ফজলুল বারী: তাহের পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার পর জেনারেল ওসমানী তাঁকে একটি দায়িত্ব দেন। তাহলো মুক্তিযুদ্ধের সব সেক্টর ঘুরে ঘুরে কোথায় কোন সমস্যা-দূর্বলতা তা খুঁজে বের করে চিহ্নিত করে প্রতিকারের সুপারিশ দিতে হবে।
সব সেক্টর ঘুরে তাহের দেখলেন ১১ নম্বর সেক্টরটিই কৌশলগত দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন এবং ঝুঁকিপূর্ন। ওপাশে শক্তিশালী শত্রু ঘাঁটি। এখানকার কামালপুর দখল করতে পারলেই জামালপর-টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকা দখলের একটি পথ তৈরি হয়ে যাবে।
তাহের তখন জেনারেল ওসমানীর কাছ থেকে যেচে এই ১১ নাম্বার সেক্টরের দায়িত্ব চেয়ে নেন। ঝুঁকিপূর্ন সেক্টর জেনেও সেটি তাহের নিতে চাইছেন দেখে মুক্তিবাহিনী প্রধান খুশি হন। তিনি অবশ্য কথা বলতেন কম। আচরনে বোঝাতেন।
তাহেরের এই দৃঢ়তার গল্প তিনি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন সহ অন্যদের সঙ্গেও শেয়ার করেন। তুরার যেখানে লুৎফা তাহের থাকেন সেখান থেকে যুদ্ধক্ষেত্র প্রায় ২৫ কিঃমিঃ দূরে। আর তাহেরের ক্যাম্প ছিল মহেন্দ্রগঞ্জে।
হিমাচল প্রদেশের এই জনপদটি একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা কেন্দ্র। ২০১৬ সালে ভারতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে গিয়ে আমি মহেন্দ্রগঞ্জে গিয়েছিলাম। কারন পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমনের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে আমি তুরা, মহেন্দ্রগঞ্জ এসবের অনেক নাম শুনেছি।
দালাই লামার মন্দিরে যেতেও মহেন্দ্রগঞ্জ যেতে হয়। হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায় খেলা ছিল বাংলাদেশের।হিমাচল প্রদেশের শীতকালীন রাজধানী ধর্মশালা। গ্রীষ্মকালীন রাজধানী সিমলাও বাংলাদেশের জন্যে বিশেষ পরিচিত আরেকটি নাম।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর সিমলায় মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির নাম হয় সিমলা চুক্তি। তুরাতে যেদিন মিটিং থাকতো সেদিনই মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সেখানে আসতেন মেজর তাহের। মিটিং শেষে লুৎফাদের দেখে আবার চলে যেতেন।
তাহেরের ইচ্ছা ছিল কামালপুর দখল করে তাঁর ক্যাম্পটি সেখানে স্থানান্তর করবেন। তাঁর ক্যাম্প থাকবে বাংলাদেশের ভিতরে এটা ছিল তার বড় একটি স্বপ্ন। এরজন্যে লুৎফা তুরা আসার পর থেকে সবার মুখে শুধু কামালপুর কামালপুর শুনছিলেন।
একদিন কমরেড মনি সিং, মতিয়া চৌধুরী ও আওয়ামী লীগের কয়েক নেতা তুরায় আসেন। কর্নেল তাহেরের পরিবার দেশ থেকে এসেছেন শুনে তারা তাদেরকে দেখতে আসেন। ছোট বাচ্চা জয়া তাহেরকে আদর করেন।
তাহেরের ভাই আবু ইউসুফ চাকরি করতেন সৌদি বিমান বাহিনীতে। ছুটি না পেয়ে তিনিও পালিয়ে এসে যুদ্ধে যোগ দেন। তাহেরের ভাবনায় ছিল দ্রুত কামালপুর মুক্ত করা। কামালপুর দখলে নেয়া গেলে জামালপুর হয়ে ঢাকা দখল সহজ হয়ে যাবে।
পাকিস্তানিদের শক্তিশালী অবস্থান ছিল কামালপুরে। কারন এটিই সামরিক কৌশলগত ঢাকার প্রবেশদ্বার। একদিন কয়েক মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে তাহের লুৎফাদের দেখতে এসে বলেন ১৪ নভেম্বরের মধ্যে আমরা দেশের মধ্যে চলে যাব।
১৪ নভে্ম্বর তাহেরের জন্মদিন। সেনাবাহিনীতে তিনি কমিশনড লাভ করেন ১৪ নভেম্বর। কামালপুরের যুদ্ধেও আহত হন ১৪ নভেম্বর। মুক্তিযোদ্ধারাও কামালপুর মুক্ত করে তাহেরকে জন্মদিনের উপহার দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
