‘দ্য হারমোনিক মাইনর’ শিরোনামে সরোদ শিল্পী তানিম এবং নৃত্যশিল্পী অর্পিতার যুগলবন্দী

‘দ্য হারমোনিক মাইনর’ শিরোনামে সরোদ শিল্পী তানিম এবং নৃত্যশিল্পী অর্পিতার যুগলবন্দী

‘দ্য হারমোনিক মাইনর’ শিরোনাম দিয়ে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলীয় সরোদ শিল্পী তানিম হায়াত খান রাজিতের টিউনে এবং জনপ্রিয় নৃত্যশিল্পী অর্পিতা সোম চৌধুরীর কোরিওগ্রাফি নিয়ে গত কয়েকদিন আগে রিলিজ হল একটি অফিসিয়াল ভিডিও।এই মনোমুগ্ধকর ভিডিওটির প্রতিটা কাজ নিখুঁত ছিল এবং ফুটে উঠেছে সাগর পারে বসে সরোদ শিল্পী তানিমের সরোদের টিউনের তালে অর্পিতার অসাধারন নৃত্য এবং ড্রোন ব্যবহার করে ভিডিও এবং ক্যামেরার ফ্রেমওয়ার্ক তো ছিল অসাধারণ।। বাংলাদেশের কোন শিল্পীদের আউটডোরে এই প্রথম এমন যুগলবন্দী সরোদ আর নাচের ফিউশন। ।

তানিম হায়াত খান রাজিত

তানিম হায়াত খান রাজিত একজন সরোদ শিল্পী, কম্পোজার এবং গায়ক। তানিম হায়াত খান এর সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো তিনি বিশ্ব বরেণ্য সংগীত ঘরানা সেনিয়া মাইহার ঘরানার একজন সদস্য। তানিমের মা ফওজিয়া ইয়াসমিন ৬০ এর দশকের একজন জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী।তানিম তার গুরু ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খানের সাথে অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা জুড়ে ১০টি সরোদ ডুয়েট পরিবেশন করেন।

সিডনীতে তানিম একজন ব্যস্ত সরোদ শিল্পী এবং সংগীত শিল্পী। সিডনীতে বসবাসরত দুই বাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তানিমের অবাধ যাতায়াত। ২০১৮ কমনওয়েলথ গেমস’র এক্সট্যাটিক কনসার্টে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন তানিম।

সরোদ বাজানোর পাশাপাশি তানিম একজন মিউজিক কম্পোজার ও সংগীত শিল্পী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ ও UTS থেকে এমবিএ ডিগ্ৰী নিয়ে পেশাগত ভাবে তানিম একজন একাউন্টেন্ট হিসেবে কর্মরত আছেন সিডনিতে।

‘দ্য হারমোনিক মাইনর’ মিউজিক ভিডিওটি রিলিজ হওয়ায় বেশ উৎফুল্ল তানিমকে সিডনি বেঙ্গলিজ থেকে কয়েকটি প্রশ্ন করা হয়।
প্রশ্ন : ‘দ্য হারমোনিক মাইনর’ মিউজিক ভিডিওটি নিয়ে আপনার অনুভূতি কি ?

তানিম: “আউটডোরে সরোদের তালে তালে নাচের কোরিওগ্রাফি সংগীত জগতে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। সরোদের সাথে নাচের যুগলবন্দী প্রথম দেখেছিলাম ভাইয়া উস্তাদ শাহাদত হোসেন খানের একটা লাইভ স্টেজ প্রোগ্রামে, ১৯৯৮ সালে। ভাইয়ার দেখানো পথ ধরে ভাইয়ার আরেকটা অসমাপ্ত কাজ শেষ করবার গল্প,আমার সরোদ আর অর্পিতার কোরিওগ্রাফি দিয়ে ।এবার অফিশিয়াল ভিডিও, বাংলাদেশে এই প্রথম এরকম অফিশিয়াল যুগলবন্দী সরোদ আর নাচের ফিউশন।  শেষে রুবাই ভাইয়ের অসাধারণ ক্যামেরার ফ্রেমওয়ার্ক দিয়ে কাজটা সামনে এলো৷ আজ সবাইকে আমাদের এই দারুণ সৃষ্টি শুনবার ও দেখবার আমন্ত্রন রইলো”
প্রশ্ন : মিউজিক ভিডিওটিতে কাজ করতে গিয়ে কোন বিশেষ অভিজ্ঞতা ?

