ফজলুল বারী: আমার আম্মার মৃত্যু সংবাদ পেয়েই আমি আমাদের কাজী বাহারকে ফোন করি। অমর্ত্য ফাউন্ডেশনের অনিবার্য এক চরিত্র আমাদের এই বাহার। যাকে আমরা সবার আগে সবকিছুতে নির্ভর করি। আমাদের নতুন একটি নলকূপের কাজে তিনি লক্ষীপুরে ছিলেন। খবরটি শুনেই শোকার্ত হন কাজী বাহার।
এরপর তিনি এ নিয়ে তাঁর মতো করে একটি পোষ্ট দেন ফেসবুকে। বাহারের পোষ্ট ধরে খবরটি ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। শুরু হয় শোক-দোয়া আর ভালোবাসার ঝড়! অমর্ত্যর হঠাৎ মৃত্যুর পর আবার টের পেলাম কত মানুষ আমাকে ভালোবাসেন।
আম্মার মৃত্যু সংবাদটি যখন পাই তখনও কাজে ছিলাম। এদিন আমি কাজে যেতে চাইনি। বাধ্য হয়ে গিয়েছি। একজন নির্ভরযোগ্য রিপ্লেসমেন্ট খুঁজছিলাম। দুঃসংবাদটি পাবার পর রিপ্লেসমেন্টের ব্যবস্থা হয়ে গেলে আমি আমার বোনের বাসায় চলে আসি। আমার আর আমার ছোটবোনের সংসার সিডনিতে।
এখানে আসার পর ভিডিওকলে আম্মার মরা মুখ দেখি। দূঃখিনী আমার মা। সাত ভাইর এক বোন চম্পা হওয়া স্বত্ত্বেও দুই দেশ দুই সীমান্তের কারনে জীবনের বড় অংশ মা-ভাইদের সাহচর্য বিচ্ছিন্ন কাটিয়েছেন। মৃত্যুর সময়ও সন্তানদের কেউ অস্ট্রেলিয়ায়, কেউ আমেরিকায় বা বিলাতে।
দেশে আমাদের তিন ভাই থাকেন। বড়বোন থাকেন মৌলভীবাজারে। কুলাউড়া থেকে মৌলভীবাজার তেত্রিশ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু পড়ে গিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জখম পরবর্তী অস্ত্রোপচারের কারনে আমাদের আপা এখনও শয্যাশায়ী। তিনিও আম্মাকে শেষ দেখা দেখেছেন ভিডিওকলে!
অপ্রাপ্ত বয়স্কা অবস্থায় আম্মার বিয়ে হয়। তখনকার সমাজে এটি একটি স্বাভাবিক বিষয় ছিল। শিশু দুটি ছেলেমেয়েকে রেখে আব্বার প্রথম স্ত্রী মৃত্যুবরন করলে দ্বিতীয় বিয়ে হিসাবে আম্মা এই সংসারে আসেন। আমাদের বড় ভাইর তিন দিন বয়সে তার মা মারা যান।
আব্বার প্রথম স্ত্রীও ছিলেন আমার আম্মার আপন চাচাতো বোন। সেই বিয়েতেও উপস্থিত ছিলেন আম্মা। তখনও তিনি আব্বার তরুনী শ্যালিকা। বিপত্মীক হলেও আমার নানা দেখেছেন শিক্ষিত পাত্র। ১৯৪২ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে আব্বা বিএসএসি পাশ করেন।
আর বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আম্মা স্কুলের চৌকাঠ ডিঙ্গাতে পারেননি। কিন্তু যা পড়েছেন সবই তাঁর কন্ঠস্থ ছিল। হাতের লেখা ছিলো চমৎকার। আম্মার এই বৈবাহিক জীবনে কষ্ট ডেকে আনে দেশভাগ। ভারত-পাকিস্তান দুটি দেশে ভাগ হলে সিলেট জেলাও বিভক্ত হয়।
নদী সীমান্তে বিভক্ত সিলেটের যে অংশটি ভারতে পড়েছে আমাদের দাদা বাড়ি, নানা বাড়ি দুটিই ভারতে পড়ে যায়। আমাদের সময়ে আমরা স্কুলে ‘সুরমা নদীর আত্মকথা’ নামের একটি লেখা পড়েছিলাম। সেখানে উল্লেখ করা ছিল আসামের বরাক নদী কিভাবে সুরমা-কুশিয়ারা নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে!
