ভারতীয় পাসপোর্ট ছিল বঙ্গবন্ধুর খুনি মাজেদের

ভারতীয় পাসপোর্ট ছিল বঙ্গবন্ধুর খুনি মাজেদের

ফজলুল বারী:জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর খুনি মাজেদ ভারতীয় পাসপোর্ট পেয়েছিল। বাংলাদেশে তার নাম ছিল আব্দুল মাজেদ। আর ভারতীয় পাসপোর্টে নাম ছিল আহমদ আলী। ২০১৭ সালে সে এই পাসপোর্ট পায়। পাসপোর্ট নাম্বার R-0465602। ২০২৭ সাল পর্যন্ত তার এই পাসপোর্টের মেয়াদ ছিল। এতে ভোলার বোরহানউদ্দিনের মাজেদের জন্ম উল্লেখ করা হয়েছে কলকাতার হাওড়ায়। জন্ম তারিখ উল্লেখ করা হয় ০৪-০১-১৯৪৭। মানে পাকিস্তানের জন্মসালেই তার জন্ম।

কলকাতার পার্ক স্ট্রিট থানায় যথারীতি পুলিশ ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে তাকে পাসপোর্ট দেয়া হয়। শুধু পাসপোর্ট নয়, ভারতীয় আধার কার্ড, রেশন কার্ড এসবও তার ছিল। তার আধার কার্ডের নাম্বার ৭৯৪১৯৫৯১২৮৬৪। ২০১২ সালে মাজেদ ভারতের ভোটার আইডি কার্ডও বানায়! এসব প্রমান করে বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবস্থার মতো ভারতীয় এসব ব্যবস্থাপনাও দুর্নীতিগ্রস্ত। নিকট প্রতিবেশি দেশ। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গ বাঙালি রাজ্য। হাওয়াবাতাসতো লাগতেই পারে।

কিন্তু মাজেদ যেভাবে ফাঁসিতে মৃত্যুবরনের উদ্দেশে কেরানিগঞ্জ কারাগারের ফাঁসির মঞ্চের কাছে আমদানিকৃত, বাংলাদেশে ফিরতে তার পাসপোর্ট লাগেনি। কী সৌভাগ্য তার! কেরানীগঞ্জ কারাগারের ইতিহাস লিখতে গেলে সেখানে ফাঁসিতে মৃত্যুবরনকারী প্রথম ব্যক্তি হিসাবে তার নামটিও সেখানে উঠে গিয়েছে! গত ফেব্রুয়ারিতে সে নিখোঁজ হয়ে গেলে তার স্ত্রী কলকাতার পার্কস্ট্রিট থানায় একটি জিডি করেন। ওই জিডির তদন্তে নেমেই মাজেদের ঘর থেকে একটি হাত ব্যাগে ওই পাসপোর্ট-আধার কার্ড-রেশন কার্ড সহ নানাকিছুর সন্ধান পায় পুলিশ।

ওই ব্যাগে এক নারী ও তিনটি শিশুর ছবিও পাওয়া যায়। পুলিশের ধারনা ওই নারীই সম্ভবত মাজেদের বাংলাদেশের স্ত্রী ডাঃ সালেহা বেগম। তিন শিশু সম্ভবত বাংলাদেশে তার তিন সন্তানের ছবি। যেই তিন শিশু এতোদিনে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেছে। উল্লেখ্য বাংলাদেশে মাজেদের তিন মেয়ে এক ছেলে আছে।

ফাঁসির আসামি বাবাকে দেখতে গেলে লোক সমাজে প্রকাশিত হয়ে যাবার ভয়ে তারা তাদের বাবাকে শেষ দেখা দেখতেও যায়নি। ২০১১ সালে মাজেদ তার চেয়ে ৩২ বছরের ছোট সেলিনা বেগম নামের উলুবাড়িয়ার নামের একজনকে বিয়ে করে কলকাতায়।

বাংলাদেশে সালেহা, কলকাতায় সেলিনা বেগম! দুই দেশে দুই স্ত্রী! কেউ নিশ্চয় ওপর প্রান্তের ওপরজনের নাম-পরিচয় জানতোনা! কলকাতার সংসারে তাদের ছয় বছরের একটি মেয়েও রয়েছে। মাজেদের পরিচয় প্রকাশ হয়ে যাবার পর শিশু মেয়েকে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে চলে গেছেন হতভম্ভ কলকাতার স্ত্রী! কার এমন একটি ফাঁসির আসামীর স্ত্রীর পরিচয় নিয়ে সমাজে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে! আর বাংলাদেশে মাজেদের খুন-ফাঁসি এসবের কোন দায়তো কলকাতার সেলিনা অথবা তার শিশুকন্যার নেই।

মাজেদের কলকাতার স্ত্রী পুলিশকে বলেছে সেই হাতব্যাগটি মাজেদ কাউকে ধরতেও দিতোনা। দেখাতো দূরে থাক। বাড়িতে ঢুকে সে ভিতর থেকে গেটে তালা লাগিয়ে দিতো। খাবার দিতে কখনো দেরি হয়ে হলে অগ্নিশর্মা হয়ে যেতো রেগেমেগে! কলকাতার পার্কস্ট্রিট এলাকায় তার নাম ছিল আলী আহমদ। ইংরেজির মাষ্টার হিসাবে পরিচয় ছিল মাজেদের। এলাকার লোকজন জানতো কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে সে পাশ করেছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিউশনি করে পড়াতো সে। এর বাইরে টাকা ধার দিয়ে সুদের ব্যবসাও তার ছিল।

কলকাতার পার্কস্ট্রিটে ভাড়া বাড়িতে থাকলেও সেখানকার তালতলায় একটি ফ্লাট কেনার জন্যে সে পঁচিশ লাখ টাকায় বায়না করেছিল। এরজন্যে সে দেশের পুলিশের সন্দেহ বাংলাদেশ থেকে তার টাকা যেত। তার ফোনের কল লিস্টে পাওয়া গেছে বাংলাদেশের ০১৫৫২৩৮৭৯১৩, ০১৭১১১৮৬২৩৯ এই দুটি নাম্বারে প্রায় ফোন করতো সে। কলকাতার দুটি ফোনের সিমও সে তার স্ত্রীর নামে নিয়েছিল। কলকাতার সূত্রগুলোর ধারনা এই ফোনালাপকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের গোয়েন্দারা কলকাতায় মাজেদের অবস্থান শনাক্ত করতে পারে।

কলকাতার পার্কস্ট্রিটের বেডফোর্ড রোডের বাড়ি থেকে শেষবার ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে সকাল ১০ টার পর হাসপাতালের উদ্দেশে বেরোয় মাজেদ। প্রথমে যায় স্থানীয় একটি ফার্মেসিতে। এরপর রিপন স্ট্রিটের দিকে মুখ করে হাঁটতে থাকে। তখন থেকেই

তাকে অনুসরন করতে থাকে দুই ব্যক্তি। কলকাতার পিজি হাসপাতালে কিছু টেস্টের রেজাল্ট আনার কথা বলে সে বেরিয়েছিল।

ওই এলাকার একটি সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেছে বাড়ির বাইরে দু’জন তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল। তারা সেখান থেকে মাজেদকে অনুসরন করতে থাকে। কিছুক্ষন পর তাদের সঙ্গে আরও দু’জন যুক্ত হন।

আলিমুদ্দিন স্ট্রিট ধরে রাস্তা পেরিয়ে এজেসি বোস রোডে আসে মাজেদ। ওই সময় অনুসরনকারী ওই চারজনকে প্রথম মাজেদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। মৌলালির দিক থেকে আসা সল্টলেক-সাঁতরাগাছি রুটের একটি বাসে চড়ে বসে মাজেদ। অনুসরনকারী ওই চারজনও বাসটায় ওঠে। এরপর আর কোন ফুটেজ নেই। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের বাস স্টপেজ কলকাতার পিজি হাসপাতাল পর্যন্ত কোথাও তাকে নামতে দেখা যায়নি। মাজেদের মোবাইল ফোনের সর্বশেষ টাওয়ার লোকেশন ছিল মালদহ। এরজন্যে কলকাতার লোকজনের ধারনা তাকে অনেক ঘুরিয়ে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছে ওই চারজন! অতএব ২২ ফেব্রুয়ারি ভারতে পলাতক জীবনের সর্বশেষ দিন ছিল মাজেদের।