তানিম : “জীবনে প্রথমবারের মতো এই ফিউশন ভিডিওটি বানাতে গিয়ে আমি একটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কয়েকবার শুটিং এর সময় নির্ধারণ করেছি, প্রিয়জনদের মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছি, শুটিং বাদ দিয়েছি। তাই মনের মধ্যে একটা কুসংস্কার জন্ম নিয়েছিল, এই মিউজিক ফিউশন কি কোন রাহুর কবলে পরলো নাতো। শেষ পর্যন্ত ভিডিওটি করতে পেরেছি এবং ফিউশন ভিডিওটি রিলিজ হয়েছে, এই জন্য এইটা আমার কাছে বিশেষ মূল্যবান সৃষ্টি হিসেবে মনে হয়।”

প্রশ্ন : বাংলাদেশী মিউজিক কম্পোজার এজাজ ফারাহ আর আপনি অস্ট্রেলিয়াতে ,এই নিয়ে কি হিমশিম খেতে হয়নি ?
তানিম : একটুও না। এজাজ ফারাহ মিউজিক কম্পোজিশন ছাড়াও আর্কেস্ট্রার উপর কাজ করতে বেশ পছন্দ করেন। উনি আমার এই টিউনটায় দারুণভাবে অর্কেস্ট্রেশন করেছেন । প্রথমে উনি আমাকে একটি রিদম করে পাঠিয়ে দেন এবং সেইটার উপরে আমি স্বাধীনভাবে সরোদ বাজিয়ে কাজ করি। পরবর্তীতে সম্পূর্ণ মিউজিকটি উনি কম্পোজিশন করে দেন।

প্রশ্ন : চ্যালেঞ্জ ছিল কোন ?
তানিম : প্রায় আট মিনিটের সরোদ কি দর্শকশ্রোতাদের ধরে রাখা যাবে তাই পরিকল্পনায় নাচের পাশাপাশি প্ৰাকৃতিক পরিবেশে ভিডিওগ্রাফীর
আইডিয়াটা যুক্ত করি।

প্রশ্ন: আপনার প্রতিটি কাজের মধ্যে একটু নতুনত্ব থাকে।বিদেশের মাটিতে বসে পেশাগত চাকুরীর বাহিরে কিভাবে সম্ভব ?

তানিম : আমি সংগীতপ্রেমী মানুষ। নামকরা সব সংগীত লিজেন্ডদের খবর রাখি এবং তাদের ভিডিও দেখি। নতুন নতুন আইডিয়াগুলো দেখে ভালো লাগে। যেমন ধরেন ,ইয়ান্নি যেমন তাজমহলে মিউজিক ভিডিও করলো। গতানুগতিক ধারার বাহিরে কিছু পেলেই মাথায় আইডিয়া কাজ করে। সেখান থেকেই কাজ শুরু করি।

 

অর্পিতা সোম চৌধুরী

অর্পিতা সোম চৌধুরী একজন প্রতিষ্ঠিত নৃত্যশিল্পী। অর্পিতা ২০০৪ সালে ভারত সরকারের বৃত্তি(Indian Council for Cultural Relation) নিয়ে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতনাট্যম বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রী করে ২০০৯ সালে বাংলাদেশে ফিরেন।শিক্ষার পাশাপাশি শৈশব থেকেই  নাচেও তালিম নিয়েছিলেন। নাচের ডিগ্রী নিয়ে দেশে ২০০৯ সালে ফিরার পর শান্তা মরিয়ম বিশ্ববিদ্যালয়ে নাচের শিক্ষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগে অতিথী শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়া আসার আগে ছায়ানটের বাংলাদেশ আর্ট সেন্টারে নাচের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন এই গুণী শিল্পী। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী লুবনা মরিয়ম , লায়লা হাসান, শামীম আরা নীপা সহ অনেক নামকরা নৃত্য শিল্পীদের সাথে কাজ করে এসেছেন অস্ট্রেলিয়া আসার আগ পর্যন্ত।

প্রশ্ন :আপনি কতোটা আত্মীবিশ্বাসী ছিলেন সরোদের তালে তালে আউটডোরে নাচার ক্ষেত্রে?

