পার্থে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটক ‘মাস্টার বাড়ি ‘ মঞ্চস্থ 

পার্থে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটক ‘মাস্টার বাড়ি ‘ মঞ্চস্থ 

আবুহেনা ভুইয়া : করোনা মহামারীকে পিছনে ফেলে পার্থ বাংলাদেশি কমিউনিটি তার সমহিমায় ফিরে এসেছে ২০২৩ খৃষ্টাব্দে। তারই প্রতিফলন দেখা গেল মারডক ইউনিভার্সিটির নেক্সাস থিয়েটারের প্রসিনিয়াম মঞ্চের সপ্তাহব্যপি  নাট্যোৎসব।  সপ্তাহান্তে তিনটা নাটক মঞ্চায়ন পার্থবাসির জন্য এক বিরাট পাওয়া।

এবারে প্রথমবারে মত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটক “মাস্টার বাড়ি’ সংযোজন একটি যুগান্তকারী ঘটনা। গত ২০ শে মে সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে নাটকটি মঞ্চস্থ হয় বেঙ্গল আর্টস এর পরিবেশনায়। পার্থের নাট্য সংঘঠন বেঙ্গল আর্টস এর আগে মহাত্মন মলিয়োর ‘ভদ্দরনোক” সহ কয়েকটি পরিবেশনা করলেও এই প্রথমবার তাদের নিজস্ব নাটকের মঞ্চায়ন করল। বেঙ্গল আর্টস এর কর্নধার বিশ্বজিৎ বসু লিখেছেন এই নাটক এবং মঞ্চ নির্দেশনাও তারই। তার সহযোগী ছিলেন  শর্মিষ্ঠা সাহা। চরিত্র রূপায়ণ করেছেন প্রায় ৩৫ জন পার্থবাসি বাঙালী।
বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের অনেক গল্পই আমাদের নতুন প্রজন্মের অজানা। আবার গল্পটা পরিচিত হলেও চরিত্র গুলো কিম্বা ঘটনা পরম্পরা আমাদের অজানাই থেকে যায়। মাস্টার বাড়ি নাটকটি সেই সুত্রধরের কাজটা সুচারুভাবে করতে পেরেছে। অভিজ্ঞদের স্মৃতিতে আঘাত আর নতুন প্রজন্মের কাছে তার পুর্বপুরুষের মহিমান্বিত অতীতকে তুলে ধরেছে যা নিয়ে তারা গর্ব করতে পারে বিশ্বব্যপি। আবার সেই সংগে তাদের ত্য্যগের কথাও স্মরণ করাবে।
মাস্টার বাড়ি নাটকের প্রধান চরিত্র মাস্টার মসাই যিনি চোখে কম দেখেন অবসর নিয়েছেন তারই প্রতিষ্ঠিত স্কুল থেকে। যিনি সারা জীবন তার এলাকার মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন, শিক্ষাকে হাতিয়ার করে। মুক্তি যুদ্ধের সময় তার বাড়ি ও স্কুলকে  মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কবুল করেছেন,  মুক্তিযুদ্ধকে বুকে ধারন করে শহীদ হয়েছেন। তিনি কোন সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি কিন্তু তিনিই এলাকার মুক্তিযূদ্ধাদের অনুপ্রেরণা। নাটকের নাম মাস্টার মশাই হতে পারত। কিন্তু নাট্যকার হয়ত ব্যক্তি নয় আদর্শের দিকে জোর দিতে চেয়েছেন।  কোথায় যেন ইতিহাসকে ধরার চেষ্টা।
মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটকের প্রধান শক্তি ও দুর্বলতা হল ইতিহাসকে গল্পে সংযোজন। যা সঠিকভাবে গল্পের প্রয়োজনীয় না হলে নাটকটিকে দুর্বল করে দেয়। এই নাটকেও বঙ্গবন্ধুর ভাষন, ২৫ শে মার্চ এর কাল রাত, আকাশ বানী কলকাতার খবর, স্বাধীন বাংলা বেতার, মুজিব নগর সরকার এসেছে।  নাট্যকার ইতিহাসকে পরিমিত ব্যবহার করেছেন। যা প্রসংসাযোগ্য।
স্কুলে বাচ্চাদের নিয়ে বাংগালী কবিদের নাম দিয়ে খেলাটা অনবদ্য।  এতে করে এখানকার তরুণরা চিনে গেল প্রধান কবিদের।
পাকিস্তানি সৈনিক এর হাতে একজন নির্যাতিত নারী এবং তার ঘুড়ে দারানোকে যে ভাবে উচ্চাংগ নৃত্যের মাধ্যমে পরিবেশনা করা হলো তাতে নির্দেশকের অভিজ্ঞতার ছাপ পাওয়া যায়। জ্যোতি খুব ভাল নেচেছেন এই অংকে।
স্কুল বাচ্চাদের কন্ঠে সেই সময়কার গ্রাম বাংলার কিছু মুখরোচক ছড়া ছন্দে তুলাটা অসাধারণ।  এ যেন ছড়া নয় গোটা ইতিহাসটাই ওদের কন্ঠে ধারন। যেমন:
ঠাস ঠুস ঠাস ঠুস
ইয়া হিয়ার বেলুন ফুস!!
হৈ হৈ রৈ রৈ
ভুট্টা হয়ছে ঢ্যাপের কৈ!!
কিম্বা,
মিলল্যা গেছে খাপের খাপ
নিয়াজীর হাতে হ্যানকাপ
ফরমান আলী টিক্কা খান
দৌড়ে পলায় নিয়ে জানা।
অথবা,
তা ধিন ধীন তা ধীন ধীন
দ্যাশ স্বাধীন
তুই স্বাধীন
আমি স্বাধীন
তা ধিন ধীন তা ধীন ধীন।।
মাস্টার বাড়ি নাটকের রচনাশৈলী অসাধারণ তবে সংলাপ আরও শক্তিসালি হলে মঞ্চোপযোগী হত। চরিত্র রূপায়নে বাচ্চারা দারুণ করেছে। রাজাকার, পাকিস্তান সেনা অফিসার, আর স্কুল শিক্ষিকা চরিত্র রুপায়নে মুন্সিয়ানা ছিল।
মঞ্চ সজ্জায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পর্দায় গল্পের সময়কে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।এটা ভালো।  তবে কখনো কখনো আধুনিক প্রযুক্তি সময়কে হারিয়ে ফেলে।  পোশাক সজ্জায় চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।  সাজ সজ্জা যথোপযুক্ত।
নাটকটি দর্শকদের প্রশংসা পেয়েছে।
অষ্ট্রেলিয়ার পার্থে প্রথম পুর্নাঙ্গ মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটক মঞ্চায়নে ইতিহাস হয়ে থাকবে এই মাস্টার বাড়ি নাটক।
ছবি : সজিব মিস্রি।