ফজলুল বারী :স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে হেঁটে বেড়িয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোটবোন শেখ রেহানা। বছরের শেষ দিনে আমি এই খবরটা অনুসরন করেছিলাম। তখনও এর কোন ছবি আসেনি। বাংলাদেশের জন্যে এটি মানুষের চাঁদে হেঁটে বেড়াবার মতো একটি ঘটনা।
কারন পদ্মা সেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশের সাহসের আরেক নাম! ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগেও প্রতিবার বাজেটের আগে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান ব্রিফকেস হাতে দাতা-সংস্থাগুলোর প্যারিস কনসোর্টিয়ামের বৈঠকে গিয়ে হাজির হতেন।
সেখানে ‘টেকাটুকা দিলাউক্কা, অতা অতা খরমুনে’ বলে সিলেটি একসেন্টে বাংলা ও ইংরেজি বলা বিএনপির অর্থমন্ত্রী নানান পরিকল্পনা তুলে ধরতেন। সেই বৈঠকে দাতা দেশ-সংস্থাগুলোর প্রতিশ্রুতির উপর নির্ভর করতো বাংলাদেশের বাজেট প্রণয়নের কী হাল দাঁড়াবে! এই বাংলাদেশ এখন নিজের টাকায় বাজেট করে।
টাকা এমন একটি কঠিন সত্য যে, আপনি যার কাছ থেকে টাকা নেবেন তার কথা শুনতেই হবে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এরাও নানান কঠিন শর্তে টাকা দিতো-দেয় বাংলাদেশের মতো দেশকে। সাইফুর রহমানের মতো অর্থমন্ত্রীরও এ নিয়ে বার্গেন করার সুযোগ থাকতোনা।
অনুগত মানুষ-অর্থমন্ত্রী হিসাবে দাতা দেশ-সংস্থাগুলোর সঙ্গে বার্গেন অথবা বেয়াদবি করতে চাইতেনওনা সাইফুর রহমান। বিদেশি টাকা-সহায়তা পাবার লোভে বিএনপি তথা সাইফুর রহমান যুগে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতেও চাইতোনা বা ফসল ভালো হলে তা গোপন করে রাখতো!
অথচ আমাদের সোনা ফলানো কৃষকরাতো কখনও ফসল কম ফলানোর নিয়তে চাষবাস করেননা। দিনে দিনে বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নের যতোটা তেজস্বী ভাবের সৃষ্টি হয়েছে এর বড় কৃতিত্ব বাংলাদেশের পরিশ্রমী ও উদ্বাবনী শক্তি সম্পন্ন কৃষকদের।
যত কষ্ট হোক টাকা দেশে পাঠানোতো বন্ধ করেননা আমাদের সোনার মানুষ প্রবাসী বাংলাদেশিরা। তৈরি পোশাক খাত-মৎস উৎপাদন সহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বিস্ময়। চুরি-চামারি-পাচার সহ নানান সমস্যা স্বত্ত্বেও বাংলাদেশের ইমার্জিং চেহারাটার জন্যে সবাইকে বাংলাদেশকে হিসাবে রেখে কথা বলতে হয়।
অথচ বিশ্বব্যাংক তখন হঠাৎ পদ্মা সেতু নিয়ে কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগে এর অর্থায়ন থেকে রহস্যজনক সরে গেলো! তখন তাদের মুখে কষে একটা চড় মারার মতো ভূমিকা নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চড়টা তখন ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস সহ তাদের গালেও গিয়ে পড়ে যারা এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে কাজ করছিলেন।
শেখ হাসিনা তখন ঘোষনা দিয়ে বলনে পদ্মা সেতু হবে এবং তা হবে আমাদের টাকায়! বাংলাদেশের নিজের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মানে শেখ হাসিনার ঘোষনা দেশে বিদেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। অনেকে উৎকন্ঠা জানিয়ে বলেন বাংলাদেশ এখন হয়তো অন্য কারও থেকে বিশ্বব্যাংকের চাইতে চড়া সুদ ও শর্তে ঋণ নেবে! বিশ্বব্যাংক এখন বাংলাদেশের চলমান অন্যসব প্রকল্প থেকে হাত গুটিয়ে চলে যেতে পারে!
