অনলাইন ডেস্কঃ ৪ জুলাই ২০১৫
যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধে জামায়াতে ইসলামী ‘একাধিকবার’ সৌদি আরবের হস্তক্ষেপ আশা করেছিল। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রাজনৈতিক সংকট মেটাতে সৌদি সরকারের মধ্যস্থতা চেয়েছিলেন। কিন্তু সৌদি আরব তাতে কোনো সাড়া দেয়নি।
উইকিলিকসে সদ্য প্রকাশিত সৌদি কূটনৈতিক বার্তার মধ্যে বাংলাদেশ-বিষয়ক কয়েকটির ভাষান্তর করে সৌদি আরবের এ তথ্য পাওয়া গেছে যে, মরহুম বাদশাহ আবদুল্লাহ হিজরি সন ১৯/১২/ ১৪৩২ তারিখে (ইংরেজি ১৫ নভেম্বর ২০১১) ৬১৬৪৬ নম্বর ফরমান দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এমনকি শেখ হাসিনা ওয়াজেদ সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের আশঙ্কায় সৌদি রাজকীয় খরচে আরাফাত রহমানের চিকিৎসার ব্যাপারে খালেদা জিয়ার অনুরোধেও সাড়া দেয়নি সৌদি আরব।
এ বিষয়ে ঢাকার সৌদি দূতাবাসের মতামত চেয়েও পাওয়া যায়নি। জানতে চাওয়া হলে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সৌদি আরবে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন বিস্ময় প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা অবিশ্বাস্য।’ খালেদা জিয়া কখনো মধ্যস্থতা চাননি বলেও দাবি করেন তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ রকম কিছু হলে আমি জানতাম। এটা হতেই পারে না। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সৌদি রাজপরিবারের আত্মার আত্মীয়তা ছিল এবং তার ধারাবাহিকতা আজও অটুট রয়েছে।’ তিনি ২০০৫ সালে সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহর সঙ্গে মক্কায় রাজকীয় প্রাসাদে খালেদা জিয়া-আবদুল্লাহর অন্তরঙ্গ বৈঠকে হাজির থাকার স্মৃতিচারণা করেন। উইকিলিকস প্রকাশিত সৌদি তারবার্তার সত্যতা নিয়েও তিনি সন্দেহ ব্যক্ত করেন। যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর একটি দায়িত্বশীল সূত্র বিষয়টি না জেনে কোনো মন্তব্য করা সমীচীন নয় বলে জানিয়েছে।
তবে এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ প্রথম আলোকে বলেন, সৌদি মনোভাব সম্পর্কে তাঁরা যেটা জানতেন, সেটাই বাদশাহর ওই সিদ্ধান্তে প্রতিফলিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। যুদ্ধাপরাধের বিচার বা অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়ে সৌদি আরবের তরফ থেকে সরকারকে কখনো কিছুই বলা হয়নি বলেও তিনি নিশ্চিত করেন। তাঁর কথায়, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সৌদি সরকারের বিদ্যমান সম্পর্ক চমৎকার এবং তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি ইয়েমেন সংকটে পাকিস্তান সৌদি আরবের পাশে দাঁড়াতে পারেনি, আমরা তাঁদের অনুরোধে দ্রুত সাড়া দিয়েছি। এতে তাঁরা অত্যন্ত সন্তুষ্ট।’
সৌদিতে বাংলাদেশের হয়ে দায়িত্ব পালন করা আরেকজন সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহবুব আলম প্রথম আলোকে বলেন, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করতে অনারব দেশগুলোতে সৌদিরা সাধারণভাবে যে নীতি অনুসরণ করে, সেটাই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা গেল।
ঢাকার সৌদি দূতাবাসের প্রেরিত বার্তার বরাত দিয়ে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০১২ সালের মে-জুন মাসের দিকে তৎকালীন সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহকে মূলত রাজনৈতিক সংকটে মধ্যস্থতা করার অনুরোধ জানিয়ে খালেদা জিয়ার দেওয়া একটি চিঠির বিষয়ে তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু এটা লক্ষণীয় যে এই প্রসঙ্গে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাদশাহকে অবহিত করতে গিয়ে খালেদা জিয়ার আগে জামায়াতের তরফে যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধে যে অনুরোধ জানানো হয়েছিল, তাও নতুন করে বাদশাহকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আর উভয় প্রসঙ্গে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে সৌদি বাদশাহ যে এক বছর আগেই একটি বাদশাহি ফরমান জারি করেছিলেন, তাও ওই পত্রটিতে উল্লেখ করা হয়।
ঢাকার তৎকালীন সৌদি রাষ্ট্রদূত ড. আবদুল্লাহ বিন নাসের আল-বুসাইরি ২০১২ সালের ১৭ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁর গুলশানের কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেছিলেন। ২০১২ সালের আগস্টে সৌদি রাজপরিবারের আমন্ত্রণে রিয়াদ সফরকালে খালেদা জিয়া তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও বর্তমান বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন।
সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সবুজ প্যাডে বাদশাহর কাছে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর লেখা ২০১২ সালের মে-জুন মাসের ওই বার্তায় (স্মারক নম্বর ৭/২, নথি নং ৪/১ তাং ১৪৩৩ সনের রজব মাস) ৬১৬৪৬ নম্বর বাদশাহি ফরমানের কথা উল্লেখ করা হয়, যাতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার কথা উল্লেখ রয়েছে।
ওই বার্তায় বাদশাহ আবদুল্লাহকে বলা হয়, ‘আপনাকে আরও জানাচ্ছি যে ঢাকাস্থ সৌদি রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির নেত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে আপনার উদ্দেশে প্রেরিত একটি পত্র পেয়েছেন, যেখানে সৌদি আরবে আপনার ক্ষমতা আরোহণের সপ্তম বছর পূর্তিতে আপনাকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে এবং বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে সংলাপ আয়োজনে মধ্যস্থতা করার জন্য তিনি আপনাকে অনুরোধ করেছেন।’
সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর বার্তায় আরও লেখেন ‘[ঢাকার] সৌদি দূতাবাস আরও জানিয়েছে যে, সরকার ও বিরোধী দলের বিবাদের কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। অনেক বিরোধিতাকারীকে [নেতা-কর্মী] কারাগারে বন্দী করা হয়েছে, যার শীর্ষে রয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ, যাঁরা একাধিকবার তাঁদের সাহায্য করার জন্য এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে যে বিচারকাজ চলবে, তা বন্ধ করার জন্য সৌদি সরকারের মধ্যস্থতা কামনা করেছিলেন। তাঁর [বেগম জিয়া] চিঠিটি এমন সময় এল, যখন বাংলাদেশের সংকট নিরসনে সৌদি সরকারের মধ্যস্থতার ব্যাপারে বিরোধীদের ব্যাপক আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে।’
উল্লেখ্য, ২০০৮ থেকে ২০১৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয় বছর ঢাকায় ড. বুসাইরি সৌদি রাষ্ট্রদূত ছিলেন। উইকিলিকসে প্রাপ্ত তারবার্তাগুলো তাঁর সময়েই ঢাকা থেকে প্রেরিত হয়েছে। সৌদি রাজপরিবার এবং ঢাকা-রিয়াদ সম্পর্কের বিষয়ে একজন অভিজ্ঞ ঊর্ধ্বতন কূটনীতিক এই প্রতিবেদককে বলেছেন, ‘সৌদি আরব কখনো যুদ্ধাপরাধ বিচার প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সরকারকে আকারে-ইঙ্গিতেও কিছু বলেনি। অবশ্য বাংলাদেশ সরকারই নিজ থেকে তাদের এই বিচারের বিষয়ে সব সময় অবহিত করে এসেছে।’
ওই কূটনীতিক আরও উল্লেখ করেন, তবে তাদের দেশের সরকারনিয়ন্ত্রিত দৈনিক সৌদি গেজেট পত্রিকায় সময়ে সময়ে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে নিবন্ধ ছাপা হয়েছে, তাও সম্পাদকীয় নয়, উপসম্পাদকীয় হিসেবে বেরিয়েছে। আর তাতে আগে ঢাকার সৌদি দূতাবাসে কনসাল হিসেবে কাজ করেছিলেন, এমন এক ভদ্রলোক নিয়মিত লিখেছেন। তবে তাতে কখনো বিচার বন্ধের কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক মান যাতে বজায় থাকে।
