ফজলুল বারী: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কলকাতায় একটি তথ্যচিত্র বানানো হচ্ছে ‘কলকাতায় বঙ্গবন্ধু’। কলকাতার মৌলানা আজাদ কলেজে বঙ্গবন্ধু পড়েছেন। সেখানকার বেকার হোস্টেলে তিনি তিনি থাকতেন। খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা গৌতম ঘোষ তিরিশ মিনিটের তথ্যচিত্রটি বানাচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধুর, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, শেখ হাসিনার লেখালেখির তথ্য নিয়ে স্ক্রিপ্ট তৈরি করেছেন গৌতম ঘোষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই তথ্যচিত্রে ক্যামেরার সামনেও কথা বলবেন। ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ও কলকাতার বাংলাদেশ উপ হাইকমিশন যৌথভাবে তথ্যচিত্রটি প্রযোজনা করছে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর জড়িয়ে পড়া, আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে রাত কাটানো, পার্ক সার্কাসে ঘুরে বেড়ানো, ব্রিগেডের ময়দানে তাঁর আগুন ঝরানো ভাষনের উল্লেখ থাকার কথা এই তথ্যচিত্রে। এসবের কতটা ৩০ মিনিটের তথ্যচিত্রে জায়গা করা যাবে তা জানা যাবে সেটি মুক্তির পর।
এছাড়া শ্যাম বেনেগাল বানাচ্ছেন ‘বঙ্গবন্ধু’ বায়োপিক। বাংলাদেশ ও ভারত সরকার মিলে বিশাল বাজেটের এক ছবি। এই বায়োপিককে কেন্দ্র করে কয়েকজন নির্মাতার নাম প্রস্তাব করেছিল ভারত সরকার। ৮৬ বছর বয়সী কালজয়ী নির্মাতা শ্যাম বেনেগালকে বেছে নিয়েছে বাংলাদেশ।
এ ছবির চিত্রনাট্যের রাজনৈতিক দিকটাও শুধরে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চিত্রনাট্যকারকে শেখ হাসিনা বলেছেন, ছবির নান্দনিক দিকটা আপনারা দেখুন। রাজনীতির অংশটা তিনি দেখে দিয়েছেন। রোজ ফজরের নামাজের পর শেখ হাসিনা ছবির স্ক্রিপ্ট নিয়ে দু’ঘন্টা বসতেন।
এরপর নোট নিয়ে চিত্রনাট্যকারের সঙ্গে কথা বলতেন। তাঁর পরামর্শ চিত্রনাট্যে প্রতিফলিত হয়েছে। ছবিতে বঙ্গবন্ধুকে শুধু জাতির নায়ক হিসাবে নয়, একান্ত পারিবারিক দৃষ্টিকোন থেকেও দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। সেখানে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব তথা রেনু চরিত্রটিও গুরুত্বপূর্ণ।
এরজন্য ছবির টিম যেদিন প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে, সেদিন তাঁকে তারা বলেছেন, আমরা ছবিটা আপনার মায়ের চোখ দিয়ে বানাতে চাই। শেখ মুজিবের প্রিয় ‘রেনু’র চোখ দিয়ে। গ্রামের সাধারন এক মেয়ে রেনু। বাল্যবিবাহ হওয়ায় তাঁর পড়াশুনা বেশিদূর হয়নি।
সেই একজন রেনু, গ্রামের নিরীহ মেয়ে, যে তাঁর স্বামীকে রাজনীতিতে আসতে দিতে চায় না–সেখান থেকে ফজিলাতুন্নেসা মুজিব কীভাবে ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধুর সার্থক অর্ধাঙ্গিনী হয়ে উঠেছিলেন। রেনু চরিত্রের গভীরে যেতে ছবির চিত্রনাট্যকার শামা জাইদিকে এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানা দু’দিন ধরে তাঁর মায়ের গল্প শুনিয়েছিলেন।
ছবির বড় অংশের শুটিং শেষ করা হয় মুম্বাইয়ে। সেখানকার দাদাসাহেব ফালকে ফিল্ম সিটিতে হয়েছে ছবির গুরুত্বপূর্ণ অংশের শুটিং। আরেফিন শুভ বঙ্গবন্ধু চরিত্রে অভিনয় করছেন। চঞ্চল চৌধুরী সেজেছেন বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমান। দিলারা জামান মা বঙ্গবন্ধুর।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর জাতির পিতা তাঁর নিজ দেশেই নিষিদ্ধ ছিলেন। বেতার–টিভি থেকে শুরু করে কোথাও বঙ্গবন্ধুর নাম নেয়া যেতোনা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুতো ভারতে নিষিদ্ধ ছিলেননা। ভারতে কেনো এতদিন এসব উদ্যোগ হয়নি। এর সোজা উত্তর, রাজনীতি এবং অর্থ।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ইন্দিরা গান্ধী শেখ হাসিনা–শেখ রেহানাকে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় দেন। কিন্তু ভারতে তাদের অবস্থান গোপন রাখা হয়। ভিন্ন নাম পরিচয়ে তাদের সেখানে থাকতে হয়েছে। কারন জিয়া–এরশাদ–খালেদা আমলেও বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক–অর্থনৈতিক সুসম্পর্ক ছিল।
