৩২ নম্বরে সেই ভয়াল দিনে

৩২ নম্বরে সেই ভয়াল দিনে

অনলাইন ডেস্ক: সামনে সোফায় বসা প্রবীণ মানুষটার হাত কাঁপছে। নিশ্বাস পড়ছে ঘন ঘন। মুঠোফোনের পর্দার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। পর্দায় রক্তাক্ত নিথর পড়ে আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমরা অপেক্ষা করছি। কয়েক মুহূর্ত দেখলেন তিনি ছোট ভিডিওটা। তারপর নিজের অজান্তেই যেন গলা চড়ল তাঁর, ‘এই তো। এই তো আমার করা সেই ভিডিও।’
গতকাল বিকেল। ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কে জিয়াউল হকের বসার ঘরে অকস্মাৎ নীরবতা নামে। আচমকা আমাদের মনে হয় ধানমন্ডি ২৭ থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোড এত কাছে! ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘৃণিত অধ্যায়টি রচিত হয়েছিল এই ৩২ নম্বরেই।
চুলে পাক ধরেছে। কিন্তু সেই দৃশ্য কী করে ভুলবেন জিয়াউল হক? বাংলাদেশ টেলিভিশনের এই চিত্রগ্রাহককে সেদিন উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে।
‘১৫ আগস্ট ভোরবেলা ঘুম ভাঙল প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে। মুহুর্মুহু গুলির শব্দে প্রকম্পিত চারদিক। ভারী ট্যাংক নেমে গেছে রাস্তায়। কোথায় কী হচ্ছে বোঝার উপায় নেই। ভয়ে ভয়ে চালু করলাম রেডিও। বেতারযন্ত্রে ভেসে এল যে খবর, সেটা বিশ্বাস করা কঠিন—বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন। খবরটা গরম সিসার মতো গিয়ে ঢুকল কানে।’
তারপর?
জিয়াউল হকের স্মৃতিচারণা চলতে থাকে: ‘সকাল ১০টার দিকে একটা জিপ এসে থামল আমার বাড়ির সামনে। জিপে বসা মানুষগুলোর প্রায় সবার হাতে স্টেনগান। কারও হাতে রিভলবার। ভাবলেশহীন মুখ। জিপ থেকে নেমে এসে কেউ একজন বলল, চলো। নিহত শেখ মুজিবের ছবি তুলতে হবে। শুনে কলজেটা যেন ধক করে উঠল। ক্যামেরা কোলে নিয়ে উঠে বসলাম জিপে। চারপাশে সশস্ত্র একদল মানুষ। মনে মৃত্যুভয়। ৩২ নম্বরে এসে থামল জিপগাড়িটা।’
৩২ নম্বর রোডে সেদিন কী দেখেছিলেন তিনি?
‘অভ্যর্থনা কক্ষে পা রাখতেই দেখি শেখ কামাল। মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন তিনি। চোখের চশমাটা পড়ে আছে পাশে। বারুদ আর মাংস পোড়া গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। সামনের সিঁড়ির প্রথম ধাপটায় পা রাখতেই রক্ত! ওপরতলার সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছে রক্তের স্রোত।’
ঘোর লাগা মানুষের মতো শুকনো রক্তের স্রোতে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে চলেন জিয়াউল। সিঁড়ির একটা বাঁক ঘুরতেই সবচেয়ে বড় ধাক্কা।
‘ওপরের সিঁড়ির ঠিক তিনটা ধাপ নিচে নিথর পড়ে আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মহান নেতা। ঘাতকের বুলেট উড়িয়ে নিয়ে গেছে তাঁর সেই বিখ্যাত তর্জনী! যে তর্জনী উঁচিয়ে তিনি দিয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক। নিজের চোখই যেন বিশ্বাস হতে চায় না। মনে হচ্ছিল আমি দুঃস্বপ্ন দেখছি না তো,’ বলছিলেন জিয়াউল হক।
পা দুটো বিদ্রোহ করে বসতে চায়। বহুদিনের সঙ্গী হাতের ক্যামেরাটা মনে হয় কয়েক টন ভারী। কিন্তু পিছু ফেরার উপায় নেই। কাঁপা কাঁপা হাতে ক্যামেরার ফোকাস ঠিক করেন তিনি। তখনো জানেন না বঙ্গবন্ধু একা নন, ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পাননি তাঁর পরিবারের সদস্যরাও। সেদিন প্রায় এক মিনিটের মতো চিত্র ধারণ করেছিলেন জিয়াউল হক। মাদ্রাজ থেকে ব্লো-আপও করিয়ে আনা হয়েছিল তাঁর সেই ফুটেজ। কয়েকটি কপিও করে রাখা হয়েছিল সিডিতে। কিন্তু…
‘বিটিভির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দিয়েছিলাম সেই কপিগুলো।’ এরপর কোনো একটা রহস্যময় কারণে লাপাত্তা হয়ে যায় সেই মহা দুর্লভ ভিডিওচিত্র।
‘ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নাতি আমি। আমার কি শোভা পায় এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি? আমি সেই ভিডিওটা করেছিলাম, সেটা আমি তো জানি।’ বলে আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক এই প্রধান চিত্রগ্রাহক।

তথ্যসূত্র: ২০০৯ সালের ১৫ আগস্ট ছুটির দিনেতে প্রকাশিত ‘এক চিত্রগ্রাহকের চোখে সেই ১৫ আগস্ট’ শিরোনামের প্রতিবেদন