ইসলামাবাদ থেকে: ওদিকে, পাকিস্তানের সৌদি দূতাবাস রিয়াদে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া দপ্তরে এক ‘গোপনীয়’ তারবার্তায় [নম্বর ১০/৭/৩ তাং ৭/৩/১৪৩৩ হিজরি, ইংরেজি ৩০ জানুয়ারি ২০১২] জানায়, ‘মাননীয় রাষ্ট্রদূত বিশেষ উৎস হতে জানতে পেরেছেন যে, বাংলাদেশের কারাগারে অন্তরীণ দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের যদি ১৯৭১ সালের (পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন হওয়ার বছর) যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার করা হয়, তাহলে এটা পাকিস্তান, বিশেষ করে তার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে উসকানি হিসেবে কাজ করবে। এই সূত্র আরও জানাচ্ছে যে, সর্বশেষ ৯০ বছর বয়সী অধ্যাপক গোলাম আযমকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগে এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন হওয়ার যুদ্ধে গুপ্তহত্যায় (ইকতিয়াল) অংশগ্রহণের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
‘পাকিস্তানের অবসরপ্রাপ্ত কিছু সামরিক কর্মকর্তা মনে করেন, এই উসকানি [যুদ্ধাপরাধের বিচার] দেওয়ার নেপথ্যে রয়েছে ভারত। তারা আন্তর্জাতিক বিচারের ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে জড়াতে চাইছে। ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য…’
উল্লেখ্য, এই বার্তাটির এরপরের অংশ পাওয়া যায়নি। তবে এতে এ-সংক্রান্ত একটি পূর্ববর্তী বার্তার (নম্বর ২১০/৯২/২১/১৮৮ তাং ১৮/৩/১৪৩১, ইংরেজি ৪ মার্চ ২০১০) বরাত দেওয়া আছে, যা ইঙ্গিত দেয়, যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়ে পাকিস্তানি মনোভাব সৌদি আরবের আগ্রহের বিষয় ছিল। জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের বিচার বন্ধে হস্তক্ষেপ করতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল।
আরাফাতের চিকিৎসা: তৎকালীন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৌদ আল ফয়সাল (বর্তমান বাদশাহ সালমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা) প্রয়াত বাদশাহ আবদুল্লাহর বিশেষ সচিবকে ২০১২ সালের মার্চে বলেন, ‘সৌদি সরকার বাংলাদেশের শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে রিয়াদস্থ বাদশাহ ফয়সাল বিশেষায়িত হাসপাতালে সৌদি আতিথেয়তার খরচে চিকিৎসার জন্য একটি অনুরোধপত্র পেয়েছেন।’ আরাফাত রহমান আর্থিক দুর্নীতির দায়ে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত উল্লেখ করে তাঁকে জানানো হয় যে আপাতত তিনি থাইল্যান্ডের ব্যাংককে চিকিৎসাধীন আছেন। বার্তায় এরপর লেখা হয়েছে ‘খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, তাঁর রোগের চিকিৎসা সৌদি আরবে যেমন আছে, তেমনি থাইল্যান্ডেও রয়েছে। এমতাবস্থায় এ বিষয়টি এড়ানো উত্তম হবে। কেননা, এতে করে শেখ হাসিনা ওয়াজেদের সরকার এবং সৌদি সরকারের মধ্যে টানাপোড়েনের সৃষ্টি হবে।’
বিএনপির নেতা ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মীর নাছির প্রথম আলোকে বলেন, সাবেক রাষ্ট্রদূত আল বুসাইরির সঙ্গে তিনি সৌদি আরবে তারেক রহমানের চিকিৎসা বিষয়ে কথা বলেছিলেন। তিনি যথেষ্ট ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছিলেন। তবে আরাফাতের বিষয়টি তাঁর জানা নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন। অথচ প্রাপ্ত তারবার্তায় দেখা যায়, আল বুসাইরি আরাফাতের চিকিৎসায় খালেদা জিয়ার অনুরোধ রক্ষায় বর্তমান সরকারের সংবেদনশীলতা বিবেচনায় তাঁর সরকারের কাছে নেতিবাচক মতামত ব্যক্ত করেছিলেন।
উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া নথি সূত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কের বিষয়ে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট এম হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘সৌদি আরবের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের বিষয়ে সাধারণভাবে যে ধারণা প্রচলিত, তার সঙ্গে বাস্তবতার যে পার্থক্য, সেটাই এবারে উন্মোচিত হলো। গত এক দশকে সৌদি আরবে কয়েকবার ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। সুতরাং সেখানে আবেগ রহিত বাস্তবানুগ ও পরিপক্ব পররাষ্ট্রনীতির প্রতিফলন ঘটবে, সেটাই স্বাভাবিক। এখন বরং আমাদেরই উচিত হবে আবেগমুক্ত হওয়া।’ ( সুত্রঃ প্রথম আলো, ৪ জুলাই ২০১৫)