এরপরতো ইন্দিরা গান্ধীই ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হলেন। দিল্লীর অকংগ্রেসী শাসনামলেও ভারতীয় চিত্র নির্মাতা–শিল্পী–সাংবাদিকরা সরকারি দাওয়াত খেতে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর দেশে নিষিদ্ধ বলে, সেই ভারতীয় মেহমানরাতো কখনও বাংলাদেশে যাবোনা বলে সফর প্রত্যাখ্যান করেননি।
সিনেমা বানাতে যেহেতু টাকা লাগে আর শেখ হাসিনা টাকা দেবেন জানেন বলেই এখন ভারত থেকেও এমন উদ্যোগ–আন্তরিকতা–ভালোবাসার শেষ নেই। আর মুম্বাইতে টুঙ্গিপাড়ার নদীর ঘাট সাজিয়ে বঙ্গবন্ধু বায়োপিক এমন এক সময়ে বানানো হচ্ছে তা দেখেশুনে বাংলাদেশের এই প্রজন্মও চমকে উঠবে।
কারন এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও লক্ষ লক্ষ ছবি ছাড়া বাংলাদেশের কোথাও বঙ্গবন্ধু নেই। বঙ্গবন্ধুর চেহারা সুরত থেকে শুরু করে পোশাক–রাজনীতি–অর্থনৈতিক কর্মসূচি কিছুই এখন আর নেই বাংলাদেশে। এখন ছাত্রলীগ–যুবলীগ পরিচয় দেয়া বেশিরভাগ নতুন প্রজন্ম দাঁড়িওয়ালা।
ছাত্র–যুবক বয়সে অথবা জীবনে কখনও দাঁড়িওয়ালা বঙ্গবন্ধুর একটা ছবিও নেই। মুজিবকোটকে এদের অনেকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের ধান্ধার পোশাক হিসাবে পরে বা ব্যবহার করে। তাদের অনেকের বেঢপ ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়ির সঙ্গে একটা মুজিবকোটে তাদেরকে পাকিস্তান–আফগানিস্তান, বা আরব দেশ থেকে আসা আগন্তুক মনে হয়।
নীতি–আদর্শ দূরে থাক, অবয়বেও তাদেরকে বঙ্গবন্ধুর অনুসারী বা সৈনিক মনে হয়না। যিনি ঘরের বেশিরভাগ সময় একটা সাধারন গেঞ্জি–লুঙ্গি পরে থাকতেন। তাঁর মত কৃষক–শ্রমিকবান্ধব, চাষাভূষাদের প্রিয় একটাও নেতা এখনকার আওয়ামী লীগে নেই।
এই আওয়ামী লীগ তাঁর রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক সব কর্মসূচিও ত্যাগ করেছে। যদিও এরা এখন কপট–ভন্ডের মতো সারাক্ষণ বঙ্গবন্ধুর নীতি–আদর্শ বাস্তবায়নের বুলি আওড়ায়। বঙ্গবন্ধুর নীতি–আদর্শের সঙ্গে থাকলে কেউ দুর্নীতি করতে পারেনা। দুর্নীতিবাজ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নীতি–আদর্শের বাস্তবায়ন হয়না।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বিখ্যাত উক্তি অনেকের টাইম লাইনে ঘুরছে। ‘রাজনীতি করতে চাইলে দুর্নীতি ছাড়তে হবে। আর দুর্নীতি করলে রাজনীতি ছাড়তে হবে’। পচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য দায়ী খুনিদের এখন দেশের মানুষ জানে–চেনে। এরা সবাই আওয়ামী লীগার ছিল।
খুনের পটভূমি সৃষ্টির জন্যে অমুক অমুকদের দায়ী করে মুখস্ত বক্তৃতা দেয়া হয়। কিন্তু এরাও প্রকারন্তরে বঙ্গবন্ধুকে আড়াল করে। বঙ্গবন্ধুর যত বক্তৃতা পাওয়া যায় এর সবক’টিতে তিনি দল ও দেশের দুর্নীতিবাজ–ঘুষখোর ব্যক্তিদের নিয়ে হতাশা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করতেন।
কালোবাজারি মজুতদারদের মৃত্যুদন্ডের বিধান করে বঙ্গবন্ধু আইন পাশ করেছিলেন। আর এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও দেশ বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শে না থাকায় এখন এসব কেউ শোনেওনা–মানেওনা! কালোবাজারি মুজতদাররা এখন যখন তখন সরকারকে দেশের মানুষকে জিম্মি করছে!
আর এ অবস্থার ভিতরও দেশে পাঁচ দিনে সাত লাখ লিটার সয়াবিন তেলের মজুত উদ্ধারের পর ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিআই এই উদ্ধার অভিযান বন্ধের দাবি করছে! টেলিভিশনে এরা মুজিবকোট পরে আসছে! বঙ্গবন্ধুকে অপমানের এরচেয়ে বড় দুঃসাহস আর কি হতে পারে?
বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে জনগনকে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার দায়ে চিহ্নিত ব্যক্তিদের করা হচ্ছে মামুলি জরিমানা। এরজন্য এরা আগাগোড়া ড্যামকেয়ার চোর–পুলিশ খেলা খেলতেই থাকে। আওয়ামী লীগের এত অর্জন এসবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। বিএনপির ব্যবসায়ীরা এসব করছে বললে সরকারের দূর্বলতা প্রকাশ পায়।
গঠনতন্ত্রে জাতীয় চার মূলনীতির সমাজতন্ত্রের কথা হলেও এই সরকার মুক্তবাজার অর্থনৈতিক কর্মসূচির অনুসারী। কালোবাজারী মজুতদারীর সঙ্গে জড়িতদের এই আওয়ামী লীগই দলে ঠাঁই দিয়েছে! এরজন্যে প্রথম দিকে বলা হতো আওয়ামী লীগের লোকদের হাতে টাকা পয়সা নেই।
একুশ বছর ধরে দল রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছে। তাদের টাকা–পয়সা হওয়া দরকার। টাকা–পয়সা যারা করছে তারা সীমিত কতিপয়। তাদের আয়–রোজগার অবিশ্বাস্য। কিন্তু বদনাম হচ্ছে সবার। ফরিদপুরের সেই আলোচিত দুই ভাই রুবেল–বরকত ধরা পড়ার পর তাদের পাচারকৃত টাকার অংক শুনে মানুষ চমকে যায়।
কিন্তু তারা যাদের হয়ে টাকার ময়দানে ছিল তাদের ধরা হয়নি। আগে পুতে পরে বাপে চলে গেছে বিদেশে। গ্রেফতার এড়াতে রুবেল–বরকত তাদের আব্বার আব্বা খন্দকার মোশাররফের বাড়ি গিয়ে উঠেছিল। পুলিশ তার বাড়ি ঘিরে ফেলে। এটা তার জন্যে এবং ফরিদপুরের অনেকের জন্যে অবিশ্বাস্য ছিল।
মোশাররফ ঢাকার এক নেতাকে ফোন করেন। ওই নেতা তাকে বলেন, পুলিশকে বাধা দেবেননা। বাধা দিলে পুলিশ আপনাকেও নিয়ে যাবে। নিউজ অবশ্য হয়েছে পুলিশ তাদেরকে মোশাররফের বাড়ির সামনে থেকে ধরেছে। এরপর লম্বা বিরতি দিয়ে হাতকড়া পড়েছে মোশাররফের ভাইর হাতেও।
আর তার ভাগ্য, সাধের ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন–নেতৃত্ব–স্বর্গরাজ্য সব বাদ দিয়ে তিনি চলে যেতে পেরেছেন বিদেশে! ইউরোপের দেশে বসে অনলাইনে চোখ রেখে তিনি চেয়ে চেয়ে দেখলেন তাকে মাইনাস করে কতকিছু হয়ে গেলো, তার বলার কিছু ছিলোনা।
এখনও ভাগ্য, ফরিদপুরে হিন্দু সম্পত্তিসহ যত জমি–জিরাতের মালিক তিনি বনেছিলেন, তা এখনও জব্দ হয়নি। এসব কিভাবে উদ্ধার হবে তা নিয়ে এখনও কেউ কিছু বলছেনা। তবে উদ্ধার হবে। প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের নামে শ্রমিকদের কাছ থেকে মাথাপিছু ব্যবসা অমুক মিয়া আদায় করতেন, সেটা এখন স্মৃতি।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রীও ছিলেন। সেখানকার নানান কার্যক্রমের বখরা দেখতেন একজন। একদিন এক সম্পাদক এক নির্মান প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখেন সবাই ব্যস্ত, অমুক সাহেব আসবেন! সেই সাহেবকে দেখে অবাক সেই সম্পাদক! আরে এতো তার পত্রিকার জুনিয়র রিপোর্টার ছিল!
এতসব দাপটের যদি নিঃশব্দ বিদায় সম্ভব হয়, কালোবাজারি–মজুতদারদের বঙ্গবন্ধুর করা আইনে ফাঁসি কেনো হবেনা। একটা দৃষ্টান্ত হোক। একটি অভিনন্দন । আপাতত বড় অর্জন হলো, রাজাকার পরিচয়ের বদনাম থেকে আমরা সবাই রক্ষা পেয়েছি। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে এমন পরিচয় যুক্ত থাকতে পারেনা।