আমাদের শৈশবের পাঠ্য বাংলা বইয়ের সুরমা নদীর আত্মকথা মূলত এ রকমঃ ‘আমার নাম সুরমা। কিন্তু আমি চোখে দেবার সুরমা নই। আমি একটি নদী। আমার জন্ম ভারতে। বদরপুরের ভাঙ্গার বাজারের নিকট আসিয়া সুরমা-কুশিয়ারা নামে দুইভাগে বিভক্ত হইয়া আমি বাংলাদেশে প্রবেশ করিলাম’!
এই ভাঙ্গার বাজারে আমাদের দাদা বাড়ি। নানা বাড়ি বদরপুরে। আব্বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পিটিআই সুপারিন্টেডেন্ট হিসাবে চাকরি করতেন। এরজন্য ভারত সরকার তাঁর জমিজমা সব বাজেয়াপ্ত করে। আমাদের ভাইবোনদের জন্ম বাংলাদেশে।
অবসর গ্রহনের আব্বা পূর্ব পুরুষের দেশে ভারতে ফিরে না গিয়ে কুলাউড়ায় বাড়ি করেন। আম্মার এক ভাই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়েতে চাকরি করতেন।অবসর গ্রহনের পর তিনিও বাড়ি করেন কুলাউড়ায়। এভাবে কুলাউড়ায় আমাদের অনেক আত্মীয়স্বজনের বাড়ি।
যাদের বেশিরভাগ চাকরি করতেন আসাম-বেঙ্গল রেলওয়েতে। তখন আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের দুটি গুরুত্বপূর্ণ জংশন স্টেশনের একটি ছিল কুলাউড়ায়, আরেকটি বদরপুরে। কুলাউড়া থেকে লাতু(পরবর্তীতে উত্তর শাহবাজপুর)-মহীশাসন বদরপুর হয়ে ট্রেন গৌহাটি যাতায়াত করো।
সেখান থেকে যেতো সারা ভারতে। ব্রিটিশ শাসনামলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও মেঘালয়ের শিলং থেকে এ পথে ট্রেনে করে সিলেটে এসেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর শরণার্থীদের বড় অংশকে এ পথে ট্রেনে করে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
আমার দাদা-নানার পরিবার দুটি ভারতে প্রতিষ্ঠিত হওয়াতে তাদের অন্য কেউ আর তৎকালীন পাকিস্তানমুখী হননি। আম্মা হয়ে যান একা। আব্বা হবিগঞ্জ পিটিআইতে থাকতে আমার জন্ম হয়। শিশুকালের আলীগঞ্জ(হাজিগঞ্জ)-লক্ষীপুর-ভোলা শহরের স্মৃতি কিছুটা মনে আছে।
শিশুকালের ছোট পায়ে লক্ষীপুরের রহমতখালি খালকে তখন মনে হতো অনেক বড় এক নদী! বড় হয়ে লক্ষীপুরে গিয়ে দেখি এটি সরু একটি খাল! রহমতখালি রেগুলেটরের কারনে অবশ্য খরস্রোতা রহমতখালির অপমৃত্যু ঘটেছে। লক্ষীপুরে থাকতে আব্বা এক বছরের জন্যে ফিলিপাইনে যান প্রশিক্ষনে।
আমাদের পরিবারটিকে তিনি তখন সান্তাহারে মামার বাসায় রেখে যান। আম্মার আট ভাইবোনের এই ভাইটিই শুধু ছিলেন এদিকে। আমরা তাকে ডাকতাম সান্তাহারের মামা। আর সব ভাই ভারতে। তাদের আরেক বোন আগেই মারা গিয়েছিলেন।
ছোটবেলা থেকে দেখতাম আম্মা বেড়াতে খুব পছন্দ করতেন। বোরকা পরলেও সেজেগুজে থাকতেন। তখন খুব কম মহিলা বোরকা পরতেন। গ্রামের কিছু পরিবারের পর্দা প্রথা ছিল রিক্সায় শাড়ি পেঁচিয়ে চলা। বিয়ের পাল্কিতেও শাড়ি পেঁচিয়ে দেয়া হতো।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বোরকা ধরে আম্মার বেড়ানোর সঙ্গী হতাম আমি। লক্ষীপুরে আব্বা যখন ভোরবেলা হাঁটতে বেরুতেন আমাকে সঙ্গে নিতে চাইতেন। হাঁটা শেষে মিস্টির রসে ভিজিয়ে গরম পরোটা খাবার লোভেও আব্বার সঙ্গে যেতাম।
