে হোম। বাড়িতে থাকুন। আলবানী বলেন এর আগে অস্ট্রেলিয়ার সবাই ইস্টারে গির্জার প্রার্থনায় যাবার, ছুটি কাটাতে বাইরে যাবার অপেক্ষা করতেন।

এখন বাড়িতে থাকাই সবার জন্যে মঙ্গল। কারন এখন কভিট নাইন্টিনের সংক্রমন থেকে আমাদের নিজেদের ও পরিবার-সমাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আলবানি বলেন এই পরিস্থিতিতেও আমাদের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ ও সুপার মার্কেটের কর্মীরা ঝুঁকি নিয়ে জনগনের জন্যে কাজ করে যাচ্ছেন। তারা আমাদের হিরো। উল্লেখ্য করোনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরুর পর অস্ট্রেলিয়ার মসজিদ-গির্জা সহ সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও বন্ধ আছে। সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরন সহ নানা কড়াকড়ির কারনে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে বেরুচ্ছেননা। আড়াই কোটি মানুষের দেশ অস্ট্রেলিয়ায় জানুয়ারির ২৫ তারিখে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এখন পর্যন্ত এদেশে ৬২০৪ জন রোগী পাওয়া গেছে। মারা গেছেন ৫৪ জন। সামাজিক দূরত্বের কড়াকড়ির কারনে এদেশে করোনা সংক্রমন কমছে।

বাংলাদেশের একটা সত্য আমি বারবার লিখছি। তাহলো মানুষকে সতর্ক করে ঘরের ভিতরে রাখা গেলে বাংলাদেশে এই রোগ মহামারী হবার সুযোগ কম। কারন যত দেশে এটি মহামারী হয়েছে তাদের দেশে আছে নানান দেশের মানুষজনকে নিয়ে বহুজাতিক সমাজ। এসব দেশের পর্যটক-ক্রুজ-বৃদ্ধনিবাস করোনা ভাইরাস সংক্রমনের বড় কয়েকটি সোর্স। বাংলাদেশের এগুলো নেই। কোন মেগা প্রকল্পের চীনা নাগরিকরা এটি বাংলাদেশে নিয়ে যায়নি। প্রবাসী বাংলাদেশি, উমরাহ হজের পূন্যার্থী, তবলিগ জামাতের মুসল্লি এদের মাধ্যমেই এই রোগ বাংলাদেশে গেছে। তারা রোগটি ছড়িয়ে দিয়েছে তাদের পরিবার ও সমাজে।

টোলার বাগ মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েও না জেনে সংক্রামিত হয়ে মারা গেছেন নিরীহ মুসল্লি। তাঁর সন্তানদের টাকার অভাব ছিলোনা। চিকিৎসা পাননি তিনি। মারা গেছেন। বাংলাদেশে আক্রান্ত এলাকাগুলোর লকডাউন কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করুন। শুধু সরকার দিয়ে এই লকডাউন সফল হবেনা। বাঁচতে চাইলে সবাই যার যার পরিবারের সদস্যদের বাধ্যতামূলক ঘরে রাখুন। বাংলাদেশের চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি পুলিশ-সেনাবাহিনী সহ আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা, মিডিয়াকর্মী, স্বেচ্ছাসেবকেরা মানুষকে নিরাপদ রাখতে বিরতিহীন কাজ করে যাচ্ছেন। মানুষের এই ঐক্যের সঙ্গে হাত মেলান। আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশ বেঁচে যাবে। এখন চালাকির মাধ্যমে অহেতুক ঘরে বাইরে যাওয়া আত্মহত্যার সামিল। প্লিজ, ঘরে থাকুন। প্লিজ।

ফজলুল বারী
fazlulbari2014@gmail.com