অর্পিতা :নাচের ব্যাপারে আমি খুবই আত্মবিশ্বাসী বরাবরই। সিডনি তথা অস্ট্রেলিয়ার নামকরা সরোদ শিল্পী তানিম ভাই যখন সরোদ ও নাচের ফিউশন আউটডোরে করার প্রস্তাব দেয় ২০১৯ সালে আমি সাথে সাথেই রাজি হয়ে যাই।

প্রশ্ন :এই নাচের শুটিং করতে আপনাকে সকাল ৮ টায় শুটিং স্পটে সম্পূর্ণ রেডি হয়ে যেতে হয়েছিল চার দিন শুটিং করতে, কিভাবে ম্যানেজ করেছিলেন?

অর্পিতা : নাচ আমার ভালোবাসা, শৈশব থেকেই নাচের প্রতি তীব্র টান, তাই সেটা নিয়েই পড়াশোনা এবং যেখানেই মানসম্মত নাচ নিয়ে কাজ, সেখানেই আমি থাকার চেষ্টা করি। কারণ নৃত্য শিল্প নিয়ে কাজ করতে আমি সবচেয়ে বেশী আনন্দ পাই। তাই এই শুটিং এ যাবার আগের রাতেই পারিবারিক সব কাজ কর্ম সেরে রাখতাম এবং ভোর ৪ টায় উঠতে হতো নাচের ম্যাকআপ এবং ড্রেস পরে বের হওয়ার জন্য, কেননা আউটডোরে ড্রেস পরার কোন ব্যবস্থাই ছিল না। ঠিক সময়েই আমরা পৌঁছে যেতাম স্পটে…

প্রশ্ন : ২০১৯ সালে করা ভিডিও এতদিন পরে রিলিজ হওয়ায় কি আপনি আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন?

অর্পিতা : তানিম ভাই ও রুবাই ভাই দুই জনের পরিবারে পরপর প্রিয় মানুষদের হারিয়েছেন শুটিং চলাকালীন সময়ে, এছাড়াও কোভিড ১৯ তো শুরু হলো ২০১৯ সাল থেকেই। সব কাজই স্থবির হয়ে ছিল। আমার বাবা বলতেন একটা কথা, ভালো কাজ করতে একটু সময় এবং ধর্য্য ধরতে হয়। আমাদের কাজটা ভালো হয়েছে বলে ভিডিও রিলিজ হওয়ার পর পর অনেক মেসেজ, ফোন কল পাই। সুতরাং, এই রিলিজ হওয়া নিয়ে আমি মোটেও চিন্তিত ছিলাম না।

প্রশ্ন :এই কাজ করতে গিয়ে ভিন্ন কোন অভিজ্ঞতা হয়েছে কি?

অর্পিতা : দুইটা ঘটনা আমার মনে পড়ছে ।

প্রথমত : শুটিং স্পট সিডনীর ‘লা পেরুজে’ পাথরের পথ বেয়ে সবাই নেমে গিয়েছে, যখন আমি নীচে নামছিলাম, তখন আমার বর ‘শুভ’ আমাকে সাবধানে নামতে বললো কারণ পায়ে হিল জুতা ছিল এবং নাচের ড্রেসের কারণে। বলার সাথে সাথে ধুম করে গড়িয়ে নীচে পরে গেলাম। সবাই ভয় পেয়েছিল, নিতান্তই  ভাগ্য ভালো বলে আমি আহত হয়নি এবং কাজটি করতে পেরেছিলাম। আমার বর এখনো বলে, আমরা এতোজন নেমে গেলাম, কেউ পরলো না, শুধু তুমি পরলে!!