আমার পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমনের হাঁটার প্রশিক্ষনটা এভাবে শৈশবে আব্বার কাছে পাওয়া। ফিলিপাইন থেকে ফেরার পর আব্বা লক্ষীপুর থেকে ভোলায় বদলি হন। তখন আজকের মতো বিশাল সব লঞ্চ ছিলোনা। ভোলার যাবার পথে আমাদের লঞ্চটি সে রাতে ঝড়ের কবলে পড়েছিল।
ভোলায় কালীনাথ রায়ের বাজারের নাগর আলীর বাসায় আমরা ভাড়া থাকতাম। তালুকদার বাড়ি আর মোল্লা বাড়ির মাঝখানে নাগর আলীর বাড়িটা তখন একতলা টিনের চাল-বেড়ার ছিল। সে বাড়ির একটি অংশে পরিবার নিয়ে থাকতে নাগর আলী। আরেক অংশ আমাদের কাছে ভাড়া দেয়া হয়।
আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমদ ছিলেন তালুকদার বাড়ির জামাই। তখনও ভোলার প্রায় সব বাড়ির টয়লেট ছিল থাকার ঘর থেকে একটু দূরে খালের উপরে। পর্দানশীল মহিলারা খালের উপরের টয়লেটে যাওয়া-আসায় ছাতা ব্যবহার করতেন।
আম্মা-আপাকেও টয়লেটে যেতে এভাবে ছাতা ব্যবহার করতে হতো। আম্মা-আপার কষ্ট দূর করতে আব্বা তখন বাড়িওয়ালাকে কয়েক মাসের অগ্রিম বাসা ভাড়া দিয়ে ঘরের পাশে পাকা টয়লেট তৈরি করান। পর্যটক জীবনে ভোলায় গিয়ে দেখি সেই খালগুলোও আর নেই।
আমাদের শিশুকালের বন্ধু তোফায়েল আহমদের শ্যালক আলমগীরকে আমরা আইঙ্গা ডাকতাম। পর্যটক বন্ধুকে তাদের বাড়িতে অতিথি করে তোলেন আলমগীর ওরফে আইঙ্গা। আমাদের শিশুকালের বাড়িওয়ালা নাগর আলীর সঙ্গেও তখন দেখা হয়।
নাগর আলী আমার কাছে জানতে চান আমার আম্মা কি এখনও আগের মতো সেজেগুজে থাকেন? এখনও কি দুটো করে বেনী বাঁধেন সেই আগের মতো? পর্যটক হতে আমি দীর্ঘ আঠারো মাস বাড়ি থেকে পালিয়ে নিখোঁজ ছিলাম।
বাংলাদেশ ভ্রমন শেষে বাড়ি ফিরে গিয়ে আম্মাকে নাগর আলীর কথাটি বললে তিনি লাজুক হাসি হেসেছেন। আমি একবার লক্ষীপুর থেকে ঢাকায় ফিরে জনকন্ঠে আমার আম্মাকে উ দ্ধৃত করে রিপোর্টারের ডায়েরিতে তাঁর একটি স্মৃতি লিখেছিলাম।
লক্ষীপুরের সামাদ একাডেমী তখন ওই এলাকার নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। সামাদ একাডেমীর পিছনে ছিল দেশের বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদারদের বাড়ি। মজুমদার পরিবারের ফলবাগানটি ছিল গোটা তল্লাটের মধ্যে বিখ্যাত।
মাঝে মাঝে বাদুড় তাড়াতে দিনের বেলায় ফলবাগানের আকাশে ফাঁকা গুলি শব্দ করা হতো। তখন গুলির শব্দে একসঙ্গে শতশত বাদুড় যখন আকাশে উড়তো তখন আকাশটাই যেন মেঘের মতো কালো দেখাতো।
