ছিপখান তিন দাড়
তিনজন মাল্লা
চৌপর দিনভর
দেয় দূর পাল্লা
আলসে নয় সে
ওঠে রোজ সকালে
রোজ তাই চাঁদা ভাই
টিপ দেয় কপালে
প্রথম চার লাইন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের এবং পরের চার লাইন কাজী নজরুল ইসলামের. সাহিত্য চর্চার প্রথম দিকে ছন্দে, বিদ্রোহে এবং মানবতায় নজরুল সত্যেন্দ্রনাথ দ্বারা অনুপ্রানিত হয়েছেন খুব. দেশ বন্ধু চ্ত্তিরঞ্জন দাসের ভক্ত ছিলেন. দেশবন্ধুর মৃত্যুতে আবেগ তাড়িত হয়ে লিখেছিলেন ‘চিত্তনামা’, যা ছাপা হয়েছিল ‘নারায়ণ’ পত্রিকায়.
মাত্র দশ-বারো বছর বয়েসেই নিজ এবং আশেপাশের গ্রামের লেটো গানের দলের জন্য কথিকা লিখে দিতেন. কোনো এক দলের প্রধান নজরুল কে আদর করে ব্যাঙাচি ডাকত এবং বলত ‘বড় হয়ে তুই সাপ হবি’. স্কুল পালিয়ে, গান গেয়ে, বাঁশি বাজিয়ে, রুটি বানিয়ে বঙ্গ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে আবারও স্কুল পালিয়ে মিলিটারিতে ভর্তি হলেন. বাল্যবন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে মিলিটারিতে যাওয়া হয় না. ১৯১৭ থেকে ১৯১৯ এই দুই বছর করাচিতে ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে চাকরি করেন এবং কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পদে পদোন্নতি লাভ করেন. এই সময়ে এক পাঞ্জাবি মৌলানার সান্নিধ্যে এসে ফার্সি শেখেন এবং হাফিজের রুবাইয়াত এর অংশবিশেষ অনুবাদ করেন. তখন টাটকা রুশ বিপ্লব দ্বারা অনুপ্রানিত হয়ে লিখে ফেলেন ‘ব্যথার দান’. করাচি থেকে ডাক যোগে লেখা পাঠাতেন ‘বঙ্গিয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা’, ‘মোসলেম ভারত’ ইত্যাদিতে. পত্রযোগে পরিচয় কমরেড মুজাফফর আহমদের সাথে. ৪৯ নং বাঙালি পল্টন ভেঙ্গে গেলে মুজাফফর আহমদ নজরুলকে কলকাতায় চলে আসতে বলেন. ১৯২০ এ নজরুলের সাব রেজিস্টার পদে চাকরি জুটে যায়. মুজাফফর আহমদ এবং অন্য বন্ধুদের উপদেশে নজরুলের চাকরিতে যাওয়া হয় না. ‘বিদ্রোহী’ ছাপা হয় ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় ১৯২২ সনে. চারিদিকে সাড়া পড়ে যায় – বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি হতে থাকে ‘বিদ্রোহী’ নিয়ে. ব্যঙ্গ বিদ্রুপও হয় কিছুটা. এ প্রসঙ্গে সজনীকান্ত দাসের ‘ব্যাঙ’ এবং গোলাম মোস্তফার ‘নিয়ন্ত্রিত’ উল্লেখযোগ্য.
গজেন দাসের আড্ডায় এসে নজরুল প্রচুর রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন. তখন নজরুলের নিজের গান খুবেকটা ছিলনা. অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর অগ্নিবিনার প্রচ্ছদপট এঁকে দিয়ে তাকে উত্সাহিত করেছিলেন. উদ্দাম নজরুল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে গিয়েও গান গেয়ে আবৃত্তি করে জমিয়ে এসেছেন. মাত্র তেতাল্লিশ বছর অব্দি লেখালেখি করতে পেরেছেন. এই অল্প সময়েই সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে জলে স্থলে আকাশে ছড়িয়ে দিয়েছেন সুর এবং শব্দের ঝংকারের ধ্বনি প্রতিধ্বনি. যত দিন বোধবুদ্ধি ছিল ততদিন গল্প উপন্যাসের চরিত্রের মতন বেঁচেছেন – চারপাশ মাতিয়ে রেখেছেন.
কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত এবং সর্বাধিক প্রচারিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে. গ্রন্থটি বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সাগ্নিক বীর বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে উত্সর্গ করা হয়েছিল. এই কাব্যগ্রন্থের নাভীকেন্দ্র ‘বিদ্রোহী’ কবিতা. প্রকাশের পর কবিতাটি এত আলোড়ন তুলেছিল যে ‘বিদ্রোহী’ শব্দটি উপসর্গের মতন কবির নামের আগে বসে স্থায়ী হয়ে যায় – নামের অংশ হয়ে যায়. ১৯২১ সালের দূর্গা পূজার কাছাকাছি সময়ে কবিতাটি লেখা হয়.
অতি বিখ্যাত হয়ে যাবার কারণে কবিতাটি নিয়ে খানিকটা টানা-হ্যাচরাও হয়. মোহিতলাল মজুমদার দাবি করেন তার লেখা ‘আমি’র ( ১৯১৪ সালে মানসী পত্রিকায় প্রকাশিত) ভাব ধার করেই নজরুল ‘বিদ্রোহী’ রচনা করেছেন. ‘আমি’র কিছু অংশ এখানে জুড়ে দেয়া হলো:
‘ আমি বিরাট. আমি ভূধরের ন্যায় উচ্চ, সাগরের ন্যায় গভীর, নভোনিলিমার ন্যায় সর্বব্যাপী. চন্দ্র আমারি মৌলিশোভা, ছায়াপথ আমার ললাটিকা, অরুনিমা আমার দিগন্তসীমান্তের সিন্দুরচ্ছটা, সূর্য্য আমার তৃতীয় নয়ন এবং সন্ধ্যারাগ আমার ললাটচন্দন.
আমি সুন্দর. শিশুর মত আমার ওষ্ঠাধর, রমনীর মত আমার কটাক্ষ……………….
আমি ভীষন – অমানিশিথের সমুদ্র, শ্মশানের চিতাগ্নি, কাল বৈশাখীর বজ্রাগ্নি, হত্যাকারীর স্বপ্নবিভিষিকা, ব্রাহ্মণের অভিসাপ, দম্ভান্ধ পিতৃরোষ.’
‘বিদ্রোহী’র কিছু চুম্বক অংশ নির্বাচন করতে গিয়ে খুব ঝামেলায় পরে গেলাম. চৌম্বকত্ব বিচারে কবিতাটির প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য প্রায় সমভাবে দামামা-ধ্বনিময় এবং কাব্যাকর্ষনীয়. অন্ধের মত বেছে কয়েকটা বাক্য এখানে তুলে দিলাম.
‘ বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি, চদ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি,
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া, খোদার আসন ‘আরস’ ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব বিধাতৃর.
…. আমি দুর্বার, আমি ভেঙ্গে করি সব চুরমার, আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল, আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল.
….. যবে উতপিরীতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খরগ কৃপান ভীম রণভূমে রনিবেনা
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত…..
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেই পদচিহ্ন.’
‘বিদ্রোহী’ এবং ‘আমি’র মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের বর্ণনার দৃষ্টিকোণ থেকে মিল রয়েছে সন্দেহ নেই. আমি’র রয়েছে সার্বজনীন দার্শনিকতা আর ‘বিদ্রোহী’ দার্শনিকতার মলাট ছিড়ে বেরিয়ে আসা সমাজ-ভাঙ্গার সমাজ-গড়ার আহ্বানের প্রতিধ্বনির ঝংকার. প্রতীক, উপমা এবং ভাষার বিচারে উভয়ের সহধর্মিতা আমার মতন নাদান পাঠকেরও চোখ এড়ায়না. তবে একথা সত্য যে, কোনো সাহিত্যকর্মের প্রেরনায় যেকোনো উঁচুদরের সাহিত্য সৃষ্টি হতে পারে. ‘বিদ্রোহী’ যদি ‘আমি’র প্রেরনায় সৃষ্টি হয়েও থাকে, তাহলেও ‘বিদ্রোহী’ সূর্যের মত রোদ-বিকিরণ করা উজ্জল. জন্মের পঁচানব্বই বছর পরেও বাঙালি পাঠকের মনে আগুন ঝরায় – শ্রোতার গাত্রলোম খাড়া করে ছাড়ে.
বিদ্রোহী কবির জন্মদিনে কবিভক্তদের লাল সেলাম.
( এই লেখাটি সুশীলকুমার গুপ্তের ‘নজরুল মানস চরিত’ গ্রন্থের প্রেরনায় লেখা)
ইমতিয়াজ কায়েছ রিশা , সিডনি থেকে