লুৎফা তাহেরও সুযোগ পেলেই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে উপহার সামগ্রী কিনে জমাচ্ছিলেন। তাঁর টার্গেট কামালপুর মুক্ত হবার পর উপহারগুলো বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের দেবেন। কামালপুর যুদ্ধের সারাদিন উৎকন্ঠায় লুৎফা তাহের।
তাহের পরিকল্পনায় ১৩ নভেম্বর শেষ রাতের দিকে কামালপুরের ওপর একযোগে আক্রমণ শুরু করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবিবও অংশ নেন সেই যুদ্ধে। লে. মান্নানের নেতৃত্বে তাঁদের দলটির অবস্থান কামালপুরের পশ্চিম পাশে খাসিরহাট গ্রামে।
ঐতিহাসিক এ যুদ্ধে যার যার বাহিনী নিয়ে চারদিক থেকে কামালপুর আক্রমণ পরিচালনা করলেন লে. মান্নান, বীরবিক্রম, লে. মিজান, বীরপ্রতীক, জয়নাল আবেদীন, বীরপ্রতীক, সদরুজ্জামান হেলাল, বীরপ্রতীক, হেলালুজ্জামান পান্না, বীরপ্রতীক প্রমুখ।
আরও দুটি বাহিনী ছিল আবু সাঈদ খান ও আখতার আহমেদের নেতৃত্বে। এছাড়া থাকেন তাহেরের বড় ভাই আবু ইউসুফ খান বীরবিক্রম, তাহেরের দুই ছোট ভাই বাহার ও ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, বীরপ্রতীক, এনায়েত হোসেন সুজা বীরপ্রতীক এবং দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা ইয়াকুবও সেই যুদ্ধে অংশ নেন।
রাত তখন ৩টা ৪৫ মিনিট।‘ওয়াকি-টকি’ হাতে সৈয়দ মনিরুজ্জামান ব্যস্ত ছিলেন সেক্টর হেডকোয়ার্টারে। কমান্ডার স্বয়ং পরিচালনা করছেন যুদ্ধ। ‘ওয়্যারলেসে’ তার সাংকেতিক নাম ‘কর্তা’। এ নাম ধরেই কমান্ডারের সঙ্গে সবাই যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন।
চললো বৃষ্টির মতো গোলা ও গুলিবর্ষণ। পাকিস্তানিরা পাল্টা গুলিবর্ষণ করে জীবন বাঁচাতে চেষ্টা করলো। ভয়ঙ্কর, হৃদয়বিদারক গোলাগুলির অবিশ্রান্ত কানফাটা শব্দ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের এমন সাঁড়াশি যুদ্ধের অভিজ্ঞতা সেই প্রথম।
নারকীয় সে সময়টিতে, হঠাৎ হারুন হাবীবের কাছে থাকা স্বাধীন বাংলা বেতারের ‘টেপ রেকর্ডারটি’ চালু হয়। সে রাতের ভয়ঙ্কর শব্দরাজি রেকর্ড হয়! তখন মৃত্যু গা ছুঁয়ে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। শত শত বুলেট ছুটে যাচ্ছে। একের পর এক মর্টার ফাটছে।
আর্টিলারির সেলগুলো বিকট শব্দে ফেটে মাটি, উপড়ে ফেলছে গাছপালা। গোলাগুলি বন্ধ হলো ভোরের দিকে। বোঝা গেল পরাস্ত হয়েছে পাকিস্তানিরা। কিন্তু লে. মিজানের বাহিনীর সঙ্গে অধিনায়কের যোগাযোগ বন্ধ।
সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সেক্টর কমান্ডার নিজে খোঁজ নিতে কামালপুরের মূল ক্যাম্পটার দিকে অগ্রসর হলেন। ঠিক সে মুহূর্তেই পাকিস্তানিদের একটি মর্টার সেল এসে আকস্মিক আঘাত করল তাহেরকে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
আহত অধিনায়ককে কোনোভাবে নিয়ে আসা হলো ভারতীয় এলাকায়। তখন আরেক অপেক্ষা তুরায়। যুদ্ধের কোন খবর আসছিলোনা। কোন মুক্তিযোদ্ধাকেও পাওয়া যাচ্ছিলোনা। এক সময় বিএসএফ এর এক কর্মকর্তা তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে আসেন সেখানে।
অসময়ে তাদের দেখে বিস্মিত অপ্রস্তুত হন লুৎফা। যুদ্ধের ভয়াবহতা বোঝানোর ভূমিকা বলার চেষ্টা করছিলেন রঙ্গরাজ নামের সেই কর্মকর্তা। লুৎফার চাপাচাপিতে এক পর্যায়ে বলেন আসল ঘটনা। তাও সত্য গোপন করে।
বলা হয় যুদ্ধে নেতৃ্ত্ব দেবার সময় তাহেরের পায়ে এটি গুলি লেগেছে। গুলির খবরকে অত গুরুত্ব দেননা লুৎফা। যুদ্ধে এমন হতেই পারে। আরেক মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন মান্নানের কথা তাঁর মনে পড়ে। তাঁরও পায়ে গুলি লেগেছিল।
কয়েকদিন পর সেরে ওঠে আবার যোগ দিয়েছেন যুদ্ধে। তাহেরকে দেখতে চাইলেন লুৎফা। দেখতে দেখতে বিএসএফ এর মাঠে এসে নামে একটি হেলিকপ্টার। সাদা চাদরে জড়ানো শোয়ানো তাহেরকে হেলিকপ্টার থেকে নামানো হয়।
সঙ্গে আসেন তাহেরের ভাই আবু ইউসুফ, ডাক্তার প্রেমাঙ্কুর রায় সহ আরও কয়েকজন। লুৎফা তখনও বুঝতে পারেননি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তাহেরের এক পা। সারজীবনের জন্যে পঙ্গু-প্রতিবন্ধী হয়ে গেছেন তাঁর স্বামী। তাঁর সন্তানের পিতা।
মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে বলেন জ্ঞান হারানোর আগ পর্যন্ত তাদেরকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন তাহের। তাঁর যে এতবড় আঘাত তা নিয়ে কোন বিকারই তাঁর মধ্যে ছিলোনা। গৌহাটির মিলিটারি হাসপাতালে তাহেরকে নিয়ে যাওয়া হয়।
পরের দিন লুৎফাকে নেবার ব্যবস্থা হয় সেই হাসপাতালে। মেয়ে জয়া তখন পাঁচ মাসের শিশু। তাকে তাহেরের দুই বোন ডালিয়া জুলিয়ার কাছে রেখে তিনি গৌহাটি রওয়ানা হন। তাহেরের ভাই আনোয়ার তাঁর সঙ্গে যান।
গৌহাটি পৌঁছে আসল অবস্থা জানতে বুঝতে পারেন লুৎফা। পাকিস্তানিদের মর্টার সেলের আঘাতে উরু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তাহেরের এক পা। তাহের জীবন তখনও ঝুঁকিপূর্ন। ডাক্তারদের তখন একটা চেষ্টা, তাহেরকে বাঁচাতে হবে।
নিজেকে কঠিন করে নিলেন লুৎফা। সাহস হারালে চলবেনা। সেই হাসপাতালে বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে একের পর এক আহত মুক্তিযোদ্ধাদের আনা হচ্ছিল। কারও হাত নেই। কারও পা নেই। কারও হাত-পা কিছুই নেই। শরীরটা শুধু টিকে আছে।
যন্ত্রনায় তারা চিৎকার করে কাঁদতেন। অবর্ননীয় সে পরিস্থিতি। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের কারোই স্বজন সঙ্গে নেই। লুৎফা হয়ে যান তাদের স্বজন। বোন-ভাবী। মুক্তিযোদ্ধাদের ভরসা দিতে হবে। ভরসা দিলেই তারা সুস্থ হয়ে আবার যুদ্ধে যেতে পারবে।
মুক্তিযোদ্ধাদের ভরসা দিতে তাহেরকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে নিয়ে যেতেন লুৎফা। তাঁকে সাহস দিতেন। মুখে তুলে ওষুধ-খাবার খাইয়ে দিতেন। বিয়ের দু’বছরের মাথায় লুৎফা তখন একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা স্বামীর হেড নার্স।
প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রধান তাজউদ্দিন আহমদ একদিন তাঁর খোঁজ দিতে গণপরিষদ সদস্য আব্দুস সাত্তারকে পাঠান। তাহেরের চিকিৎসার তদারকির জন্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধানও একদিন হাসপাতালে আসেন।
মেঘালয়ের গভর্নর একদিন সস্ত্রীক আসেন। ফুলের তোড়া তাহের আর লুৎফার হাতে দিয়ে বলেন তোমরা কিন্তু হারবেনা। উন্নত চিকিৎসার জন্যে গৌহাটির মিলিটারি হাসপাতাল থেকে তাহেরকে নেয়া হয় লক্ষৌ ও পুনেতে।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সেখানে তাঁকে দেখতে যান। পুনের কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন কেন্দ্রে নেয়া হয় তাহেরকে। পুনেতে শুধু নকল এটি পা নয়, ক্র্যাচও দেয়া হয় তাঁকে। সেই থেকে তিনি ক্র্যাচের কর্নেল।
এভাবেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহেরের নাম হয়ে গেলো ক্র্যাচের কর্নেল। জিয়ার সামরিক আদালতের বিচার নামের হত্যাকালীন ফাঁসির মঞ্চ পর্যন্ত সেই ক্র্যাচ তাঁর সঙ্গেই ছিল।