আম্মাকে উদ্ধৃত করে সেই লেখাটি পড়ে রামেন্দু মজুমদার আমাকে ফোন করেছিলেন। আমাকে ফোনে তিনি বলেন ‘লেখাটি পড়ে আমি স্মৃতিকাতর হয়েছি। আপনার আম্মা কখনও ঢাকায় এলে আমাকে খবর দেবেন। আমি তাকে সালাম করতে যাবো’।
আম্মার সঙ্গে রামেন্দু মজুমদারের দেখা হয়নি। তিনি সহজে কুলাউড়ার বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে চাইতেননা। কিন্তু কুলাউড়ায় পরিচিতজন যিনি যখন যেতেন আমার আম্মাকে সালাম করতে যেতেন।
বিচিন্তার আমলে আমি প্রায় ঈদে বাড়ি যাবার সময় ঢাকা থেকে তরুন সাংবাদিকদের বড়সড় দল নিয়ে যেতাম। এভাবে আজকের প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকদের অনেকে তখন কুলাউড়া যাওয়ায় আমার আম্মাকে তারা চিনতেন জানতেন। আমি যে সাংবাদিক এটা নিয়ে আম্মার গর্বের পাশাপাশি ভয়ও ছিল।
আমি বিদেশে থিতু হবার কারনে কষ্টের পাশাপাশি তিনি স্বস্তিবোধও করতেন। সব মায়েরা চান তার ছেলে দেশে আসবে। কিন্তু আমার আম্মা সেভাবে চাইতেননা। তিনি মনে করতেন বিদেশে থাকায় তার ছেলেটা অন্তত বেঁচে আছে। নিরাপদে আছে।
২০১৬ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ উপলক্ষে আমি ভারতে যাই। বাংলাদেশের খেলাগুলো দেখে দেখে যাই দেশে। সেটাই আম্মার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। তবে ফোনে-ভিডিওকলে প্রায় কথা হতো। আমাকে শুধু বলতেন বয়স বাড়ায় তিনি আর কোনকিছু মনে রাখতে পারেননা।
আমি তাকে বলতাম আপনার কোন কিছু মনে রাখার দরকার নেই। আপনি শুধু বেঁচে থাকুন। আমি মাঝে মাঝে অমর্ত্যকে ফোনে তাকে ধরিয়ে দিতাম। অমর্ত্য জিজ্ঞেস করতো, দাদি তুমি কেমন আছো। অমর্ত্যর হঠাৎ মৃত্যু তাকে বিধবস্ত করে দেয়।
এরপর যখন আমার পরিচিতজন যার সঙ্গে দেখা হতো তাকে বলতেন, বদরুতো আর দেশে ফিরবোনা। আমাকে তিনি বদরু নামেই ডাকতেন। এখন তিনিই চলে গেছেন না ফেরার দেশে। অমর্ত্যর স্মরনে আমরা মসজিদ করেছি, উন্দালে গরিব মানুষদের খাওয়াই এটা তিনি খুব পছন্দ করেছিলেন।
মাস খানেক আগে আমার স্ত্রী স্বপ্নে দেখেন অর্মত্য একটি নতুন কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে! অমর্ত্য কি আগে চলে গিয়ে তার দাদির জন্যে অপেক্ষায় ছিলো?
আম্মার মৃত্যুতে যারা শোক প্রকাশ করেছেন, সমবেদনা জানিয়েছেন, দোয়া করেছেন, আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। আপনাদের প্রার্থনায় রাখুন আমাদের আম্মাকে। তিনি একজন ভালো মানুষ, ধার্মিক-দয়ালু-প্রগতিশীল-দানশীল মানুষ ছিলেন।
সবাই যার যার মায়ের প্রতি যত্মবান থাকুন। আম্মার মৃত্যু সংবাদ পাবার পর প্রথম ভেবেছি, শিশুকাল থেকে কত কষ্টে তিনি আমাদের বড় করেছেন। নোংরা নেপি পরিস্কার করতে কখনও ভাবেনই এটা কত নোংরা। এটাইতো মাতৃ জীবন। মা যার নেই সেই জানে তার কেউ নেই।
সব মায়েদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা।