বেছে বেছে হিন্দু শিক্ষকদের ওপর আক্রমন

বেছে বেছে হিন্দু শিক্ষকদের ওপর আক্রমন

ফজলুল বারী:নড়াইলের হিন্দু শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতোর মালা পরানোর ধৃষ্ট ঘটনা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল খতিয়ে দেখতে শুরু করেছেন। অতএব দুষ্টু লোকরা সাবধান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মারবেন। তার হাতে পুলিশ আছে। আরও অনেক বাহিনী আছে।

বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন,  নড়াইলে শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসকে হেনস্থার ঘটনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঘটনার জন্যে দূঃখপ্রকাশ করে মন্ত্রী বলেছেন সেখানে উত্তেজিত জনতা একত্রিত হয়েছিল। পুলিশ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওই ঘটনা ঘটে গেছে।

এখন আর খতিয়ে দেখে কী করবেন মন্ত্রীসাব। জুতার মালাতো উঠেই গেছে একজন শিক্ষকের গলায়। যিনি আবার একজন হিন্দু মাষ্টার। তাঁর গলায় জুতোর মালা যারা পরিয়েছে তারা ভেবেছে এতে করে তাদের ধর্মজ্ঞানের সৌন্দর্য বেড়েছে! হায়রে ধর্ম! এমন ধর্ম আগে কখনও বাংলাদেশে ছিলোনা।

মন্ত্রী দূঃখ প্রকাশ করেছেন ভালো কথা। আমাদের মন্ত্রীরা সাধারনত এভাবে দূঃখ প্রকাশ করেননা বা এমন ঘটনায় লজ্জিতও হননা। কিন্তু তিনি কি ঘটনার ভিডিও না দেখে বক্তব্য এই দিয়েছেন? না তাঁকে সেই ভিডিও দেখতে দেয়া হয়নি! এটাতো অবিশ্বাস্য। মন্ত্রীর বক্তব্য কৌশলগত হলে তা ভিন্ন কথা।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভিডিওতে স্পষ্ট দেখানো হয় গুজব আক্রান্ত লোকজন আসছিল। তাদের মাঝে গুজব রটানো হয়েছিল মাষ্টার সেই ছাত্রের পক্ষ নিয়েছেন যে ভারতের নুপুর শর্মাকে প্রশংসা করে ফেসবুকে পোষ্ট দিয়েছে। অতএব এখন ওই মাষ্টারকে মারতে হবে। তাঁর গলায় জুতোর মালা পরাতে হবে।

একদিন ধরে সেখানে গুজবটি ছড়ানো হচ্ছিল! সম্ভবত গোটা এলাকায় আওয়ামী লীগের কোন লোকজন না থাকায় সেখানেও গুজবওয়ালারা পাল্লায় ভারী ছিল! অথবা সেই জনতার সঙ্গে মিশে গিয়ে আওয়ামী লীগের লোকেরাও সওয়াব কামাতে চেয়েছে!

তৌহিদী জনতা আসবে জেনে নড়াইলের  ডিসি-এসপি সহ কর্মকর্তারাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তৌহিদী জনতা আসছে দেখে পুলিশের কিছু সদস্য তৎপরতা দেখান। বন্দুকে হাত রেখে হাঁটাহাঁটি করেন। তাদের অনেকের গায়ে ডিবি লেখা ভেস্টও ছিল।

তৌহিদী জনতাকে কিভাবে মোকাবেলা করা হবে তেমন একটি প্ল্যান আগেই করে রাখা হয়েছিল! প্ল্যান অনুসারে হাত জোড় করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসকে অফিস রূম থেকে জনতার সামনে আনা হয়। শান্তির ধর্মের প্ল্যান! আগে ছিল গুজব, এখন দেখানো হলো মাষ্টারই দোষী!

কারন সে যে হিন্দু! নতুবা দোষই যদি তিনি না করবেন তাঁকে হাত জোড় করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে এভাবে তৌহিদী জনতার সামনে আনা হলো কেনো? এরপর সবাইকে দেখিয়েই তাঁর গলায় পরিয়ে দেয়া হয় জুতোর মালা! পুলিশের কিছু সদস্য তা দেখে হাসছিলেন! এটাই যেনো তাঁর প্রাপ্য ছিলো!

কাজেই ‘কিছু বুঝে ওঠার আগেই জুতোর মালা পরানোর ঘটনা ঘটে গেছে’, মন্ত্রীর এমন বক্তব্য ঠিক নয়। ‘হিন্দু মাষ্টার’কে মুসলমান জনতার সামনে দাঁড় করিয়ে ক্ষমা চাওয়ানো হবে এটা সেখানে আগেভাগে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। মন্ত্রী এখন বিষয়টি আড়াল করার জন্যে খতিয়ে দেখার কথা বলছেন!

এভাবে সত্য আড়াল করতে আর কথিত খতিয়ে দেখতে দেখতে এ ধরনের ঘটনা কিন্তু থামছেইনা। বেছে বেছে হিন্দু শিক্ষকদের টার্গেট করে এ ধরনের ঘটনা কেনো ঘটছে তা খতিয়ে দেখবে কে? সেলিম ওসমানের কী বিচার করা হয়েছিল? না আড়াল করা হয়েছিল?

যে সেলিম ওসমান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে ওঠবস করিয়েছিলেন! সেখানেও বলা হয়েছিল হিন্দু শিক্ষক ধর্মের অবমাননা করেছেন! হিন্দু শিক্ষকদের খেয়েদেয়ে কাজ নেই তারা শুধু ধর্মের অবমাননা করেন! পরে জানা গেলো শ্যামল কান্তকে নাজেহালের কারন স্কুল কমিটির দ্বন্দ্ব।

মুন্সিগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের ঘটনাও ধামাচাপা দেয়া হয়েছিল। একাধিক শিক্ষকের শয়তানিতে ছাত্রদের দিয়ে পরিকল্পিত প্রশ্ন করিয়ে এর রেকর্ড ছাড়া হয় অনলাইনে। এরপর ডিজিটাল আইনে মামলা দিয়ে গ্রেফতার করা হয় হৃদয় মন্ডলকে! মানুষ প্রতিবাদ গড়ে তোলায় তার জামিন হয়।

কিন্তু ভীষন সুন্দরভাবে পুরো বিষয়টি চাপা দেয়া হয়! অনেক বড়মাপের মানুষ হৃদয় মন্ডল। ষড়যন্ত্রী ছাত্রদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। কিন্তু সেই শয়তান শিক্ষকদের গ্রেফতার করা হয়নি। কারন তারা মুসলমান। রাষ্ট্রটি এখন ধর্মীয় রাষ্ট্র হয়ে গেছে! এখানে মুসলমান পরিচয়ে যা খুশি করা যায়!

ঝুমুর দাশের গ্রামে যারা হামলা করেছিল তাদের কী বিচারের সম্মুখিন করা হয়েছে? না মুসলমান পরিচয়ে সব মাফ? এরাতো ধার্মিক না। ধার্মিক নামের শয়তান। সবশেষ সাভারে শিক্ষক উৎপল সরকারকে পিটিয়ে হত্যার পর প্রথম ছড়ানো হলো ঘাতক ছাত্র মানসিক রোগী!

কিন্তু ওই স্কুলের এক ছাত্রী টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে জানালো ওই ঘাতক সব সময় মেয়েদের উত্যক্ত করতো। ঘটনার দিন ঘাতক একা নয়, তারা কয়েক বন্ধুকে নিয়ে সেই শিক্ষকের ওপর চড়াও হয়। ঘটনা নিয়ে হৈচৈ শুরুর পরও তারা স্কুলের সামনে ঘাতককে চলাফেরা করতে দেখেছেন।

এরপর সে আত্মগোপনে যাওয়া নিশ্চিত হবার পর শুরু হয়েছে পুলিশি তৎপরতা! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো খতিয়ে যখন দেখা শুরু করেছেন আসল রহস্য বের করেন। কেনো দেশে হঠাৎ করে বেছে বেছে এভাবে হিন্দু শিক্ষকদের ওপর চড়াও হয়েছে বিশেষ লোকজন? হিন্দুরা আর আওয়ামী লীগকে নির্ভর করতে কী পারছে?