দ্বিতীয়ত: অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সাগরের পাশে বালিতে বসে শুটিং এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, হঠাৎ একটা বিশাল ঢেউ পিছন দিয়ে আসছিলো, সবাই  হঠাৎ সতর্ক করাতে আমি কোন রকমে  উঠে দৌড় দিয়েছিলাম  যদিও অনেকটাই ভিজে গিয়েছিলাম।

রবিউল হুদা রুবাই  যদিও সোশ্যাল সায়েন্স এ পড়াশোনা করেছেন, কিন্তু নিজের ভালোবাসা এবং শখ ছিল মিডিয়া নিয়েই কাজ করবেন। নিজেই পড়াশুনা করেছেন মিডিয়া লাইনে এবং ফটোগ্রাফি ও ভিডিও, এডিটিং এইগুলো নিয়েই প্রচুর সময় দিতে দিতে এই পেশা নিয়েই বর্তমানে  ডিপার্টমেন্ট অফ কমিউনিটি জাস্টিস এর মিডিয়া প্রোডাকশন সেকশনেই কাজ করছেন। এই ফিউশন ভিডিওটা তার ১১ তম কাজ। ভিডিও ধারণ, এডিটিং, লোকেশন সিলেকশন এবং ডাইরেকশন এই কাজগুলো রুবাই করেছেন।

প্রশ্ন :এতো দেরী হলো কেনো এই ভিডিও শুটিং, এডিটিং করতে?
রুবাই : ভিডিওটি ধারণ করার কিছুদিন পরে আমার মা মারা যান, আমি একেবারেই মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরেছিলাম, তারপর ২০২০ সালে তানিম ভাই হারালেন উনার বাবাকে, এবং কিছুদিন পরে হারালেন উনার শ্যালককে। সবমিলে আমরা একটু পিছিয়ে পরেছিলাম মানসিকভাবে। এই বছর, তাই কাজটি নিয়ে আবার বসি এবং শেষ করে ফেলি।

প্রশ্ন :আপনার ধারণ করা ভিডিওতে ড্রোন ব্যবহার করেছেন?
রুবাই : জী আমি প্রফেশনাল ভিডিও ক্যামেরা, মোবাইল ফোন এবং ড্রোন তিন ধরণের ভিডিওগ্রাফিই ব্যবহার করেছি এই কাজটায়। ড্রোন উড়ানোর লাইসেন্স রয়েছে, তাই সম্পূর্ণ নিয়ম মেনেই ড্রোন ব্যবহার করেছিলাম।

প্রশ্ন :কোন ধরণের ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়েছে কি এই কাজ করতে গিয়ে?
রুবাই : সকাল সকাল গিয়েছিলাম সাগর পারে ভিডিও করতে যেনো মানুষ কম থাকে এবং বাতাস কম থাকে। মানুষ কিছুটা কম থাকলেও ভিডিওতে মানুষ চলে এসেছিলো যেটা পরে এডিটিং করে ম্যাসকিং করতে পেরেছি কিন্তু সমস্যা হয়েছিল ড্রোন চালানোর সময়। যখনই ড্রোন উড়াই, তখনই বাতাস আসা শুরু করতো, তাই বসে থাকতাম বাতাস কমার জন্য, যেই বাতাস কমতো, ড্রোন উড়ানো শুরু করলেই আবার বাতাস শুরু। সেই কি এক যন্ত্রনা দিচ্ছিলো বাতাস। বলতে গেলে প্রতিদিনই।

সরোদ – টিউনঃ তানিম হায়াত খান রাজিত
ড্যান্স – কোরিওগ্রাফিঃ অর্পিতা সোম চৌধুরী
ভিডিওগ্রাফিঃ  রবিউল হুদা রুবাই , আইক্লিক স্টুডিও প্রোডাকশন
লেবেলঃ জি সিরিজ

‘The Harmonic Minor’