ফজলুল বারী: আমাদের বাংলাদেশটার তখনও নাম পূর্ব পাকিস্তান। ঢাকার ও দেশের এ অঞ্চলের সিনেমা হলগুলোতে ভারতীয় বাংলা, হিন্দি এবং পশ্চিম পাকিস্তান এবং হলিউডের সিনেমা দেখানো হতো।
বলা হতো পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের স্যাতস্যাতে আবহাওয়া সিনেমা বানানোর উপযুক্ত নয়! এ নিয়ে একটি ইতিহাস আছে। ১৯৫৩ সালের মার্চে ঢাকায় ছবি বানানোর সম্ভাব্যতা নিয়ে একটি আলোচনা সভা ডাকা হয়েছিল।
গুলিস্তান সিনেমা হলের অবাঙালি মালিক খান বাহাদুর ফজল আহমদ সেখানে বলেন পূর্ব পাকিস্তানের আদ্র আবহাওয়ায় ছবি বানানো সম্ভব নয়! সেখানেই এ কথার প্রতিবাদ করেন একজন আব্দুল জব্বার খান।
তিনি বলেন এখানেতো ভারতীয় ছবির শুটিং হয়েছে। গুলিস্তান সিনেমা হলে দেখানোও হয়েছে সে ছবি। ভারতীয়রা এখানে সিনেমা বানাতে পারলে আমরা পারবোনা কেনো? আমি চ্যালেঞ্জ নিয়ে বললাম আমি এখানে সিনেমা বানিয়ে দেখাবো।
সেই শুরু। ছবি বানানোর দূঃসাহসী উদ্যোগ। ছবির নাম ‘ডাকাত’। ফরিদপুর এলাকার একটি ডাকাতির ঘটনা অবলম্বনে লেখা “ডাকাত’ নাটকের কাহিনী অবলম্বনের বানানো শুরু হয় ছবি।
শিল্পী ফজল শাহাবুদ্দিনের পরামর্শে পরে নাম পাল্টে এর নতুন নামকরন করা হয় ‘মুখ ও মুখোশ’। কিন্তু তখনও সিনেমার ‘স’ও জানতেননা আব্দুল জব্বাব খান। মুন্সিগঞ্জে তাঁর বাড়ি।
আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল থেকে ১৯৪১ সালে ডিপ্লোমা পাশ করে তিনি একটা চাকরি করতেন। আর সখে নাটক করতেন মঞ্চে।
তাঁর একটি নাটকের সংগঠনও ছিল। ঈশা খাঁ, টিপু সুলতান এসব নাটক করতো তাঁর সংগঠন। কিন্তু জেদতো জেদ। ছবি বানানো সেই জেদ তাকে নিয়ে গেলো ইতিহাসের চরিত্রে।
ইকবাল ফিল্মস নামের একটি প্রতিষ্ঠান ছবিটি নির্মানে আর্থিক সহায়তা করে। ছবিটি নির্মানে ৬৪ হাজার টাকা খরচ হয়। এটিই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশে নির্মিত প্রথম পূর্নদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।
ছবিটি বানাতে তাঁর দুই বছর সময় লেগেছিল। ১৯৫৪ সালের ৬ আগষ্ট ঢাকার হোটেল শাহবাগে ছবিটির মহরত হয়। মহরত উদ্বোধন করেন পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর ইস্কান্দার মির্জা।
১৯৫৩ সালে বুড়িগঙ্গার ওপারের গ্রাম কালীগঞ্জে ছবিটির শুটিং শুরু হয়। সিদ্ধেশ্বরী, তেজগাঁও, রাজারবাগ, কমলাপুর, লালমাটিয়া, জিঞ্জিরা, টঙ্গির বিভিন্ন এলাকায় ছবিটির শুটিং চলে। একটি আইমো ক্যামেরা দিয়ে শুরু হয় শুটিং।
পাঁচ হাজার টাকায় পুরনো ওই ক্যামেরা কলকাতা থেকে আনা হয়। সঙ্গে একটি সাধারন ফিলিপস টেপ রেকর্ডার। একটি জেনারেটর ও প্রয়োজনীয় টুকিটাকি যন্ত্রপাতি নিয়ে শুটিং হয় ঢাকায় বানানো প্রথম ছবির।
ঢাকার তৎকালীন অভিনেতা অভিনেত্রীরা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই বিনা পারিশ্রমিকে ছবিটায় অভিনয় করেন। নিজেদের দেশের একটি ছবি হবে এ নিয়েই সবার একটি আলাদা আগ্রহ-উত্তেজনা কাজ করেছে।
১৯৫৫ সালের ৩০ অক্টোবর শেষ হয় ছবির শুটিং। ঢাকায় তখন কোন প্রডাকশন স্টুডিও না থাকায় ছবির নেগেটিভ ডেভলপের জন্যে পাঠানো লাহোরে। সেখানকার শাহনুর স্টুডিওতে হয় মুখ ও মুখোশের পরিস্ফূটনের কাজ।
সেখানে ১৯৫৬ সালে ছবিটির কাজ শেষ হয়। কিন্তু পরিচালক ছবিটি নিয়ে ঢাকায় ফেরার অনুমতি পাচ্ছিলেননা! অনুমতি জোগাড়ের পর মুখ ও মুখোশের প্রথম প্রদর্শনী হয় লাহোরে।