এই বিশাল মেগা প্রকল্পের অর্থায়ন করতে গিয়ে চলমান নানান উন্নয়ন প্রকল্প কাটছাট করতে হতে পারে বলে, পরিচিত পন্ডিতরা এমন বয়ানও দেন। কিন্তু কার্যত এসবের কিছুই ঘটলোনা। পদ্মা সেতু নিয়ে দেশজ পন্ডিত অথবা পন্ডিতনমন্যদের সবার সব আশংকা-বয়ান অসত্য প্রমানিত হয়েছে।
প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী সহ অন্যদের মেধা-শ্রমে-ঘামে পদ্মা সেতু এখন একটি সত্য বাস্তব। বাংলাদেশের সাহসের এই ঘটনায় তাজ্জব বনে যায় বিশ্বব্যাংক সহ অন্য দাতা সংস্থা ও দেশও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রমান করেছেন সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
এবং এমন সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার মতো সাহস থাকতে হয়। যা শেখ হাসিনার আছে। সৎ মানুষদেরই এমন সাহস থাকে। এই সেতুকে জোড়াতালির পদ্মা সেতু বলে ব্যাঙ্গ বিদ্রূপ করেছিলেন বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। বলেছিলেন, কেউ জোড়াতালির পদ্মা সেতুতে উঠবেননা। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে একটা নয় দুটি পদ্মা সেতু বানাবে।
অনেকে তখন হায় হায় করে বলেছিলেন পদ্মা সেতু হয়ে গেলে খালেদা জিয়া কী এর নীচ দিয়ে যাবেন! ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বিএনপি যেভাবে বলছে তাতে খালেদা জিয়াকে আর পদ্মা সেতুর উপর-নীচ কোন দিক দিয়েই আর যাওয়া লাগবেনা। বিএনপি বলছে তাদের নেত্রী এখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে!
আর শেখ হাসিনা হেঁটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে। পত্রিকায় যখন দুইবোন শেখ হাসিনা-শেখ রেহানার পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার পথ হেঁটে বেড়ানোর খবর পড়ি তখন আমার অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের সিএমএইচে চিকিৎসার সময়কালীন ঘটনার কথা মনে পড়ছিল।
মৌলবাদীদের ছুরির আঘাতে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত হুমায়ুন আজাদকে চিকিৎসার জন্যে সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে দেখতে সিএমএইচে রওয়ানা হন। কিন্তু সেনানিবাসের গেটে তাকে আটকে দেয়া হয়! কী আর্মি যে তখন ছিলো!
অথবা আর্মিও ক্ষমতা দেখে! তখন গাড়ি থেকে নেমে শেখ হাসিনা হেঁটে রওয়ানা হন। এভাবে কত পথ হেঁটে অতঃপর রিকশায় তিনি সিএমএইচে পৌঁছেন। সেই ঘটনার পর সম্ভবত শেখ হাসিনা অনেক দিন পর পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে এভাবে অনেক পথ হাঁটলেন শেখ হাসিনা।
নিরাপত্তা শংকার কারনে তাঁর এখন স্বাধীন হাঁটা-চলার সুযোগও এখন সীমিত। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বন্দুকের নল এখন এই দুইবোনকে সর্বত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে। সে জন্যে সহজাত পাখির চোখ দিয়ে দুই বোন প্রানের দেশের কতকিছুই আর দেখতে পারেননা! এখনতো আবার নতুন এক যুগ শুরু হয়েছে ভার্চুয়াল!
কিন্তু শেখ হাসিনা তাঁর এই পদ্মা সেতু পরিভ্রমনের ঘটনাকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে রাখতে চেয়েছিলেন। এরজন্যে তাঁর নিজস্ব ফটোগ্রাফাররা এই ঘটনার অনেক ছবি তুলতে পারেননি। নতুবা দুইবোনের পদ্মা সেতুতে হাঁটা চলার কত চমৎকার সব ছবি-ভিডিও হতে পারতো।
শেষ মূহুর্তে এসএসএফ এর দুই কর্মকর্তা শেখ হাসিনা-শেখ রেহানার মোবাইল ফোনে যে ছবিগুলো তুলেছেন, এর স্থান নির্বাচনও সঠিক হয়নি। দেখে মনে হবে যে কোন ভবনের ওপরে দাঁড়িয়ে তোলা ছবি! যেমন সিডনিতে তারা অপেরা হাউসকে পিছনে রেখে ছবি তুলেছিলেন হোটেল কক্ষের ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে।
এরপরও আনাড়ি এসএসএফ হাতে মোবাইল ফোনে ছবি তুললেও বিষয়বস্তুর গুণে বৈশিষ্ট্যে ছবিটি প্রকাশের পরপর তা দেশেবিদেশে দারুন চাঞ্চল্য-ব্যঞ্জন সৃষ্টি করেছে! এটাই স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ওপর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যাদ্বয়, দুইবোনের প্রথম ঐতিহাসিক ফটোগ্রাফ!
