ফজলুল বারী :১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল। বিকালবেলা কলকাতা প্রেসক্লাবে আসেন ব্যারিস্টার আমির উল ইসলাম। তরুন ব্যারিস্টার তখন থেকেই তাজউদ্দিন আহমদের বিশেষ সহকারীর ভূমিকায় কাজ করছিলেন। আমির উল ইসলাম সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, পরের দিন বাংলাদেশ সরকারের একটা অনুষ্ঠান আছে। সাংবাদিকরা যদি যেতে চান তাহলে যেন ১৭ এপ্রিল সকালের দিকে প্রেসক্লাবে উপস্থিত থাকেন। তাদের নিতে গাড়ি আসবে। একথা বলেই প্রেসক্লাব থেকে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে চলে যান আমির উল ইসলাম। কোথায় অনুষ্ঠান, কিসের অনুষ্ঠান তাকে আর কেউ জিজ্ঞেস করার সুযোগ পাননি।
তখনতো আর আজকের মতো মোবাইল ফোন ছিল না। তা স্বত্ত্বেও মূহুর্তে খবরটি চাউর হয়ে যায় গোটা কলকাতার মিডিয়া পাড়ায়। বাংলাদেশের কী অনুষ্ঠান কোথায় অনুষ্ঠান এসব নিয়ে যে যার মত করে কল্প গল্প বানাতে থাকেন। তখনও বাংলাদেশ নয়, জয়বাংলা সবার মুখে মুখে। শরণার্থী, কলকাতায় আশ্রয়প্রাপ্ত লেখক সাংবাদিক শিল্পী সবার পরিচয় জয়বাংলার লোক। কিন্তু তাঁরাও কোন প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননা। কারন তাজউদ্দিন বা ব্যারিস্টার আমির উল ইসলাম বা বাংলাদেশের কোন গুরুত্বপূর্ণ নেতা কে কোথায় থাকেন তা কেউ জানেননা। ভারত সরকারের কড়া বারন।
পরের দিন যদি কোন কারনে গাড়ি মিস করেন এই দুর্ভাবনায় অনেক সাংবাদিক রাতে প্রেসক্লাবেই থেকে যান। অনেকটা নির্ঘুম রাত কাটে অনেক সাংবাদিকের। ভোরের দিকে দুটো গাড়ি আসে প্রেসক্লাবের সামনে। সে দুটিতে সবাই গাদাগাদি করে বসেন। কোন অভিযোগ নেই। অন্য সময় হলে হয়তো সাংবাদিকরা রাগারাগি করে বলতেন কী ছাইপাঁশ গাড়ি এনেছেন এসব। কলকাতার স্থানীয় সাংবাদিকের সংগে কিছু বিদেশি সাংবাদিকও ছিলেন সেই বহরে। একাধিক বিদেশি সাংবাদিক নিজস্ব ভাড়া গাড়িতে বহরকে অনুসরন করছিলেন। কলকাতার সাংবাদিকও অবশ্য আমাদের কাছে বিদেশি সাংবাদিক। যশোর রোড ধরে সীমান্তের দিকে ছুটে চলে গাড়ির বহর।
মুজিবনগর তথা তৎকালীন বৈদ্যেরনাথতলায় তখন চলছে ভিন্ন এক প্রস্তুতি। এক রকম অভিনয়ও বলা চলে। বিদেশি সাংবাদিকদের আস্থা অর্জনের জন্য তখন হয়তো এসব দরকার ছিল। বৈদ্যেরনাথতলার অনুষ্ঠানস্থলের একটু দূরে ঝোঁপের মত জায়গায় একটি পরিত্যক্ত ইপিআর ক্যাম্প ছিল। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা ভারত থেকে এসে সেই ইপিআর ক্যাম্পে গিয়ে বসেন। তাই বিদেশী সাংবাদিকরা অনুষ্ঠান স্থলে এসে দেখেন বাংলাদেশের মন্ত্রীরা বাংলাদেশের ভিতর থেকে আসছেন!
শপথ শেষে সবাই দেখেন বাংলাদেশ সরকারের সদস্যরা সবাই বাংলাদেশের ভিতরে চলে যাচ্ছেন। আসলে তারা যান সেই ইপিআর ক্যাম্পে। সেখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চলে আসতে পারে এ কথা বলে সাংবাদিকদের নিয়ে গাড়ির বহর আবার চলতে শুরু করে কলকাতার উদ্দেশ্যে। সাংবাদিকরা যাবার কিছু সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের মন্ত্রীরাও চলে যান ভারতে। তারা যাবার কিছু সময়ের মধ্যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পৌছে যায় ওই এলাকায়। আক্রোশে তারা শপথ অনুষ্ঠানের মঞ্চ সহ সবকিছু ভেংগে তান্ডব চালায়। কিন্তু ততক্ষনে বিশ্ব জেনে গেছে নতুন একটি দেশের জন্মকথা সে দেশের নাম বাংলাদেশ। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।