কিন্তু ঢাকা আসার পর পরিচালক ছবিটি মুক্তি দেবার পর এখানকার কোন সিনেমা হল পাচ্ছিলেননা! তবে এ অবস্থা কাটাতে সময় বেশি লাগেনি। ছবিটির নির্মান থেকে নানাকিছুর নেপথ্যে ছিলেন বিশেষ একজন অনুপ্রেরনাদাতা।
তাঁর নাম সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ। এস এম পারভেজ নামে তিনি ঢাকার সংস্কৃতির জগতের মানুষের কাছে ছিলেন প্রিয় একজন। ঢাকায় সিনেমা বানানোর আগেই অবজারভার গ্রূপ থেকে তিনি সিনেমা পত্রিকা চিত্রালী বের করেন।
ঢাকায় একটি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি হবে এটি ছিল তাঁর স্বপ্নের অংশ। কাজেই এখানে বানানো প্রথম চলচ্চিত্র দেশের সিনেমা হল মালিকদের আগ্রহী করতে বিশেষ অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেন এস এম পারভেজ।
রূপমহল প্রেক্ষাগৃহে ছবির প্রিমিয়ার শো হয়। প্রিমিয়ার শো’তে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। এরপর ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, চট্টগ্রাম এবং খুলনার উল্লাসিনী সিনেমাহলে দেখানো হয় ছবিটি। সৃষ্টি হয় নতুন এক ইতিহাস।
ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৫৬ সালের ৩ আগষ্ট। ঢাকার মুকুল প্রেক্ষাগৃহ (পরে যেটির নাম হয় আজাদ সিনেমা হল), রূপমহল, চট্টগ্রামের নিরালা, নারায়নগঞ্জের ডায়মন্ড, খুলনার উল্লাসিনী সিনেমাহলে ছবিটি একযোগে মুক্তি পায়।
প্রথম সিনেমা হিসাবে দর্শকদের মধ্যে বিপুল আগ্রহের সৃষ্টি করে মুখ ও মুখোশ। প্রথম দফায় ছবিটি ৪৮ হাজার রুপি আয় করেছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের এ অংশেও তখনও টাকার নাম ছিল রূপি।
কিন্তু ছবির নারী চরিত্রের জন্যে তখন শিল্পী পাওয়া যাচ্ছিলোনা। আগ্রহী শিল্পী চেয়ে তখন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। দুই বান্ধবী পিয়ারী বেগম, জহরত আরা ওই বিজ্ঞাপন দেখে পরিচালকের সঙ্গে দেখা করতে যান।
পরিচালক দু’জনকেই দুই চরিত্রের জন্যে চূড়ান্ত করেন। জহরত আরা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, পিয়ারী বেগম ইডেনের ছাত্রী ছিলেন। পিয়ারীর স্বামী আমিনুল হকও ছবিতে অভিনয় করেন।
নায়িকা পূর্নিমা সেনগুপ্তাকে কলকাতা থেকে আনা হয়। তাঁর অবশ্য জন্ম চট্টগ্রামে। ছবিটির মূখ্য পুরুষ চরিত্র তথা সেই ডাকাতের চরিত্রে অভিনয় করেন অট্টহাসির জন্যে স্বনামখ্যাত ইনাম আহমেদ।
পরিচালক আব্দুল জব্বার খান দ্বিতীয় প্রধান পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করেন। আব্দুল জব্বার খানই ছিলেন ছবির নায়ক আফজাল। অন্য চরিত্রগুলোয় অভিনয় করেন রহিমা খাতুন, বিলকিস বারী এবং কাজী সিকান্দার(দারোগার চরিত্র)।
পিয়ারী বেগম নাজমা নাম নিয়ে ছবিতে নায়ক আফজালের বোন রাশিদার চরিত্রে অভিনয় করেন। এর আগে তিনি মঞ্চে অভিনয় করতেন। রেডিওতে গান গাইতেন। তাঁর স্বামী আমিনুল হক ছবিতে পিয়ারীর নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
কলকাতার বিপ্রদাশ ঠাকুরকে দিয়ে ছবিটির চিত্রনাট্য লেখানো হয়। মুরারী মোহনের মাধ্যমে ছবির চিত্রগ্রহন শুরু হলেও শেষটা হয় চিত্রগ্রাহক জামানের হাতে। শমসের আলী শ্যাম বাবু ছদ্মনামে কাজ করেন ছবিটার অঙ্গসজ্জার।
ছবির গানে কন্ঠ দেন আব্দুল আলীম এবং মাহবুবা হাসনাত। সমর দাশ সঙ্গীত পরিচালনা করেন। সহকারী সঙ্গীত পরিচালক ছিলে ধীর আলী। মইনুল ইসলাম শব্দ গ্রহনের কাজ করেন। সম্পাদনা করেন পশ্চিম পাকিস্তানের আব্দুল লতিফ।
১৯৯৩ সালে ২৮ ডিসেম্বর না ফেরার দেশে চলে যান ঢাকায় প্রথম চলচ্চিত্রের স্রষ্টা আব্দুল জব্বার খান।