যার ক্যাপশন করা যায় আমাদের জাতির পিতার কথায় ‘দাবায়ে রাখতে পারবানা’! অথবা ‘দাবায়া রাখতে পারলানা’! শেখ হাসিনা এই ছবি তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে দেন। আমেরিকায় থাকা জয় ছবিটি তাঁর ফেসবুক পেইজে পোষ্ট করে সবাইকে ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানান।
জয় ছবিটি পোষ্ট করতেই মুহুর্তে হাজার হাজার আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ছবিটি যার যার ফেসবুক পাতায় পোষ্ট করেন! জয় ছবিটা না তুললেও বিভিন্ন মিডিয়ার অনলাইন সংস্করনে জয়কে ক্রেডিট দিয়েই ছবিটি প্রকাশ করা হয়।
আওয়ামী লীগের ফেসবুক পাতাতেও পোষ্ট করা হয় ছবিটি। এ যে বছর শেষের প্রশান্তির এক ছবি! আগুনে প্রজ্জ্বলিত লঞ্চ সহ বিদায়ী বছরের নানান ছবি দেখে দেখে দেশের মানুষ যেন মানসিক ট্রমায় পড়ে গিয়েছিল! সেখান থেকে স্বস্তির এক ছবি পদ্মা সেতুতে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি তাঁর জীবিত দুই কন্যার ছবি।
এ ছবি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্র নায়কোচিত সাহসের প্রতিচ্ছবি। এই সাহসের আরেক নাম এখনকার বাংলাদেশ। ছবিটা যেন বিশ্বব্যাংকের সেই কর্মকর্তাদের দুই গালে সজোরে দেয়া দুই চড়! ডক্টর মুহম্মদ ইউনুস সহ যারা নেপথ্যে কাজ করেছিলেন চড় গিয়ে পড়েছে তাদের গালেও। ডিজিটাল চড়!
ছবিটা দেখে চুপ মেরে যাওয়া বিএনপি নেতা ফখরুল-রিজভিসহ মান্না-নূরাগংকে কি কাঁদতে দেখেছেন? হায় পদ্মা সেতু হায় সেতু পদ্মা, ‘ঠেকাইতে পারিলামনা’! হায় হাসিনা-হায় রেহানা-হায়, কি দেখাইলেন! মরি হায়রে হায়, দূঃখে পরান যায়! কিভাবে কাঁদতে দেখবেন! তারা কেঁদেছেতো লুকিয়ে-দুই গালি ফুলিয়ে!
ঢাকায় যখন মেট্রোরেল চালু হবে, কর্নফুলি নীচ দিয়ে গড়া সুড়ঙ্গপথ তথা টানেল চালু হবে, সেই টানেলের ভিতর দিয়ে তারা যখন গাড়িতে করে যাবে, তখন গাল আরও বেশি ফুলবে। কারন এসব গড়তেতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো সৎ সাহসী স্বপ্ন-প্রত্যয় থাকতে হয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর খুনি এক সামরিক জেনারেল জিয়ার কাছে রাজনীতি শিখে, তার স্ত্রীকে ম্যাডাম ডেকে, অতঃপর ব্রিটিশ হোম অফিসের কাছে বাংলাদেশের পাসপোর্ট সমর্পন করা ‘বিশেষ যোগ্যতা সম্পন্ন ছেলে’কে স্যার’ ডেকেতো সেই দোকানের কর্মচারী হওয়া যায়। বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সাহসী রাজনীতি করা যায়না।
ক্ষমতার দিল্লীতো বহুদূর।