এপ্রিলের ৭ তারিখে মাজেদ ধরার খবর দেয় বাংলাদেশ। গাবতলী গল্পে বলা হয় ভোরে সে রিকশা দিয়ে যাচ্ছিলো। পুলিশ জিজ্ঞেস করলে বলে সে বঙ্গবন্ধু হত্যামামলার ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত পলাতক খুনি। এতোদিন কলকাতায় পালিয়েছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন মনে হয় করোনার ভয়ে পালিয়ে চলে এসেছে। ভারতীয়রাও বাংলাদেশের গল্প বিশ্বাস করেনি। কারন ভারতে প্রথম করোনা রোগী পাওয়া যায় জানুয়ারির ৩০ তারিখে। তাও কলকাতা থেকে বহুদূর কেরালা রাজ্যে। কলকাতায় মার্চের ১৮ তারিখে প্রথম করোনা রোগী পাওয়া যায়। সে কারনে তারা প্রশ্ন রেখে বলে ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে সে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে যাবে কেনো।

কলকাতার সাংবাদিক সুজিত ভৌমিক মাজেদ কাহিনী নিয়ে রিপোর্ট করেছেন। মঙ্গলবার তার অফিসে ফোন করলে বলা হয় লকডাউনের কারনে তিনিতো বাড়ি থেকে অফিস করেন। তার ফোন নাম্বার চাইলে বলা হয় যার কাছে তার নাম্বার আছে তিনি আধা ঘন্টা পর অফিসে আসবেন। আধাঘন্টা পর ফোন করলে পরিচয় দিলে একজন তার ফোন নাম্বার দেন। কিন্তু ফোন করলে রিং বাজতেই থাকে। কেউ

রিসিভ করেননা। এক পর্যায়ে ফোন রিসিভ করেন সুজিত। কিন্তু বলেন তিনি এখন রিপোর্ট লেখা নিয়ে ব্যস্ত। আমি যাতে ভারতীয় সময় সন্ধ্যা ৭ টার পর ফোন করি। মানে সিডনির রাত সাড়ে ১১ টার পর।

আবার সময় মেনে ফোন করলে বেশ আগ্রহ নিয়ে কথা বলা শুরু করেন সুজিত। কারন তার অফিস থেকে আমার কথা বলা হয়েছে। বললাম, বাংলাদেশের লোকজন বর্তমান পত্রিকার সঙ্গে সেভাবে পরিচিত নয়। কলকাতার পত্রিকা মানেই বাংলাদেশের মানুষের কাছে আনন্দবাজার পত্রিকা, আজকাল, সংবাদ প্রতিদিন বা গণশক্তি। সুজিতই দৈনিক বর্তমান পত্রিকাটি সম্পর্কে বাংলাদেশের অনেক মানুষকে আগ্রহী করেছেন।

সুজিতের পূর্ব পুরুষ বাংলাদেশের পাবনার। কিন্তু তার জন্ম ভারতে। সুজিত বলেন পূর্ব পুরুষের দেশ বাংলাদেশ। তাই এই রিপোর্টটি তিনি আগ্রহ নিয়ে করেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিকে কোনভাবেই গ্লোরিফাই করার ইচ্ছা বা চেষ্টা তার ছিলোনা। সুজিত বললেন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে সম্পর্ক, তাতে ভারত এই খুনিকে বাংলাদেশের হাতে অফিসিয়েলি তুলে দিতে পারতো। কিন্তু দু’দেশের মধ্যে বন্দী বিনিময় চুক্তি না থাকায় হয়তো এটি করা যায়নি। মাজেদের স্ত্রী সেলিনার একটি ইন্টারভ্যু করার ইচ্ছা সুজিতের। তার মুখেই এই খুনির নানা খুঁটিনাটি জানা যেতো। কিন্তু পলাতক খুনি স্বামীর পরিচয় জানাজানি হয়ে যাবার পর অজ্ঞাতবাসে চলে যাওয়ায় সেটি আর সম্ভব হয়নি। কিন্তু সেলিনার ইন্টারভ্যুর আশা ছাড়েননি সুজিত। চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছেন।

ফজলুল বারী
fazlulbari2014@gmail.com